• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

কুরআনি চরিত্রমালার জীবন্ত প্রতীক মুহাম্মদ (সা.)

নাসির উদ্দিন

প্রকাশিত: ১৫:১৮, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

ফন্ট সাইজ
কুরআনি চরিত্রমালার জীবন্ত প্রতীক মুহাম্মদ (সা.)

উত্তম চরিত্র ও সদাচরণের কারণে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে সবাই বিশ্বস্ত, সত্যবাদী বলে সম্বোধন করতেন। তিনি তাঁর জীবনে কখনো কোনো মিথ্যা বলেননি। তাই মক্কার কাফেররা পর্যন্ত তাঁকে আল-আমিন মানে বিশ্বাসী বলে ডাকতো। নবী মুহাম্মদ (সা.) এর ধৈর্যের কোনো কমতি ছিলো না।তাঁর মতো সাহসী মানুষ পৃথিবীতে নেই। আল্লাহপাক তাঁকে সুন্দর চরিত্র দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সব কাজই হয়েছে কোরআন মতে। কোরআনের মধ্যে যা আছে নবীর জীবনিতেও তা আছে। 

মুহাম্মদ (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে আয়েশা (রা.) বলেন,‘তাঁর চরিত্র ছিল আল-কুরআন।’ অর্থাৎ কুরআন মজিদে যে সকল উত্তম চরিত্র ও মহান নৈতিকতার উল্লেখ রয়েছে সে সবই তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। কুরআনের বর্ণিত চরিত্র অপেক্ষা উত্তম চরিত্র আর কী হতে পারে? তিনি ছিলেন পবিত্র কুরআনি চরিত্রমালার জীবন্ত প্রতীক।

মুহাম্মদ (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে আল্লাহপাক কোরআনে বলেন, “নিশ্চয়ই আপনি এক মহান চরিত্রের অধিকারী।” (সূরা ক্বালাম:৪) “হে মুহাম্মদ! আমি তোমাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।” (আম্বিয়া:১০৭)।

“আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সর্তককারীরূপে প্রেরণ করেছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা উপলব্ধি করে না।” (সূরা সাবা:২৮)

তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আল-আহজাব: ২১)

আল্লাহপাক নিজে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা করেছেন। চিন্তা করুন যিনি এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আমাদের সৃষ্টি করেছেন, সেই মহান আল্লাহ নিজে পবিত্র কুরআনে মহানবী (সা.) এর চরিত্রের প্রশংসা করেছেন। ঠান্ডা মাথায় একটু ভাবুন কেমন ছিল আমাদের নবীর চরিত্র যে, স্বয়ং আল্লাহ তাঁর প্রশংসা করেছেন। 

রবিউল আউয়াল মাস মুসলিম উম্মার জন্য একইসাথে আনন্দ এবং বেদনার। কারণ আল্লাহপাক বিশ্ববাসীর জন্য মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-কে এই মাসে দুনিয়াতে পাঠান। আবার এই মাসে উম্মতকে এতিম করে বিদায় নেন মহানবী। অতি অল্প বয়স থেকেই আল্লাহ তাঁকে কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে নেন। জন্মের পূর্বে পিতা আবুদল্লাহ, ৬ বছর বয়সে মা আমিনাকে হারান। ৮ বছর বয়সে তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করেন। ইয়াতীম শিশু বড় হয়ে উঠেন চাচা আবু তালিবের সযত্ন ও ভালবাসায়। তিনি ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন। এরপর বিশ্ববাসীকে মুক্তি ও শান্তির পথে আহ্বান জানান। সব ধরনের কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অন্যায়, অবিচার ও দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে মানবসত্তার চিরমুক্তির বার্তা বহন করে এনেছিলেন তিনি। এরপর মহানবী (সা.) দীর্ঘ ২৩ বছর এ বার্তা প্রচার করে ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। 

মুহাম্মদ জন্ম হওয়ার সংবাদ শুনে দাদা আব্দুল মুত্তালিব ছুটে আসেন। যত্নের সঙ্গে কোলে নিয়ে কা’বার ভেতর প্রবেশ করেন, আল্লাহর হামদ বর্ণনা করেন এবং দোয়া করেন। অতঃপর তাঁর নাম রাখেন ‘মুহাম্মদ’। বিবি আমিনা গর্ভাবস্থায় স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত নাম অনুসারে ‘আহমদ’ নাম রাখেন। বাল্যকাল হতে মুহাম্মদ ও আহমদ উভয় নাম প্রচলিত ছিল। যা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে।

ইয়াতিম শিশু মুহাম্মদ, এই ভয়ে কোনো দুধ মা তাঁকে গ্রহণ করতে চাননি। কিন্তু কেউ জানতেন না আল্লাহপাক এই ইয়াতিম সন্তানের জন্য আসমান-জমিন বানিয়েছেন। এই ইয়াতিম সন্তানকে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। তাঁকে আল্লাহ হাবিব বানান। তাঁর দুনিয়াতে অভিভাবক বাবা ছিলেন না। তাঁর অভিভাবক ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ। 

দুধ মা বিবি হালিমা শিশু মুহাম্মদকে (সা.) গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করলেন যে, তার স্তন দুটি দুধে পরিপূর্ণ। তা থেকে শিশু মুহাম্মদকে দুধ পান করালেন। তার সন্তান আব্দুল্লাহকেও দুধ পান করালেন। যে বয়স্ক ও দুর্বল সাওয়ারিতে করে তারা মক্কায় এসেছেন, সে সাওয়ারী অন্যদের সাওয়ারী থেকে শক্তিশালী ও তার পালনেও দুধে ভরপুর হয়ে গেল। তা থেকে হজরত হালিমার স্বামী হারিস দুধ দোহন করে তারা উভয়ে তৃপ্তিসহকারে দুধ পান করলেন। হজরত হালিমার স্বামী তখন স্ত্রীকে বললেন, হে হালিমা! জেনে রেখো, তুমি এক মহান কল্যাণময় শিশু পেয়েছ। হজরত হালিমা বলেন,‘আমারও তা-ই মনে হয়।’ শুরু হলো শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে হালিমার পথচলা। 

মহানবীর রুহ মোবারক প্রথম সৃষ্টি করেন আল্লাহপাক। আর আকৃতির দিক দিয়ে প্রথম আদম (আ.)– কে সৃষ্টি করেন। মুহাম্মদ (সা.) রুহ জগতের সৃষ্টির মধ্যে প্রথম মানব। শারীরিকভাবে প্রথম মানব আদম (আ.)। আদম (আ.) বিয়ের মোহরানা ছিল রাসূল (সা.)-এর উপর ২০ বার দরুদ পাঠ। আল্লাহ তখন আদমকে জানিয়ে দেন শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবীর কথা। দুনিয়াতে এসে তওবা করার সময় তিনি শেষ নবীর নাম স্মরণ করলেন “ আরশেও আমি (আদম) লেখা দেখলাম: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”।

আবদুল্লাহ ইবনে সালাম ইহুদির বড় আলেম ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মদীনায় আগমনের সংবাদ শুনে তিনি হাজির হন। ৩টি বিষয় জানতে চাইলেন, যা নবী ছাড়া আর কেউ জানেন না। তা হচ্ছে কেয়ামতের প্রথম নিদর্শন কি? বেহশতবাসীদের প্রথম খাবার কী হবে? কী কারণে সন্তান পিতা-মাতার সাদৃশ্য লাভ করে? 

আল্লাহর রাসূল উত্তর দিলেন, জিবরাঈল (আ.)সবেমাত্র এ ৩টি ব্যাপারে জানিয়ে গেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) জবাবে বললেন, আগুন হলো কেয়ামতের প্রথম নিদর্শন, যা মানুষকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয়টার-বেহশেতবাসীর প্রথম খাবার হবে মাছের কলিজার সর্বোত্তম অংশ। বাকি রইলো পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সাদৃশ্যের বিষয়। তা হলো, পুরুষ যখন স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তখন যদি তার বীর্য প্রথমে বের হয়, তাহলে সন্তান পিতার আকৃতির হয়। আর যদি আগে স্ত্রীর বের হয় তাহলে সন্তান মায়ের আকৃতির হয়। আবদুল্লাহ বললেন,আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, অবশ্যই আপনি আল্লাহর রাসূল।
 
রাসূল (সা.) এর পঁচিশ বছর বয়সে মক্কার ধনবতী মহিলা খাদিজা (রা.)-এর সাথে বিয়ে হয়। মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা শুনে তিনি তার কাছে ব্যবসার প্রস্তাব পাঠান। মুহাম্মদ (সা.) রাজী হন এবং ব্যবসা শেষে অনেক বেশি লাভসহ তার সব কিছু বুঝিয়ে দেন। উভয়ের সম্মতিতে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। তখন খাদিজার বয়স ছিল ৪০ বছর। যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন রাসূল (সা.) আর কোনো বিয়ের প্রয়োজন অনুভব করেননি। এরপর আদর্শিক প্রয়োজনে এবং নারী সমাজের বিভিন্ন উপকারের জন্য তিনি মোট ১১টি বিয়ে করেন। দু’জন তার মৃত্যুর পূর্বে মারা যান। আর ৯ জনের সাথে তিনি বৈবাহিক জীবন অতিবাহিত করেন।

৪০ বছর বয়সে তিনি নবুয়ত লাভ করেন। জিবরাইল (আ.) তাঁর সামনে হেরা গুহায় এলেন এবং বললেন, পড়ুন। তিনি উত্তর দিলেন আমি কীভাবে পড়ব? ফেরেশতা বললেন, “পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে, তোমার পালনকর্তা মহান দয়ালু। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানতো না”। (সূরা আলাক: ১-৫)

৫১ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহ (স.)-কে সশরীরে ইসরা ও মি’রাজ ভ্রমণের মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়। রাসূলুল্লাহ (স.) একরাতে সাত আসমান অতিক্রম করে আল্লাহর আরশে আজীমে পৌঁছান। মি’রাজ সফরে রাসুলুল্লাহ (স.) পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান লাভ করেন। তিনি জান্নাত এবং জাহান্নাম স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন।

দশম হিজরীতে রাসুল (সা.) এক লাখ লোক নিয়ে মক্কায় হিজরত পালন করেন। মুসলমানদের উদ্দেশে  ঐতিহাসিক ভাষণ দেন এবং আল্লাহপাকের এই বাণী তিলাওয়াত করেন- “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”

রাসুল (সা.) এর জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে। যেহেতু জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে, সেহেতু মুসলিম সমাজের জন্য এটি একই সাথে যেমন আনন্দের আবার তেমনি বেদনারও। আর এই কারণেই অনেকেই এই দিনে আনন্দ উৎসব পালন করেন না এবং পালনে নিরুৎসাহিত করেন। 

মোহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুরও অনেক পরে মিলাদুন্নবীর প্রচলনে ঘটে। তাঁর জীবদ্দশায় ও সাহাবিদের সময়কালেও ঈদে মিলাদুন্নবী নামে কোনো কিছুই ছিল না। মোহাম্মদ (সা.) প্রতি সোমবার রোজা রাখতেন এবং তাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন, সোমবারে তিনি জন্ম গ্রহন করেছেন, এই দিনেই তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হয়েছেন এবং কোরআন শরীফ এই দিনেই তাঁর উপর নাজিল হয়েছে। আর সেই কারণেই শুকরিয়া স্বরুপ এই দিনে রোজা রাখতেন। সোমবার রোজা রাখা সুন্নত। আরবের মধ্যে এই রোজার খুব প্রচলন আছে। আমাদের দেশেও অনেকে রোজা রাখেন। উৎসবের চাইতে এটি অনেক বড় ফজিলতের কাজ।  
যেহেতু এই দিনে রাসুল সাঃ এর আগমন ও নবুয়ত প্রাপ্তি হয়েছে তাই আমরা চাইলেই এই দিনটাকে ঈদ হিসেবে পালন করতেই পারি। কিন্তু সমস্যা হলো এই একই দিনে আবার রাসূল (সা.) ওফাত বরণ করেন। তাহলে যেদিন আমাদের রাসুল (সা.) মৃত্যু বরন করলেন সেইদিনে কীভাবে একজন মুসলিম আনন্দ উৎসব করতে পারেন? 
তাই এই দিনে আনন্দ মিছিল ও উৎসবের আয়োজন করা একেবারেই যুক্তিহীন। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর জন্ম ও মৃত্যুদিন হিসেবে এইদিনে ইবাদত বন্দেগি করতে পারি, চাইলে রোজাও রাখতে পারি, তার জীবনি নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এইসব বিষয় নিয়ে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু আমাদের উচিত না কোনো বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করা। কেননা রাসূল (সা.) ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।

লেখক: চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন

বিভি/টিটি

মন্তব্য করুন: