• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৬ বছর: এখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখে পাহাড়কন্যারা

প্রকাশিত: ০০:২৮, ২ ডিসেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১৩:২১, ২ ডিসেম্বর ২০২৩

ফন্ট সাইজ
পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৬ বছর: এখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখে পাহাড়কন্যারা

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩। টানা তিনদিনের ছুটিতে দেশ। ছুটি পেয়েই পর্যটকরা ছুটেছেন দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র পার্বত্য জেলা রাঙামাটির সাজেক ভ্যালীর উদ্দেশ্যে। একদিনে সেখানে গিয়েছেন সাড়ে ৩ হাজারের বেশি পর্যটক। কিন্তু এত পর্যটক থাকার ব্যবস্থাতো নেই সাজেকের হোটেলগুলোতে। ফলে তৈরি হয় চরম রুম সংকট। এ সময় পর্যটকদের পাশে দাঁড়ান সেখানকার স্থানীয়রা। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ঘরই হয়ে যায় পর্যকটকদের মেহমানখানা। বিনিময় হিসেবে অর্থ আয়ের পাশাপাশি তৈরি হয় এক মধুর সম্পর্কও। এমন ঘটনা যে শুধু এই দিনই ঘটেছে তেমন নয়। টানা ছুটি পড়লেই সাজেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে পর্যটকরা। সেই সময় রুম সংকটের সুযোগে তৈরি এমন বহু সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক।

মূলত সড়ক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের পর বিগত দশকের শুরুতে সাজেকগামী হতে থাকে পর্যটকরা। এক পর্যায়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্যে ভরা এই পর্যটন স্থান। পর্যটকরা শুধু যে পাহাড় দেখতেই সাজেকে যায় তেমন নয়, পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি আদানপ্রদানও হয় এই পর্যটনের মাধ্যমে। তৈরি হয় উভয়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক। যা ভূমিকা রাখে পাহাড়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে।

সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের দুই পাহাড়ী কন্যা ঋতুপর্ণা চাকমা ও মনিকা চাকমা

তবে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে দেশের সমতল অংশের মানুষের এমন সম্পর্কের ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়। একসময় ছিল চরম বৈরী সম্পর্ক। পাহাড় ছিল অস্থির। যেখানে প্রতিনিয়ত চলতো খুনোখুনি। কথায় কথায় ঝরতো মানুষের প্রাণ। ফলে পাহাড় ছিল চরম আতঙ্কে ভরা এক জনপদ। শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ কোনো ক্ষেত্রেই ছিল না উন্নয়নের ছোঁয়া। মৃত্যুপুরীর ভয়ে দিনের আলো নিভে গেলে স্তব্ধ হয়ে যেত পুরো পার্বত্য অঞ্চল। শুধু দিনে-রাতে মানুষের মৃত্যুই নয়, রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত ছিল পাহাড়ের মানুষগুলো। যার অবসান ঘটে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি’র মাধ্যমে।

এই শান্তি চুক্তির মাধ্যমে সেই বছরের ২ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে তৎকালীন সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘শান্তি বাহিনী’র সদস্যরা। আজ পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৬ বছর পূর্ণ হচ্ছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিগত ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা কেমন বাংলাভিশনের পক্ষ থেকে জানতে চেয়েছিলাম স্থানীয় নাগরিক সমাজ এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের কাছে।

নারী ফুটবলের অন্যতম সফল মুখ আনুচিং মোগিনী ও আনাই মোগিনী। যারা সম্পর্কে আপন দুই বোন

শিক্ষক ও লেখক শোভা রানী ত্রিপুরা। রাঙামাটিতে জন্মগ্রহণকারী এই নারী পাহাড়ে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠীদের নিয়ে অনেক বই লেখার পাশাপাশি ছোটগল্প, উপন্যাস ও নাটক রচনা করেছেন। মহলছড়ি চৌঙরাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক এই প্রধান শিক্ষিকা পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ত্রিপুরাদের নাগরিক প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিতি। আদর্শ নারী শিক্ষক হিসেবে তিনি ১৯৮৬, ১৯৮৬ ও ২০০০ সালে শ্রেষ্ট নারী শিক্ষক অ্যাওয়ার্ড এবং ২০১৭ সালে বেগম রোকেয়া পদক অর্জন করেন।

পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ত্রিপুরাদের এই নাগরিক প্রতিনিধি বাংলাভিশনকে বলেন, এখন তো পাহাড়ে আতঙ্ক নেই। অনেক উন্নয়ন হয়েছে। প্রচুর মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে। রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন হয়েছে। পর্যটকরা আসছে, আমাদের লোকজনের আয়ও হচ্ছে। এখন রাতে রাঙামাটি থেকে রওনা দিয়ে সকালে ঢাকায় চলে যেতে পারি। আগে কোথাও যাওয়াতো দূরের কথা সন্ধ্যার পর মানুষ বেরই হতো না। একটা সময় ছিলো আমরা সবাই আতঙ্কে থাকতাম। এখন দুএকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আতঙ্কের তেমন কিছুই নেই। এটা শান্তি চুক্তির কারণেই সম্ভব হয়েছে। এখন শুধু ভূমি নিয়ে কিছু সমস্যা আছে।

খাগড়াছড়ির গর্ব নারী ফুটবলের সহকারী কোচ তৃষ্ণা চাকমা

তিনি আরও বলেন, আমি সবসময় শান্তির পক্ষে। ক্ষুত্র নৃ-গোষ্ঠী বলেন, চামকা বলেন, মারমা বলেন বা বাঙালি বলেন আমরা চাই সবার মধ্যে শান্তি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সেটাই চেয়েছেন। সংঘাত হলেতো সবারই কষ্ট। আমরা শান্তি চাই। এখন আমরা সেই শান্তিটাই পাচ্ছি। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই শান্তিচুক্তিটি একটি মাইলফলক। একজন দেশপ্রেমিক সুনাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের এই অর্জন নিয়ে গর্ববোধ করি। আমি মনে করি এই চুক্তির জন্য যারা নিজেদের জ্ঞান, দক্ষতা, শ্রম এমনকি জীবন দিয়েছেন তাদের স্মরণ করা উচিত। তাই আমরা পাহাড়ের বিভিন্ন সংগঠন ২ ডিসেম্বর দিবসটি পালন করি। পার্বত্য অঞ্চলতো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, সুতারাং এ অর্জন সারা বাংলাদেশের এমনকি যদি পুরো বিশ্বকে একটা গ্লোবাল ভিলেজ চিন্তা করি তাহলে এটা পুরো বিশ্বের জন্য একটা অর্জন। কারণ এর মাধ্যমে উভয়পক্ষ ঐক্যমতে পৌঁছে একটা সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

চুক্তির আগে এবং পরের পাহাড়ের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ বলে দাবি করে পার্বত্য অঞ্চলের এই ইতিহাসবিদ বলেন, এই চুক্তির ফলে পাহাড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়েছে, উন্নয়ন কাজগুলো চলছে এবং জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন এসেছে। এটাকে আমরা পাহাড়ের জনগোষ্ঠীগুলোর স্বীকৃতি হিসেবে দেখি। এই চুক্তি আমাদের স্বপ্ন দেখার ও স্বপ্ন বোনার শক্তি দিয়েছে। আগে এখানকার মানুষের চিন্তাভাবনা ছিলো খুবই লোকাল, খুবই ন্যারো। এখন তারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে। জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের পাহাড়ের মানুষ স্বীকৃতিও অর্জন করছে। এইযে সুরকৃষ্ণ চাকমা, তার অর্জন আমরা দেখেছি। আমাদের পাহাড়ের মেয়েরা এখন বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বমঞ্চে ফুটবল খেলে সুনাম কুড়াচ্ছে। শান্তিচুক্তির আগে এটা অকল্পনীয় ছিল। তখন পাহাড়ের একটা নারী ঘর থেকে বের হতেই ভয় পেত। আর এখন তারা বিশ্ব জয় কারার স্বপ্ন দেখে।

তিনি আরও বলেন, এই চুক্তির পর আমাদের সড়কব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন হয়েছে। স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও হয়েছে। এছাড়া পর্যটনের কারণে সমতলের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়ে পাহাড়ের মানুষের চিন্তার জগৎ খুলেছে। এখন সমতলের মানুষের মধ্যেও পাহাড়ের মানুষদের প্রতি একটা পজেটিভ ধারনা জন্ম নিয়েছে। তারা এখন মনে করে এটা কোনো আতঙ্কজনক এলাকা নয়। এই অবাধ গমনাগমন উভয়ের সংস্কৃতি বিনিময়েরও সুযোগ করে দিচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, যে কোনো চুক্তিরই সব শর্ত পূরণে অনেক জটিলতা থাকে। এই চুক্তির ক্ষেত্রেও তেমন কিছু রয়ে গেছে। তবে সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তির ২৬ বছর যদি মূল্যায়ন করি উন্নয়নের যে বিষয়টি অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা, রাস্তাঘাট তৈরি করা এগুলো মোটামুটিভাবে পূরণ হয়েছে এবং তাদের ভাষাকে মূল্যায়ন করা, তাদের সংস্কৃতিকে সামনে নিয়ে আসা এগুলো অনেক কিছুই হয়েছে। তবে তাদের অন্যতম একটি চাওয়া ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, সেটা এখনো অনেকটাই অমিমাংসিত রয়ে গেছে। এর অন্যতম কারণ ভূমি সংক্রান্ত দেশের বিদ্যমান আইন ও পার্বত্য এলাকার সামাজিক আইনের মধ্যে অনেক ধরনের তফাৎ আছে। ফলে সেখানে এখনো ঘাটতি রয়ে গেছে। তাই এমন একটা অবস্থায় আছে যে ২৬ বছরে সব কিছু হয়ে গেছে বা কিছুই হয়নি কোনোটা বলা ঠিক হবে না। তবে আশা করা যায় যে যেখানে যেখানে ঘাটতি আছে সেগুলোও ধিরে ধিরে সমাধান হবে। 

তিনি বলেন, সরকার একটা বিষয় দেখছে যে যদি সেখানে বড় ধরনের উন্নয়ন হয় তাহলে তাদের (পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর) চাকরির বাজার যদি নিশ্চিত হয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যদি বাড়ে, তাদের এক্সেস যদি বাড়ে এবং তাদের মধ্যে দেশের প্রতি আস্থা বাড়লে অন্যগুলো সমাধান সহজ হবে। তাদের (পাহাড়ী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর) নিজেদের মধ্যেও অনেকে সংখ্যায় কম এবং আর্তসামাজিকভাবেও এগিয়ে নেই এমন কিছু জনগোষ্ঠীও আছে। শিক্ষার ব্যাপারেও তাদের অনেকেই এগিয়ে আছে, আবার একেবারেই নেই এমনও আছে। সবাইকে এগিয়ে নিতে হবে।

ভূমি বিরোধ সমাধান কিভাবে হতে পারে জানতে চাইলে এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক বলেন, আমার মনে হয় সমাধানের বিষয়ে উভয়ের মধ্যে আলোচনা সবসময় চালিয়ে যাওয়া দরকার। কারণ আলোচনা চালালে হয়তো নতুন কোনো সমাধান আসতেই পারে। তবে যে জিনিসটা দেখা দরকার, জমি পেয়ে আমি কি করতে চাচ্ছি। আমিতো শেষ বিচারে জমি পেয়ে হয় আমি বাসস্থান করবো, নয় আমি চাষাবাস বা উৎপাদন করবো। জমিটাতো সাজিয়ে রাখারতো ব্যপার না তাই না। সেই জমিতে আমার চাষবাস করার বা উন্নয়ন করার অধিকার আছে কিনা সেটা যদি কাঠামোতে নিয়ে আসা যায়। এমন একটা কাঠামো তৈরি করা যায়, যাতে তারা চাষবাসও করতে পারছে এমনকি উন্নয়নও করতে পারছে যে চাষবাস ও উন্নয়নে অন্যদেরও এক্সেস থাকবে। এবং সেটা একটা সুনির্দিষ্ট কমিউনিটি ভোগ না করে সবাই ভোগ করবে এমন একটা কিছুও করা যতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন নিয়মিত বসা।

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2