দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ড. রেজা খানের ১০ প্রস্তাবনা

বন্যপ্রাণী দিবসে দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ১০টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন বন্যপ্রাণী, চিড়িয়াখানা ও সাফারি বিশেষজ্ঞ দুবাই সাফারি পার্কের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল ওয়াইল্ডলাইফ স্পেশালিস্ট ড. রেজা খান। এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণের মাধ্যমে, বাংলাদেশ আরও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে যেখানে বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ হবে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশগত ভারসাম্যে অবদান রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সোমবার (৩ মার্চ) বিকালে বাংলাদেশ বন বিভাগ আয়োজিত বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবসের আলোচনা সভায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে এইসব প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। ড. রেজা খানের দেওয়া প্রস্তাবনাগুলো হলো-
১. একটি জাতীয় বন্যপ্রাণী নীতি প্রতিষ্ঠা করুন
সরকারের উচিত একটি বিস্তৃত জাতীয় বন্যপ্রাণী নীতি তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা যা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, সুরক্ষা এবং টেকসহ ব্যবস্থাপনার জন্য স্পষ্ট কৌশল রূপরেখা দিবে। এই নীতিতে আবাসস্থল সংরক্ষণ, মানব-বন্যপ্রাণী সংঘাত, শিকার, অবৈধ বন্যপ্রাণী বাণিজ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন মোকাবেলা করার ব্যবস্থাপনা থাকবে।
২. একটি স্বাধীন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন
বন বিভাগ থেকে আলাদা একটি স্বায়ত্তশাসিত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ বা ওয়াল্ডলাইফ উইং গঠন করা উচিত, যা কেবলমাত্র বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং সুরক্ষার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে। এই বিভাগের পর্যাপ্ত তহবিল, বিশেষজ্ঞ কর্মী এবং বনাঞ্চল এবং অ-বনাঞ্চল উভয় ক্ষেত্রেই নির্ধারিত জমি এবং তার এখতিয়ারসহ শক্তিশালী প্রয়োগকারী ক্ষমতা থাকা একান্ত জরুরি।
৩. বন্যপ্রাণী অপরাধের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ জোরদার করা
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২" এর সংস্কার এবং কঠোরভাবে প্রয়োগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অবৈধ বন্যপ্রাণী বাণিজ্য রোধ, চোরাশিকার বিরোধী টহল, জরিমানা এবং নজরদারি বৃদ্ধি জীববৈচিত্র্যের আরও ক্ষতি রোধে সহায়তা করবে।
৪. বন্যপ্রাণী শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি
প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, এবং মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সব স্কুল, মাদ্রাসাস, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকে একটি বিষয় হিসেবে প্রবর্তন করুন। সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সব কয়টি বিভাগীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি কলেজে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করুন। বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে শিক্ষিত করার জন্য টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া এবং কমিউনিটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেশব্যাপী সচেতনতামূলক প্রচারণা পরিচালনা করুন। জাতীয় টেলিভিশনে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উপর একটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে যাতে প্রত্যন্ত গ্রামের দর্শকবৃন্দ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতেন হতে পারেন।
৫. সম্প্রদায়-ভিত্তিক সংরক্ষণ প্রচার করুন:
বন্যপ্রাণী সম্পদের উপর নির্ভরতা কমাতে ইকো-ট্যুরিজম, বনায়ন কর্মসূচি এবং বিকল্প জীবিকা নির্বাহে স্থানীয়সম্প্রদায়কে জড়িত করুন।
বন্যপ্রাণী রক্ষা করে সম্প্রদায়গুলি উপকৃত হয় এমন প্রণোদনা-ভিত্তিক সংরক্ষণ কর্মসূচি প্রতিষ্ঠা করুন।
৬. সুরক্ষিত এলাকা এবং বন্যপ্রাণী করিডোর শক্তিশালী করুন:
বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা সম্প্রসারণ এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করুন। নিরাপদ অভিবাসন এবং জিনগত বৈচিত্র্য নিশ্চিত করার জন্য বন্যপ্রাণী করিডোর তৈরি এবং পুনরুদ্ধার করুন।
৭. এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার আর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সাথে সহযোগিতা চুক্তি করুন:
ডবলিউ, ডবলিউ-এফ, আইইউসিএন এবং অন্যান্য সংরক্ষণ সংস্থার সাথে অংশীদারিত্ব, দক্ষতা, প্রযুক্তি এবং আর্থিক সহায়তা আনতে হবে। অন্যান্য দেশ থেকে সেরা সংরক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। দেশীয় বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করুন তাদের সি.এস.আর ফান্ড/সামাজিক দ্বায়বদ্ধতা ফান্ড থেকে টাকা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ খাতের প্রকল্প গ্রহনে।
৮. বন্যপ্রাণীর জন্য জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন:
উপকূলীয় বন্যপ্রাণীকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে রক্ষা করার জন্য ম্যানগ্রোভ পুনরুদ্ধার প্রকল্প বাস্তবায়ন করুন।
আবাসস্থল ধ্বংস রোধে বন্যপ্রাণী-বান্ধব কৃষি ও নগর উন্নয়ন নীতিমালা তৈরি করুন।
৯. গবেষণা ও প্রযুক্তির ব্যবহার প্রচার করুন:
জনসংখ্যার প্রবণতা এবং হুমকি মূল্যায়নের জন্য বন্যপ্রাণী গবেষণা, পর্যবেক্ষণ এবং তথ্য সংগ্রহে বিনিয়োগ করুন।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার জন্য জিপিএস ট্র্যাকিং, ক্যামেরা ট্র্যাপ এবং ড্রোনের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার খুবই দরকার।
১০. নাগরিকদেরকে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করুন:
স্বেচ্ছাসেবক, নাগরিক বিজ্ঞান/সিটিজেন সাইন্স এবং শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সংরক্ষণ উদ্যোগকে উৎসাহিত করুন।
বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তুলুন যেখানে ব্যক্তিরা আহত বা পাচার হওয়া প্রাণীদের বিষয়ে সংবাদ সরবরাহ করতে পারবেন।
তবে, অনেক বাঁধা-বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও, বন্যপ্রাণীকে বিপন্ন বা বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য উপরের ১০টিপদক্ষেপগুলি খুবই সময়পোযোগি।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রাণীগুলোকে প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে আমরা ময়ূর পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছি। সাফারি পার্কে ময়ূর অবমুক্ত করা হয়েছে, এবং প্রকৃতিতেও তাদের ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে। মধুপুর শালবনে নতুন করে ১৫০ একর এলাকায় প্রকৃতিবান্ধব বনায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য আমাদের গর্বের বিষয়, কিন্তু একইসঙ্গে এটি নানা হুমকির মুখে রয়েছে। তবে আশার বিষয়, ইতিবাচক অনেক পরিবর্তনও ঘটছে। একটি সুসংবাদ দিতে চাই—আমাদের বন অধিদপ্তরের জন্য নতুন ৩৬০টি পদের অনুমোদন দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এটি আমাদের বন সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষার প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করবে।
উপদেষ্টা বলেন, মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হাতির করিডোর তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, আগামী মাস থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে।
তিনি আরও জানান, এ বছর আমরা বহু মেছোবিড়াল উদ্ধার করেছি, এবং প্রথমবারের মতো ‘মেছোবিড়াল দিবস’ পালন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে জনসচেতনতা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
উপদেষ্টা বলেন, বন্যপ্রাণীর সুরক্ষায় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা কেবল বন্যপ্রাণী ফিরিয়ে আনাই নয়, তাদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থলও নিশ্চিত করতে চাই। প্রকৃতি, বন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে মানুষের সচেতনতা ও অংশগ্রহণই আমাদের মূল শক্তি।
বন অধিদপ্তর এর প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সচিবের রুটিন দায়িত্বে) মো. খায়রুল হাসান প্রমুখ।
বিভি/এসজি
মন্তব্য করুন: