দানবীর কালিপদ মজুমদার পাননি শহীদ স্বীকৃতি
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও মানবিক ও উদার মনের মানুষ বগুড়ার কাহালু উপজেলার জমিদার কালিপদ মজুমদার পাননি শহীদের স্বীকৃতি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনে বর্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হন শিক্ষানুরাগী দানশীলতা ও মানবসেবী এই মানুষটি। এতোদিনেও রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা না পাওয়ায় আফসোসের শেষ নেই কাহালুবাসী তথা বগুড়াবাসীর। তাদের প্রশ্ন- হতাশার দীর্ঘশ্বাস আর কতো দীর্ঘ হলে কালিপদ মজুমদারের শহীদ স্বীকৃতি মিলবে? বগুড়া থেকে আব্দুর রহিমের রিপোর্ট।
বগুড়ার কাহালু উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে এক সময়ের জমিদার কালিপদ মজুমদারের বাড়ি। শিক্ষানুরাগী দানশীলতা ও মানবসেবা ছিল তার ব্রত। প্রজার সংকটকালে খুলে যেত তার ধানের গোলা। প্রতিদিন সকালে জমিদার বাড়ির অন্দর মহলের পুকুরে স্নান ও মন্দিরে পূজা সেরে দাতব্য চিকিৎসালয়ে বসতেন জমিদার কালিপদ মজুমদার। দশ গ্রামের রোগীরা আসতেন ওষুধ নিতে। রোগের বিবরণ শুনে তিনি ওষুধ দিতেন। তার এই চিকিৎসা সেবাদানের কথা যুগ যুগ ধরে মনে রেখেছেন এলাকার মানুষ।
কাহালু উচ্চ বিদ্যালয়টি তার জমির উপরই স্থাপিত। তিনি দীর্ঘদিন এই বিদ্যালয়ের অবৈতনিক প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। দানশীলতার জন্য এলাকার দীন-দুঃখী মানুষের কাছে তিনি সাক্ষাৎ "রাজা হরিশ চন্দ্র" ছিলেন। প্রজাহিতৈষী মানব দরদী এই মানুষটির প্রবল আত্মবিশ্বাস ছিল। ১৯৭১ সালের ২২এপ্রিল, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বগুড়া শহরের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের দিন শহরের বহু মানুষ সেদিন কাহালু থানার বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নেন।
কাহালু রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত লক্ষ্মীপুর, পালপাড়া, তেলান গ্রামে শহরের অবস্থাপন্ন বেশ কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। সেদিন স্থানীয় দুর্বৃত্ত শ্রেণির মানুষ শহরে মিলিটারি ক্যাম্পে খবর পৌঁছায়, (তখন রাজাকার গঠন হয়নি) ঐ গ্রামগুলো আক্রমণ করলে বহু মূল্যবান লুটের মাল পাওয়া যাবে। এ জন্য পাক্ মিলিটারিরা ঐ গ্রামগুলোর উপর বর্বর আক্রমণ চালায়।
সেদিন ৫ মে সকাল ১০টা হবে। বগুড়া স্টেশন থেকে তিন কর্ম্পাটমেন্ট বোঝাই সৈনিক বহনকারী স্পেশাল ট্রেন কাহালু স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। এ খবর পৌঁছে কাহালু স্টেশনের অবাঙ্গালী স্টেশন মাস্টারের কাছে। ঠিক ঐ সময় কাহালু স্টেশন প্লাটফর্মে ও বাজার এলাকায় শহর থেকে যাওয়া বহু ছাত্র-যুবক ঘোরাঘুরি করছিল ও আড্ডা দিচ্ছিল। খবর শোনামাত্র তারা নিরাপদ স্থানের দিকে দৌড়াতে থাকে। ট্রেন স্টেশনে থামতেই মিলিটারিরা ট্রেন থেকে নেমেই তাদের লক্ষ্যস্থল লক্ষ্মীপুর, পালপাড়া তেলান গ্রামের দিকে বৃষ্টির মত গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগুতে থাকে।
কাহালু স্টেশন থেকে কয়েক মিনিটের পথ। মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই লক্ষ্মীপুর, পালপাড়া, তেলান গ্রামে ঢুকে পড়ে পাকবাহিনী। তাদের গোলাগুলিতে বহু মানুষ হতাহত হয়। ঐ গ্রামগুলোর বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেয়া শহরের অনেক পরিবারের স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে তারা। ফিরে যাবার সময় পাকসেনারা ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্মীপুর জমিদার বাড়ি থেকে চিরকুমার কালিপদ মজুমদারকে আটক করে নিয়ে যায়। পথিমধ্যে তারা আরো কয়েকজনকে আটক করে। যাবার পথে কাহালুর শিতলাই গ্রামের পাথারে তাদেরকে গুলি করে ফেলে রেখে যায়।
মানবতাবাদী দানশীল শিক্ষানুরাগী জমিদার কালিপদ মজুমদার আকাশের নীচে তার জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত জমির উপর রক্তের শয্যায় চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে যান। স্বাধীন বাংলাদেশে তার রেখে যাওয়া জায়গার উপর ১৯৭৩ সালে স্থাপিত হয় কাহালু ডিগ্রী কলেজ। শুরুতে অনেকের প্রস্তাব ছিল কলেজটির নামকরণ "শহীদ কালিপদ মজুমদারের" নামে করা হোক। কিন্তু তাদের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন পাওয়া যায়নি। ভাগ্যহত এই জমিদারের জায়গার উপর শুধু কলেজ নয়, স্কুল, মাদ্রাসাও গড়ে উঠেছে। কাহালু বন্দরের হাট বাজার তারই জায়গার উপর গড়ে উঠেছে।
এতো কিছু অবদানের জন্য এই দানশীল মানবিক মানুষটির কথা বলতে গিয়ে আজো কাহালুর কিছু কৃতজ্ঞ মানুষের চোখ পানিতে ভরে যায়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্যাগের ইতিহাসে অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের জমিদার কালিপদ মজুমদারের মানবিক ও দানশীলতার কথা বলতে যেয়ে অশ্রু ভারাক্রান্ত হলেন কাহালু উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট লিয়াকত হোসেন। তিনি বলেন, "বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৩ সালে আমরা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা মিলে জমিদার কালিপদ মজুমদারের জায়গার উপর কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করি। সেসময় আমার ব্যক্তিগত প্রস্তাব ছিল কলেজটি শহীদ কালিপদ মজুমদারের নামে করা হোক। কিন্তু আমার প্রস্তাবটির পক্ষে সমর্থন মেলেনি।" স্থানীয় সাংবাদিক ও কাহালু প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোঃ সাইফুল ইসলাম দাবী করলেন, "সরকার নতুন করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকার উদ্যোগ নিয়েছে। এবার সেই তালিকায় যেন কালিপদ মজুমদারের নাম থাকে। কাহালু উপজেলায় তার স্মরণে দৃষ্টি নন্দন স্মৃতি সৌধ করা হোক।"
এই মানুষটির জন্য স্থানীয়ভাবে কেউ কোথাও কিছু করেছে কিনা ? তা অনুসন্ধানে পাওয়া গেল - কাহালু উচ্চ বিদ্যালয়ে তিন কক্ষের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ "শহীদ কালিপদ মজুমদারের" নামে করা হয়েছে। ২০০০ সালে কালিপদ মজুমদারের জমিদার বাড়ির উঠানে তার নামে সংস্কৃতি কলেজ করা হয়েছে। কিন্তু এখনও চোখে পড়ার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। তবে কাগজে-কলমে এই কলেজের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২শতাধিক। কলেজের অধ্যক্ষ প্রশান্ত কুমার পাল আফসোস করে বললেন, "কাহালুতে কালিপদ মজুমদারের জায়গা জমির উপর অনেক কিছু গড়ে উঠলেও তার নামে বড় কিছু হয়নি। তার নাম স্মরণীয় করার জন্য আমরা বগুড়া অঞ্চলে একমাত্র সংস্কৃতি (কাব্যতীর্থ) কলেজ স্থাপন করছি।"
মন্তব্য করুন: