• NEWS PORTAL

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

গ্যাল্ভেস্টোন সি বিচের নোনাজলের বালুকাবেলায় জেলিফিসের কান্না

লুৎফর রহমান রিটন

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

আপডেট: ১১:৪০, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ
গ্যাল্ভেস্টোন সি বিচের নোনাজলের বালুকাবেলায় জেলিফিসের কান্না

ছবি: ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন-এর ফেসবুক থেকে

সমুদ্র আমার ভীষণ প্রিয়। প্রিয় তার গর্জন ও তার ফেনায়িত ঊর্মিমালার আছড়ে পড়ার ভঙ্গি, সৈকতে। 
পায়ের পাতায় সমুদ্রের নোনা জলের হুমড়ি খাওয়ার মধ্যে এক ধরনের ভালোবাসার স্পর্শ থাকে। আদর থাকে। সেই ভালোবাসার ছোঁয়ায় আমি শিহরিত হই।

অবশেষে সমুদ্রের নোনাজল ও ঊর্মিমালার সংগে দেখা হলো বহুদিন পর, হিউস্টনে এসে। এখানকার গ্যাল্ভেস্টোন সি বিচে গিয়ে কাটিয়ে এলাম আস্ত একটা দুপুর। গলফ অব ম্যাক্সিকো বে-র হাইওয়ের ব্রিজ অতিক্রম করার সময় ব্রিজের দুইপাশে বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় অন্যরকম একটা অনুভূতি হলো। আমাদের পদ্মা সেতুও তো এরকমই, তবে কি না আরো অভাবনীয় তার বিশালত্ব। 

এখানকার সৈকতে এখানে সেখানে থোকা থোকা মানুষের উপস্থিতি থাকলেও একটি জটলা থেকে আরেকটি জটলা ঠিকঠাক মেন্টেইন করছে সোস্যাল ডিস্ট্যান্সিং। নদী আর ডেভিড একটা পোর্টেবল তাঁবু নিয়ে অসেছে। সেটা ফিট করা হলো সৈকতে। দিনটা রোদ ঝকঝক। বাতাসের তীব্রতা মোটামুটি থাকলেও গরমের তাপ সহ্য করা কিছুটা মুশকিল। বিশেষ করে আমাদের মতো কানাডার শীতার্ত জনগোষ্ঠীর জন্যে। তাঁবুটা তাই রোদের হুংকার থেকে ভালোই রক্ষা করলো আমাকে ও শার্লিকে। যদিও সূর্যের আল্ট্রা ভায়োলেট রে থেকে রক্ষা পেতে শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে সানক্রিম এস্তেমাল করা হয়েছে। 

কতোদিন পর সমুদ্রের কাছে এলাম। কানাডা থেকে কিনে আনা আমার ও শার্লি’র স্পঞ্জের স্যান্ডেল জোড়া (নদী যার নাম দিয়েছে রূপসা হাওয়াই চপ্পল) সৈকতে ফেলে রেখে বালুকাবেলায় হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম নোনাজলের আছড়ে পড়া তীরে। তীব্রতা কমিয়ে সদ্য আসা একদল ঢেউ হামলে পড়লো পায়ের ওপর- কতোদিন পরে এলে!

আমি বললাম--অই ব্যাটা কতোদিন পরে এলাম মানে? আমি তো এর আগে আসিইনি তোর কাছে! তুই কি চিনিস আমাকে? 
-- চিনি তো!
-- একদম বানিয়ে বলবি না। আমি বারবার গেছি শুধু কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। অন্য কোন সমুদ্রে কি গেছি?
-- গেছো। ম্যাক্সিকোতে গিয়েছিলে। 
-- তা গিয়েছি কিন্তু সমুদ্রে নামিনি তো! নেমেছি বটে বহুবার, কিন্তু সেটা কক্সোবাজারে।
-- আরে বোকা তুমি কি জানো না, পৃথিবীর সব সমুদ্রই এক। তোমরা মানুষেরা শুধু একেক জায়গায় সুবিধেমতো আমাদের নাম দিয়েছো পালটে! সেই কারণেই বলেছি- তোমার সংগে আমার দেখা হয়েছে আগেও। 

গলফ্‌ অব ম্যাক্সিকোর গ্যাল্ভেস্টোন বিচে এবার হাঁটুজলের বেশি গভীরে যাওয়াই হলো না। ঝাঁপাঝাঁপিও করা হলো না। কারণ কোভিড নাইন্টিন। কোভিডের বিচিত্র সব হ্যাপা সামলাতে হয় এখন ট্রাভেলরদের। যাওয়া এবং আসার পথে এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর বাহাত্তর ঘণ্টার মেয়াদে নতুন করে কোভিড টেস্ট করিয়ে তার নিগেটিভ রিপোর্ট সংগে নিয়ে তবেই বিমানে চেপে বসার সুযোগ। আমার আবার ঠান্ডা এলার্জি। সমুদ্রে ঝাঁপাঝাঁপি করে ঠান্ডা লাগিয়ে বসলে কোভিড টেস্টে নিগেটিভ হওয়ার আগেই হ্যাঁচ্চো শুরু হয়ে গেলে তো আর ফেরাই হবে না কানাডায়! সুতরাং বাড়তি সতর্কতা হিসেবে নো ঝাঁপাঝাঁপি ইন সমুদ্র জলরাশি।

বহুদিন পরে সমুদ্রে এসে শার্লি’র তো অস্থির অবস্থা! সে কী রকম চঞ্চলা কিশোরীর মতো আচরণ শুরু করেছে। বারবার করে সে তার বাবার স্মৃতিচারণে মেতে উঠছে- আব্বা আমাকে কক্সবাজার নিয়ে গিয়েছিলো। আব্বার সংগে সমুদ্রে গিয়ে কতো আনন্দই না করেছিলাম। আজ আমার কেবল সেই স্মৃতি মনে পড়ছে। 

আমি বললাম, খালি তোর আব্বার সংগে সমুদ্র ভ্রমনের স্মৃতিই মনে পড়লো তোর! আমি যে নিয়ে গেলাম তোকে সেইটা মনে নাই!
শার্লি মাথা ঝাঁকায়- নিয়ে গিয়েছিলি নাকি! কৈ মনে নেই তো!
আমি বুঝে গেলাম, পৃথিবীতে মেয়েরা শুধু বাবার স্মৃতিই যত্ন করে মনে রাখে।  

০২
সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার ব্যাপারটা ঘটে খুব দ্রুত। 
কিছুক্ষণ আগে যেখানে ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে এখন সেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেশ দূরে। ফলে সিগালগুলোকে ঝিনুক-শামুকসহ ওদের খানাখাদ্যের সন্ধানে দ্রুত পদক্ষেপে দৌড়ুতে হচ্ছে আরো গভীরে। 
ঠুকড়ে ঠুকড়ে খুঁটে খাচ্ছে সিগালরা সমুদ্রের উপহার সামগ্রী।

সহসা আমার চোখে পড়লো তীরের দিকে রোদের একটা চকচকে ঝিলিক। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি ঢেউয়ের সংগে ভেসে আসা একটা জেলিফিস আটকে আছে সমুদ্রের বালুতে। ঢেউ তাকে তীরে রেখেই নেমে গেছে গভীরে। জেলিফিসটা পরবর্তী ঝাপটায় চলে যাবে ভেবেছিলো, কিন্তু পরবর্তী ঝাপটাটা এই অব্ধি আর আসেইনি! সুতরাং বিপজ্জনক জায়গায় আটকা পড়েছে বেচারা। এখন তার সামনে দুই দুইটা বিপদ দণ্ডায়মান।
এক- জলহীন শুকনো খটখটে বালুতে রোদের তীব্রতায় শুকিয়ে মরার সম্ভাবনা। 
দুই- সিগালদের ঠোক্কড়ে ছিন্নভিন্ন হবার সম্ভাবনা।
 
দুইটারই ফলাফল নিশ্চিত মৃত্যু। মনে হলো কাঁদছে জেলিফিসটা। 

দুই দুইটা বিপদের মুখে বালুতে লেপ্টে থাকা ট্রান্সপারেন্ট জেলিফিসটার অবয়বে আমি মুজিব পরদেশীর চেহারাটা ভেসে উঠতে দেখলাম যেন বা- আমি বন্দি কারাগারে আছি গো মা বিপদে...। 

মুজিব পরদেশী ডিজলভ হয়ে সেখানে আবদুল জব্বার ভেসে উঠলো- বিদায় দাও গো বন্ধু তোমরা এবার দাও বিদায়/মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে যেতে চায়...। 

জেলিফিস নাকি বিষাক্ত হয় খুব। এক মুঠো বালুসমেত আমি জেলিফিসটাকে তুলে নিলাম ডান হাতের মুঠোর মধ্যে। দূর থেকে নদী চিৎকার করে সতর্ক করলো আমাকে- বাবা এগুলোতে হাত দিচ্ছো কেন খুব বিষাক্ত তো!

সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমি জেলিফিসটাকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম সমুদ্রের হাঁটুপানির গভীরে। এতোক্ষণ ধরে কোনো এক দুষ্টু কিশোরের পাল্লায় পড়েছে ভেবে বেচারা জেলিফিসটা হয়তো ভীত সন্ত্রস্ত ছিলো- এই বুঝি মেরে ফেললো এই বুঝি মেরে ফেললো- কিন্তু যখনই আমি ওকে সমেত হাতটা ডুবিয়ে দিলাম সদ্য আসা ঢেউয়ের জলরাশিতে তখন মনে হলো ওর আনন্দ আর ধরে না। সে তার ছোট্ট শরীরের চারপাশ নাচিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে মিলিয়ে গেলো গালফ্‌ অব ম্যাক্সিকোর অনন্ত জলরাশিতে।
নোনাজলে মিলিয়ে যাবার আগে ট্রান্সপারেন্ট জেলি ফিসটা তার মখমল নরোম শরীর দুলিয়ে যে ডান্সটা করলো সেইটাকে অনায়াসে 'গুডবাই ডান্স' নাম দেওয়া যায়। 

গুডবাই জেলিফিস। বি হ্যাপি।

হিউস্টন, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

প্রবাসী সাহিত্যিক, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন-এর ফেসবুক থেকে

বিভি/এসডি

মন্তব্য করুন: