ট্রাম্পকার্ড জাপা না জামায়াত ?

নির্বাচনের আরো মাস পাঁচেক বাকি থাকলেও ভোটের নানা মেরুকরণ ও সমীকরণ চলছে পুরোদমে। আর সেখানে বড় দুদলের কাছেই ট্রাম্পকার্ড জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলাম। জিএম কাদের ও রওশান এরশাদের মাধ্যমে জাতীয় পার্টি বোল দিচ্ছে দু'দিকেই। আর নিবন্ধন থাক, না থাক জামায়াতের চাহিদা আছে। স্বৈরাচার-রাজাকার নামে গালমন্দ দেয়া দল দুটিকে কাছে পেতে বড় দু’দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রতিযোগিতা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। গত নির্বাচনে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিল।
এবার নির্বাচনে বিএনপি একটি নতুন ধরনের মেরুকরণের কথা বলছে। সবগুলো রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব আগেভাগেই দিয়ে রেখেছে বিএনপি। বিএনপির কড়া চোখ জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশের দিকে। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হলে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে জাপার বা জামায়াত যুক্ত হলে ভোটের অংক অন্যরকম হবে এ বিশ্বাস অনেকেরই। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মহাজোট গঠন করে জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়েছিল। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের হিসাব আলাদা। তার আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছিল, জাতীয় পার্টি আলাদাভাবে নির্বাচন করেছিল। আবার ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামায়াত আলাদাভাবে নির্বাচন করেছিল। জাতীয় পার্টিও আলাদাভাবে নির্বাচন করেছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিল।
নিবন্ধন না থাকলেও জামায়াত তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠন নীরবে বিস্তৃত করেছে। অন্যদিকে ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পার্টনার হওয়ার পর থেকে জাতীয় পার্টির গণভিত্তি দুর্ল হয়েছে। হালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের জানিয়ে আসছেন, তারা আগামীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গী হচ্ছেন না। তবে রওশন এরশাদ এর বিপরীত। এসবের মধ্য দিয়ে জাপার ভঙ্গুর দশা অনেকটা স্পষ্ট।
গত ১৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পর রওশন এরশাদ নতুন করে নড়াচড়া দিচ্ছেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, জিএম কাদের যেভাবে কথাবার্তা শুরু করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে তিনি বিএনপির সঙ্গে জোট করবেন। পরে বিএনপির কয়েক নেতার সঙ্গে সাবেক বিএনপি নেতা জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর দেশের বাইরে বৈঠকের গুঞ্জন রটে। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এ ধরনের বৈঠকের কথা অস্বীকার করা হলেও রাজনৈতিক সচেতনরা যা বোঝার বুঝে নিচ্ছেন। এছাড়া জিএম কাদের ভারত থেকে ঘুরে আসার পর তার সফর ঘিরে এক ধরনের কৌতূহল আছে। জামায়াত নিয়েও কৌতুহল আছে। তবে তাদের অবস্থান অনেকটা পরিস্কার ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে জামায়াতের গোপন মিতালির গুঞ্জনের মাঝেও বর্তমান সরকারের অধীনে কোনোভাবেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন ইসিতে নিবন্ধন না থাকা জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের। নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার ছাড়া জামায়াত কোনো নির্বাচনে যাবে না বলেও গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন তিনি। জামায়াতে সংস্কারপন্থি বা সংস্কারবিরোধী বিভাজনও কমে এসেছে। গত ১০ই জুন জামায়াত ঢাকায় সমাবেশের অনুমতি পেয়েছিল। এ নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। পরে আর সমাবেশের অনুমতি পায়নি।
জামায়াত রাজনীতিতে নিষিদ্ধ নয়, নির্বাচনে নিষিদ্ধ। জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের একটি গ্রুপ নিজেদের সংস্কারপন্থী ও স্বাধীনতার পক্ষের তথা একাত্তরের আগে-পরে জন্ম নেয়া দাবি করে ২০২০ সালের ২ মে ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’-এবি পার্টি নামে একটি দল গঠন করে। তাদেরকে নিবন্ধনের প্রাথমিকে উৎরে দিয়ে আবার বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। এ নিয়ে আদালতের শরনাপন্ন হয়েছে এবি পার্টি। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি-বিডিপি নামে জামায়াতের একটি গ্রুপ। সময় দৃষ্টে তাদের এসব ভাগ-বিভাগ কেটে যেতে সময় লাগবে না। উল্লেখ্য ১৯৭৯ সালে দেশের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের নির্বাচনী অভিষেক। তবে, তা ইসলামিক ডেমোক্রেটিকের ছদ্মাবরনে। ওই নির্বাচনে জেতেন জামায়াতের ৬ জন। পরে গোলাম আযম বাংলাদেশে ফিরলে ১৯৭৯ সালের মে মাসে গঠন হয় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। ভারপ্রাপ্ত আমীর করা হয় আব্বাস আলী খানকে।
ওই সময়টায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমান্তরালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে। নানা কায়দাকানুনে বৃহৎ দু’দল ও ৩ দলীয় জোটকে ফলো করে এগিয়ে যায় অনেক দূর। আওয়ামী লীগের পিছু নিয়ে ছিয়াশিতে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে ১০ আসনে জিতে পুরোদমে মিশে যায় সংসদীয় রাজনীতির স্রোতে। আবার ওই সংসদ থেকে পদত্যাগ প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে পেছনে ফেলে ১৯৮৭ সালের ৩ ডিসেম্বর পদত্যাগ করে জামায়াত। এরশাদ পতনের পর বিএনপির সঙ্গে নেপথ্য বোঝাপড়ায় একানব্বইর সংসদ নির্বাচনে ১৮ আসনে জিতে অবস্থান আরো পোক্ত করে জামায়াত । সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন জুগিয়ে দুটি সংরক্ষিত আসনও নেয়। এর বছর কয়েকের মাথায় চলে যায় বিএনপির বিরুদ্ধে। কেয়ারটেকার সরকার ফর্মুলা নিয়ে আন্দোলনের মাঠ গরমে নেমে বাড়তি নজর কাড়ে। আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট না হলেও বিএনপির বিরুদ্ধে ত্রিদলীয় লিঁয়াজো কমিটিভুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শরীকানা নেয়। তবে, নির্বাচনের মাঠে একা একা সাফল্য পায়নি। ছিয়ানব্বইর নির্বাচনে সংসদে সিট নেমে আসে মাত্র ৩টিতে। এরপর আওয়ামী লীগ বিরোধী হয়ে আবার মিত্রতা বিএনপির সঙ্গে। ২০০১ সালের নির্বাচনে হয়ে যায় বিএনপির জোটসঙ্গী। ১৭ সিটে জিতে দুই মন্ত্রীত্ব নিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতায়। জামায়াতের রাজনীতিতে অবিশ্বাস্য ধস নামে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার পর থেকে।
শুরুতে তাদের ভাবনায়ই আসেনি আওয়ামী লীগ সরকার ৭১ এর যুদ্ধাপরাধের এ বিচার করবে বা করতে পারবে বলে। অল্পতেই এদের ভাবনায় ছেদ পড়ে। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদসহ শীর্ষনেতাদের মৃত্যুদণ্ড, মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ও সাবেক আমির গোলাম আযমের আজীবন কারাদণ্ড জামায়াতের রাজনীতিতে সিডর বইয়ে দেয়। এর মাঝে আবার ইসিতে দলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু, দলটি নিষিদ্ধ হয়নি। হাল বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন হলেও জামায়াত এমন ভোগান্তি সয়ে অভ্যস্ত। পেছন থেকে তারা কাদের গ্রীন সিগন্যাল পেয়েছে এখনো অস্পষ্ট। তবে, রাজনীতির বাজারে এ নিয়ে নানা কথা চাউর আছে। এমন অবস্থার মাঝেও তাদের আয়ত্ব করে রাজনৈতিক সমীকরণ মেলাতে চায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দলই। জামায়াত এ ক্ষেত্রে বেশ সাবধানী। যে সাবধানতায় যেতে পারছে না জাতীয় পার্টি।
লেখকঃ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলাপোষ্ট
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
মন্তব্য করুন: