• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

দিনে-দুপুরে পুকুরচুরি, আঙ্গুল উঠছে রাজউকের দিকেও (ভিডিও)

প্রকাশিত: ১৮:৪৬, ১ জুন ২০২৩

আপডেট: ১৭:৪১, ৫ জুন ২০২৩

ফন্ট সাইজ

গত ৪ এপ্রিল। ভয়াবহ আগুন লাগে রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটে। মুহূর্তে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় হাজারো ব্যবসায়ীর সাজানো স্বপ্ন। পানির সংকটে সেদিন অগ্নিনির্বাপনে বেশ বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। বঙ্গবাজারে দীর্ঘ ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে জ্বলেছিল আগুন। পুড়ে ছাই হয় একাধিক মার্কেট, ঝুঁকিতে ছিল পুলিশ সদর দফতরও। 

সেসময় দিশেহারা হয়ে হেলিকপ্টারে করে পানি আনতে হয় হাতিরঝিল থেকে। তবে সেদিনের আগুন নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা রাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক ছাত্রাবাসের পুকুরটি। তখন আরও জোরালো হয় ঢাকার জলাশয় রক্ষার দাবি।মাটি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে ডিআইটি পুকুর

একদিকে অগ্নিঝুঁকি আরেকদিকে তীব্র তাপপ্রবাহ ও বায়ুদূষণের শীর্ষে ঢাকা। যার সবটি মোকাবিলায় অগ্রনী ভূমিকা জলাভূমির। তাই ঢাকাবাসী যখন জলাশয় বাড়ানোর দাবিতে সোচ্চার ঠিক তখন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা খোদ পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায়ই চলছে জীবন্ত পুকুরের হত্যাচেষ্টা।

রাত হলেই ট্রাকভর্তি মাটি এনে পুকুরে ফেলা হচ্ছে এমন খবর ও ভিডিও পেয়ে ২৭ মে শনিবার বিকেল থেকেই গেন্ডারিয়ার ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকায় অবস্থান নেয় টিম বাংলাভিশন। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হয়নি, কারণ এখন দিনেই চলছে পুকুরচুরি। পুকুরপাড়ের একটি গ্যারেজের ভেতর দিয়ে একের পর এক মাটি এনে পুকুরের এক কোনায় ফেলছিলেন শ্রমিকরা। মাটি ভরাটের জন্য গাছের গুড়ি ফেলে দেওয়া হয়েছে বেড়িও। পুকুর ভরাটের পুরো চিত্র ফুটে উঠেছে বাংলাভিশনের ক্যামেরায়। যদিও এখনো এই পুকুরের মালিক রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক। তবে ভরাট করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

স্যাটেলাইট থেকে নেওয়া পুকুরটির ২০০১ সাল ও ২০২২ সালের চিত্র। এই চিত্রই বলে দিচ্ছে ২১ বছরে কতটা কমেছে পুকুরটির আয়তনশুধু মাটি ফেলে পুকুর ভরাটই নয়, একইসঙ্গে চলছিল ভরাটকৃত অংশে স্থাপনা নির্মাণের কাজও। প্রথমে ক্যামেরা দেখে পালালেন এসব কাজের তত্ত্বাবধানে থাকা কয়েকজন যুবক। তবে কিছুক্ষণ পর সাফাই গাইতে এলেন মাহবুব নামের একজন মধ্যবয়সী। প্রতিবেদককে দিলেন নানান প্রলোভন, তারপর রমজান নামে আরেকজন এসে দিলেন মামলায় ফাঁসানোর হুমকি। দাবি করলেন, রাজউক নয় জমির মালিক জাকির হোসাইন নামের একজন।

মোবাইল নম্বর নিয়ে কল করা হয় তাকে। উচ্চ আদালতের রায়সূত্রে এই পুকুর নিজের বলে দাবি করেন জাকির। কিন্তু প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও ড্যাপ অনুযায়ী ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর হলেও সেটি ভরাট করা দণ্ডণীয় অপরাধ। এই আইন সম্পর্কে বলা হলে ভরাটের কথা অস্বীকার করেন মি. জাকির। যদিও তখনো একে একে মাটি পড়ছিল পুকুরের পানিতে। পাড়েই চলছিল নির্মাণকাজ। তিনি দাবি করেন, পুকুর ভরাট নয় আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘর সংস্কারের কাজ চলছে। কিন্তু স্যাটেলাইট ও স্থানীয়দের তথ্য বলছে, পুড়ে যাওয়া ঘরটিও নির্মাণ হয়েছিল পুকুর ভরাট করেই। এখন নতুন করে ঘর নির্মাণের নামে আবারও চলছে পুকুর ভরাট।

এবার যাচাইয়ের পালা। প্রথমে ২০০০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই পুকুরের স্যাটেলাইট চিত্র সংগ্রহ করি আমরা। এতে দেখা যায়, ২০০০ সালের টুইটুম্বুর পুকুরটিতে দখল শুরু হয় ২০১৭ সাল নাগাদ। গত ৬ বছরে পুকুরটির প্রায় অর্ধেক ভরাট হয়ে গেছে। এতে গড়ে উঠেছে মার্কেট-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বেআইনি জায়গায় নিজের অফিস বসিয়ে যা পোক্ত করেছেন খোদ স্থানীয় কাউন্সিলর সাহানা আক্তার। ক্যামেরার সামনে কেউ কথা বলতে রাজি না হলেও স্থনীয় একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, জাকিরকে সামনে দেখিয়ে দখল করছেন পুকুরটি সাহানার বাবা সাবেক কাউন্সিলর সাইদুল ইসলামই (শহিদ চেয়ারম্যান)।

পুকুরের জমিতে ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়

আদালতের নথি যাচাই করে দেখা যায়, ১৯৬৪ সালে রাজউকের অধিগ্রহণ করা এই জমির মামলায় স্থানীয় নৌশাদ আহমেদ চৌধুরী গং-এর কাছে বিচারের সব স্তরে হেরেছে সরকারি সংস্থাটি। যদিও পরিবেশবাদীদের অভিযোগ ইচ্ছে করেই মামলায় হেরে জনগণের জমি প্রভাবশালীদের বুঝিয়ে দিচ্ছে রাজউক। আর আইনজীবীরা বলছেন, জমির মালিক হলেও আইন অনুযায়ী জলাধার ভরাটের সুযোগ নেই মালিকদের। 

এ বিষয়ে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বাংলাভিশনকে বলেন, যেই পুকুরটি নিয়ে আজ আলোচনা হচ্ছে। এখানে রাজউকের একটি আবাসন প্রকল্প (ডিআইটি প্রকল্প) রয়েছে। এই আবাসন প্রকল্পের মাঝেই পুকুরটির অবস্থান। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে এই পুকুর নাকি একটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি। রাজউকের সাথে নাকি আইনগত লড়াই করে তারা হেরেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো রাজউকের প্রকল্পের ভেতরে কিভাবে ব্যক্তিগত জমি থাকে। কিভাবে নিজেদের প্রকল্পের ডিজাইন করা প্রপার্টি রাজউক হারে আমাদের কাছে এটি বিষ্ময়কর মনে হয়েছে। আমরা দেখেছি রাজউকের বড় এই প্রকল্পে বেদখল শুরু হয় ২০১৭ সালে। ২০১৭-১৮ সালে ধাপে ধাপে মাটি ফেলা হয়। ২০২০ সালের শেষের দিকে কিছু মার্কেট নির্মাণ হয়, কাউন্সিলরের কার্যালয়ও নির্মাণ হয়। 

তিনি আরও বলেন, পুরান ঢাকায় এমনিতে পুকুর কম। এই পুকুরটির তিন-চার কিলোমিটারের মধ্যে আর কোনো পুকুর নেই। এই অবস্থায় সেখানকার অগ্নি নিরাপত্তার জন্য, তাপপ্রবাহ কামানোর জন্য, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের একটি পুকুর খুবই প্রয়োজন। আমি মনে করি রাজউকের যারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তাদের একটা রিল্যাকটেন অবস্থা নিশ্চয় আছে। নয়লে এটি এভাবে দখল হয়ে যেত না। এখনো প্রশাসন চাইলে এটি উদ্ধার করতে পারে। এখনো রাজউক জলাধার আইন বা ভূমি ব্যবহার আইনেও এটির অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারে।

ডিআইটি পুকুরের বর্তমান চিত্রপরিবেশ বিষয়ক আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও জলাধার সংরক্ষণ আইন দুইটা আইনেই সুস্পষ্ঠভাবে বলা হয়েছে পৌরসভা বা শহরগুলোতে যেসকল পুকুর আছে সেগুলো কোনোভাবেই ভরাট করা যাবে না। আরেকটা নির্দেশনা আছে , জাতীয় স্বার্থে যদি হয় সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আইন থাকা সত্ত্বেও আমরা দেখেছি ঢাকা শহরে অনেক পুকুর ভরাট হয়েছে এবং বিভিন্ন শহরে হচ্ছে। আমরা একটি মামলা করেছিলাম বরিশালের ঝাউতলা পুকুর নিয়ে। সেখানেও প্রাইভেট পার্টি এটার মালিকানা ওরা ভরাট করছিল। সেখানেও মালিক আরগুমেন্ট করেছিল এটা আমার ব্যক্তিগত জমি আমি ভরাট করতে কেন পারবো না। কিন্তু আদালত এখানে বলেছে, জমির মালিক হলেও পুকুর সে ভরাট করতে পারবে না। এটা আইনের মূল কথা। সুতারাং এই পুকুরটি যে ব্যক্তি মালিকানা দাবি করে ভরাট করা হচ্ছে সেটার কোনো সুযোগ নেই। এবং রাজউক যদি হারেও সেটা টাইটেলের মামলা, জমির মালিকানার মামলা। কিন্তু এখানে কে হারলো কে জিতলো সেটা বিষয় না। বিষয় হলো, ব্যক্তি বা রাজউক কেউই পুকুর ভরাট করতে পারবে না এটা আমাদের আইনের সুস্পষ্ঠ নির্দেশনা।

তবে ইচ্ছে করে জমি হারানো এবং বেআইনিভাবে পুকুর ভরাট বন্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে রাজউক কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি কেউই। এক পর্যায়ে চেয়ারম্যানের নির্দেশে তার পরিবর্তে সংস্থাটির ভূমি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য নুরুল ইসলাম কথা বলবেন জানিয়ে পরদিন দুপুর ৩টায় আসতে বলেন। 

কিন্তু পরদিন যথা সময়ে গেলেও নানান অযুহাতে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান নুরুল ইসলাম। তবে অন্য প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানালেও রাজউকের এস্টেট ও ভূমি-১ শাখার পরিচালক কামরুল ইসলাম দাবি করেন, রাজউক হারলেও এখনো জমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় ভরাট বা দখলের কোনো সুযোগ নেই মালিকদের।

এদিকে আইন অমান্য করে পুকুর ভরাটের বিষয়টি রাজউক বা কেউ আগে জানায়নি দাবি করে পরিবেশ অধিদফতরের ঢাকা মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মামুন মিয়া বলেন, আমি বিষয়টি আপনার মাধ্যমে জানলাম। আমি আমাদের এনফোর্সমেন্ট বিভাগে জানাবো। আমরা পুকুরটি রক্ষায় কি করা যায় সেটি অবশ্যই চেষ্টা করবো।

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন: