হাসিনার কার্যালয়ের কর্মকর্তাসহ ৪ আওয়ামী সুবিধাভোগী হলেন জেলা প্রশাসক

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের কর্মকর্তাসহ ৪ আওয়ামী সুবিধাভোগীকে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। গতকাল বুধবার মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-২ শাখার উপসচিব আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এই নিয়োগ দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনার কার্যালয়ের সাবেক উপপরিচালক ও বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ সোলাইমানকে চাপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব মিজ আফছানা বিলকিসকে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব মিজ মনিরা হককে ফেনীর জেলা প্রশাসক, ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামকে চট্রগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন হওয়া কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চাপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন হওয়া মোহাম্মদ সোলাইমান আওয়ামী সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন। চাকরি জীবনের শুরুতেই সহকারী কমিশনার থাকা অবস্থায় তাকে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যানের সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে পদায়ন করে আওয়ামী লীগ সরকার। পরে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মাত্র ৬ মাস মাঠ প্রশাসনে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলে আসেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপপরিচালক হিসেবে। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপের নামে প্রায় তিন কোটি টাকার সুবিধা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যান। সেখান থেকে ফিরে যোগদেন শিল্প মন্ত্রণালয়ে। ২০২৪ সালে পদায়ন নেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক হিসেবে। অর্ন্তবর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর আওয়ামী সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তাকে রাজউক থেকে সরিয়ে সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের একটি প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়। মাত্র আড়াই মাস দায়িত্বপালন করার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে বিদ্যুৎ বিভাগে পদায়ন নেন।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন হওয়া মিস আফছানা বিলকিস ছিলেন আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন সাবেক পানি সম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের সাথে বিশেষ সখ্যতা থাকায় তার সাথে একই মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন ৫ বছর। কবির বিন আনোয়ার মন্ত্রিপরিষদ সচিব থেকে অবসরে যাওয়ার পর তাকে এইচটি ইমামের স্থলাভিষিক্ত করে শেখ হাসিনা। এ ছাড়াও এই কর্মকর্তা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, চট্টগ্রামের হাটহাজারি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জাতীয় সংসদের সহকারী সচিব হিসেবে কাজ করেছেন।
ফেনীর জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের উপসচিব মিস মনিরা হককে। এই কর্মকর্তা পালিয়ে যাওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠ থেকে দীর্ঘ ৫ বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করেছেন। ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩০ জন পর্যন্ত সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সংবেদনশীল ইমিগ্রেশন শাখায় কাজ করেছেন।
এ ছাড়াও মনিরা হক গাজীপুরের সহকারী কমিশনার, মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি), ফেনীর সিনিয়র সহকারী কমিশনার, পরশুরামের উপজেলা নির্বাহী অফিসার, পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করেছেন।
চট্রগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামকে। সাইফুল ইসলাম আওয়ামী শাসনামলে অর্থ বিভাগ, বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, একই জেলার সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে কাজ করেছেন।
আওয়ামী সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তা ফেনীর জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেই এক আওয়ামী লীগ নেতার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন। ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের এম সাখাওয়াত হোসেন খান ২০২৩ সালে কাতার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। তার আগে থেকেই তিনি আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এই খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জেলাজুড়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
চট্টগ্রাম জেলার জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে এর আগে ফেনী জেলার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামকে। মোখলেসুর রহমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব থাকাকালে দুর্নীতির মাধ্যমে জেলা প্রশাসক ফেনীর পদ বাগিয়ে নেন কট্টর আওয়ামী পরিবারের এ কর্মকর্তা। শেখ হাসিনার দোসর হওয়ায় যথাসময়ে পদোন্নতি পেতে ও ভালো ভালো পোস্টিং পেতে তার কোন সমস্যা হয়নি। এই কর্মকর্তা বিশিষ্ট আওয়ামী দোশর শায়লা ফারজানা এর অধীনে মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন এবং দীর্ঘদিন অর্থ বিভাগে চাকরি করেন এ কর্মকর্তা। শায়লা ফারজানার ঘনিষ্ঠ এ আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা হওয়ায় আইএমএফ এ ইকোনোমিক এনালিস্ট পদে লিয়েনে নিয়োগ পান। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে সরকার তার লিয়েন বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি করে। পরে তদবিরবাজ এ কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেসুর রহমানের আশির্বাদে জেলা প্রশাসক ফেনী হিসেবে পদায়িত হন।
অদ্য ১৫ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মাদারীপুর ও ফেনী জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক পদায়ন করেছে। বিতর্কিত ও আওয়ামী পরিবারের কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক পদে পদায়িত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কী উদ্দেশ্য সাধন করতে চায়?
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: