শহীদ বুদ্ধিজীবী ও কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার- নামেই যার প্রকাশ। কেবল সাহিত্য নয়, সাংবাদিকতা ও দেশের প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিতেও তার অবদান রয়েছে। রাজনীতির জন্য বেশ কয়েকবার কারাগারেও যেতে হয়েছে এই রাজনৈতিক সচেতন মানুষ। তার অনেক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ও নাটক। তার সেরা কাজ সংসপ্তক উপন্যাস, যেখানে তিনি দেশের বিভিন্ন সময়কে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নিপূণতার সঙ্গে। সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকসহ নানা পুরস্কার।
১৯২৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মাজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শহীদুল্লা কায়সার। তার বাবার নাম মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ্ এবং মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা।
শিক্ষাজীবনের শুরুতে সরকারি মডেল স্কুল এবং পরে 'মাদরাসা-ই-আলিয়া'র অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পাশ করে ভর্তি হন কলকতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৪৬ সালে তিনি এখান থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন এবং অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু এখানকার পড়া শেষ করতে পারেননি তিনি। একই সাথে তিনি 'রিপন কলেজে' (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজ) আইন বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। কিন্তু দেশ বিভাগের কারণে এই পড়াও শেষ করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বাবার সাথে ঢাকায় চলে আসেন শহীদুল্লাহ। এখানে এসে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ ক্লাসে। এসময় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, আর মাস্টার্স শেষ করার আগেই লেখাপড়া ছেড়ে দেন।
ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন শহীদুল্লা কায়সার। রাজনীতির কারণে একাধিকবার কারাগারেও যেতে হয়েছে তাকে। ১৯৪৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ও ১৯৫১ সালে পার্টির সদস্য হন। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ লাভ করেন। পাশাপাশি দেশপ্রেমিক ও বিশ্বকর্মা ইত্যাদি ছদ্মনামে বিভিন্ন পত্রিকায় দেশের নানা সমস্যা নিয়ে কলাম লেখাও চলতে থাকে শহীদুল্লা কায়সারের।
১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রাখার কারণে পাকিস্তানি শাসকদের চক্ষুশূল হন শহীদুল্লা কায়সার। যার ফলে ১৯৫২ সালের ৩ জুন প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হন তিনি। তখন দীর্ঘ তিন বছর অন্তরীণ ছিলেন এই নেতা। ১৯৫৫ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পরেই ফের আটক হন শহীদুল্লাহ। কয়েক বছর পর মুক্তি পান। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক আইন জারি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৪ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করা হয়৷ জননিরাপত্তা আইনে এই দফায় তাকে প্রায় চার বছর আটকে রাখা হয়। মুক্তি পান ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে।
[caption id="attachment_72395" align="aligncenter" width="799"]
শহীদুল্লা কায়সারের নামে সড়ক ফলক[/caption]
সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন শহীদুল্লা কায়সার। তিনি ১৯৪৯ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিচালিত "সাপ্তাহিক ইত্তেফাক" পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন শহীদুল্লা। এ বছরের অক্টোবরে গ্রেফতার হন। ১৯৬২ সালে মুক্তি পেয়ে পুনরায় দৈনিক সংবাদে কাজ শুরু করেন এবং আমৃত্যু এ পত্রিকার সাথেই জড়িত ছিলেন তিনি।
প্রগতিশীল দলের রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হতো। পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশাতেও যথেষ্ট সময় দিতে হতো তাকে। তারপরও লেখালেখি করেছেন প্রচুর। এটা স্পষ্ট যে, লেখালেখি ছিল তার ভাললাগা আর ভালবাসার অন্যরূপ; যে কারণে সংশংপ্তক ও সারেং বউয়ের মতো উপন্যাস রচনা করতে পেরেছেন এই সাহিত্যিক।
তার উপন্যাসের মধ্যে- সংশপ্তক, সারেং বউ, কৃষ্ণচূড়া মেঘ, তিমির বলয়, দিগন্তে ফুলের আগুন, সমুদ্র ও তৃষ্ণা, চন্দ্রভানের কন্যা, কবে পোহাবে বিভাবরী (অসমাপ্ত) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, রাজবন্দীর রোজনামচা (১৯৬২) ও পেশোয়ার থেকে তাসখন্দ (১৯৬৬) নামে তিনি দু'টি স্মৃতিকথা ও ভ্রমণকাহিনী রচনা করেছেন।
শহীদুল্লাহ কায়সারের সেরা সাহিত্যকর্ম "সংশপ্তক" উপন্যাস। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বাংলা সাহিত্যে এটি শহীদুল্লা কায়সারের এক অমর কীর্তিগাথা যার আভিধানিক অর্থ- হয় জয় না হয় মৃত্যু। রাজনৈতিক পটভূমিতে রচিত এদেশের হিন্দু- মুসলমানের সম্মিলিত জীবন নিয়ে এবং অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে অনুপ্রাণিত সার্থক সৃষ্টি সংশপ্তক, যা প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। বিশাল কলেবরে রচিত এই উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ভাষা আন্দোলনের সুবিশাল প্রেক্ষাপট। উপন্যাসটিতে একদিকে যেমন মহাকাব্যিক ব্যপ্তি আছে, অন্যদিকে এর প্রসারতাও লক্ষ্যণীয়। "সংশপ্তক" উপন্যাসের দীর্ঘ আয়তনে ধরা পড়েছে বহু চরিত্র- সকলের উপর জাগ্রত পুরুষশাসিত মুসলিম সমাজে নারীর অধিকারবোধ নিয়ে জেগে ওঠার আকুতি। সেই সময় এই আকুতি একজন পুরুষের লেখনী দিয়ে ফুটে উঠবে-তা সত্যিকার অর্থেই অনবদ্য।
গুণী এই সাহিত্যিক তার সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসাবে জীবদ্দশাতেই পেয়েছেন আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬২) ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এছাড়া, শহীদুল্লা কায়সার ১৯৮৩ সালে সাংবাদিকতায় মরণোত্তর একুশে পদক (মরণোত্তর) এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯৮ সালে পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর)।
শহীদুল্লা কায়সার ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পান্না কায়সারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির দুই সন্তার শমী কায়সার ও অমিতাভ কায়সার।


পান্না কায়সার নিজেও একজন লেখক। পেশাজীবনে তিনি অধ্যাপনার সাথে জড়িত ছিলেন। এছাড়া, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসাবে তিনি সংসদ সদস্য (১৯৯৬ – ২০০১) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। শহীদুল্লা কায়সারের ভাই জহির রায়হান ছিলেন দেশের একজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও কথাসাহিত্যিক।
রাজনীতিক সচেতন এই সাহিত্যিককে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর ফেরেননি শহীদুল্লা। পরে তার খোঁজে গিয়ে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি চিরতরে নিখোঁজ হন ছোট ভাই বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানও।
আজ ১৬ ফেব্রুয়ারি, বেঁচে থাকলে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও প্রখ্যাত এই কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার ৯৫তম জন্মদিন উদযাপন করতেন। শুধু জন্মদিনেই নয় পাঠকপ্রেমীদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।
বিভি/এনজি
মন্তব্য করুন: