এখনো টিএসসিতে তোলা ত্রাণের ১৯ লক্ষাধিক টাকা আছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কাছে

ভিক্ষুক স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে প্রতিবেশীদের দয়া-অনুগ্রহে কোনোরকম দিনাতিপাত করছেন ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের বাসীন্দা বৃদ্ধা তাহেরুন্নেসা। এরই মধ্যে গেল বছরের আগস্টের ভয়াবহ বন্যা ভেঙে নিয়ে যায় তার একমাত্র আশ্রয়স্থল ঘরটির একাংশ। এখন কোনো রকম খুঁটি দিয়ে টিকিয়ে রাখা ঘরটি যেন এক ধ্বংসাবশেষ যা পড়ে যেতে পারে সামান্য ধাক্কায়। তাই প্রাণভয়ে ঘর ছেড়ে উঠেছেন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে।
নিঃস্ব তাহেরুন্নেসা বলছেন, বন্যার সময় কিছু খাদ্যসামগ্রী ও অল্প কিছু টাকা ছাড়া আর কিছুই জোটেনি তার ভাগ্যে। ঘর তুলে দিতে এগিয়ে আসেননি কেউই। ফেনীসহ পূর্বাঞ্চলের এই ভয়াবহ বন্যায় শুধু সোনাগাজীর নবাবপুর ইউনিয়নেই ভেঙেছে শতাধিক ঘর। কিন্তু, এসব ঘর পুনর্নিমাণে সরকার বা বেসরকারি কোনো মাধ্যম থেকেই উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জহিরুল আলম জহিরও।
তাহেরুন্নেসারা যখন গত বছরের বন্যার ধকল কাটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন তখন আবারও বন্যায় ডুবেছে ফেনী। এমন প্রেক্ষাপটে বার বার আলোচনায় আসছে, বন্যার্তদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তোলা টাকা গেলো কোথায় সেই প্রশ্ন।
এই টাকার হিসাব চাইতে বাংলাভিশনের পক্ষ থেকে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির বর্তমান মূখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লার সঙ্গে। কিন্তু, ফোনে এবং হোয়াটসঅ্যাপে কল ও মেসেজ দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
সেই সময়ে ত্রাণ কার্যক্রমের নেতৃত্বে দেখা গেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক এবং বর্তমান বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদারকেও। তার সঙ্গেও যোগাযোগ করে বাংলাভিশন। ওই টাকায় অন্য জেলায় ত্রাণ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া সব হিসাব রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। কিন্তু, প্রমাণ দেখতে চাইলে একদিন সময় চান বাকের। তার দেওয়া সময়ে বার বার কল এবং মেসেজ দেওয়া হলেও সাড়া দেননি তিনি। একদিন পর ২৮ জুন বিকালে কয়েকবার কল করলে তিনি ফোন রিসিভ করে গুরুতর অসুস্থ বলে জানান। অসুস্থতার কারণে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই দাবি করে সুস্থ হলে যোগাযোগ করবেন বলে জানান।
কিন্তু, এই ফোনালাপের কয়েক ঘণ্টা পরই টিএসসি এলাকায় মিছিলে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় আবু বাকের মজুমদারকে। এরপর ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাকে বার বার কল এবং মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ত্রাণ কার্যক্রমের অগ্রভাগে থাকা তৎকালীন আরেক সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম প্রথমে সাড়া দিলেও বন্যার টাকার হিসাবের কথা বলার পর আর সাড়া দেননি।
বন্যার্তদের জন্য তোলা টাকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে সেই সময় একটি সিএ ফার্মকে দিয়ে এই টাকার অডিট করানো হয়। সেই সিএ ফার্মের কাছে প্রতিবেদন চাইতে গেলে সমন্বয়ক লুৎফর রহমানের অনুমতি লাগবে বলে জানানো হয়। কিন্তু, বার বার ফোন করলেও লুৎফর কল ধরেননি।
তবে, একাউন্টে স্বাক্ষরকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. মাহ্ফুজুর রহমান খান বাংলাভিশনকে একটি হিসাব দিয়েছেন। যাতে দেখা যায়, সেই সময় তহবিলে জমা পড়েছিল ১১ কোটি ৬৯ লাখ ৮৪ হাজার ৪২০ টাকা। যার মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রমসহ আনুসাঙ্গীক ব্যয় করা হয় মাত্র ১ কোটি ৭৮ লাখ ৩৩ হাজার ২০৭ টাকা। বাকি ৯ কোটি ৯১ লাখ ৫১ হাজার ২১৩ টাকা রাখা হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নামে খোলা একটি ব্যাংক হিসাবে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হলে ৮ কোটি টাকার একটি চেক প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে জমা দিয়ে দেন ছাত্র নেতারা। প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে ৮ কোটি টাকা জমা দেওয়ার পর অবশিষ্ট থাকা ১ কোটি ৯১ লাখ ৫১ হাজার টাকার মধ্যে ১ কেটি ৯০ লাখ ৯৮ হাজার টাকা শেরপুর, জামালপুরসহ উত্তর বঙ্গের বন্যা দুর্গত জেলাগুলোর প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ব্যবহার না হওয়ায় ১৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা আবার ফেরত দিয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা। এই হিসাবমতে বর্তমানে ১৯ লাখ ১১ হাজার ২৪২ টাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে খোলা ওই একাউন্টে রয়েছে।
সোনাগাজী উপজেলার ৯ নং নবাবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহিরুল আলম জহির বাংলাভিশনকে বলেন, আমার উপজেলার ৫টি গ্রামই নদীবেষ্টিত। তাই বন্যায় আমাদের এখানে বেশি ক্ষতি হয়েছে। রাস্তা, ঘাট, ব্রিজ-কালভাটতো নষ্ট হয়েছেই শতাধিক ঘরবাড়িও বিধ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু, বন্যার সময় তাৎক্ষণিক যে খাদ্য সহায়তা এসেছিল তার বাইরে পুনর্বাসনে তেমন কোনো সহযোগিতাই পাইনি। সরকারও দেয়নি কোনো বেসরকারি সংস্থাও দেয়নি। এক বছরের মধ্যে শুধু সেনাবাহিনী ৩টি ঘর তুলে দিয়েছিল। ছাত্ররা যে টাকা তুলেছিল সেগুলো থেকে কিছু দিলেও আমরা অনেকের পুনর্বাসন করতে পারতাম। বন্যা দুর্গতদের জন্য তোলা কোনো টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একাউন্টে ফেলে না রেখে তাহেরুন্নেসাদের মতো বন্যায় বিপর্যস্ত মানুষদের পুনর্বাসনে ব্যবহার করার দাবি জানান তিনি।
বিভি/পিএইচ
মন্তব্য করুন: