বিএনপি কি নির্বাচন ঠেকাতে পারবে, না নিজেরাই ঠেকে যাবে!

উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ফরম বিক্রি শেষ হয়েছে। এখন চলছে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের টিকেট পেতে লোবিং। ফরম কেনার উৎসাহ'কে ঘিরে রাজধানীর পুরানা পল্টন থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ, গুলিস্তান, মতিঝিল, কাকরাইল এলাকায় নেতাকর্মীদের ব্যাপক ভিড় ছিল। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে হেভিওয়েট প্রার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকলেও নতুন প্রার্থীর আবির্ভাব ঘটেছে এবারের নির্বাচনে।
এই তালিকায় রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি পুলিশের সাবেক আইজিপি, বিশ্বের অলরাউন্ডার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাসহ নানা পেশাজীবীরা। যার ফলে উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল আওয়ামী লীগ অফিস ঘিরে। ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে মনোনয়ন শোভাযাত্রায় তরুণদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে তরুণ ভোটারের সংখ্যা নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে প্রায় চার কোটি। তাদের সকলের মধ্যেই প্রথম ভোট দেওয়ার যে আবেগ, যে উচ্ছ্বাস সেটিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে সারাদেশে।
শেষ পর্যন্ত যদি বিএনপি নির্বাচনে না এলেও নির্বাচন হবে বলেও মনে হচ্ছে। নির্বাচন প্রতিহত করবার মতো আন্দোলন তারা এখনো তৈরি করতে পারেনি, যা সময়ের সাথে স্পষ্ট হচ্ছে । সরকার পতনের আন্দোলন ও মহাসমাবেশের ডাক দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁরা মাঠে থাকতে পারেনি। তফসিল ঘোষণা পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ছুটি কাটাতে যাওয়াও জনমনে কৌতুহল তৈরি করেছে। মিস্টার পিটার ডি হাস নির্বাচন কমিশনার, সরকার ও সংসদের বিরোধী দলসহ বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এমনকি ডোনাল্ড লুর শর্তহীন সংলাপের আহ্বানের চিঠি পৌঁছে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের হাতে।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মার্কিনিদের পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশ ভারতের তৎপরাতেকে দেশের সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা যেভাবে মাথা ঘামিয়েছেন, তা বিস্ময়কর। মার্কিন দুতের তৎপরতায় বিএনপির প্রত্যাশার বেলুন ফুলে উঠেছিল। তাদের দাবিতে অনড় অবস্থানে থেকে হরতাল অবরোধ কর্মসূচি চলমান রেখেছে, তাতে সরকারের টনক নাড়াতে পারছে না।
যেমনটা দেখা গেছে ঢাকায় আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পদভারে চাপা পড়ে গেছে তাদের হরতাল অবরোধের কর্মসূচি। যদিও মাঝেমধ্যে চোরাগুপ্তা হামলা ও বাসে আগুন দিয়ে কে বা কারা ভীতি তৈরির চেষ্টা করছে। বিএনপিকে এর দায় দিলেও তারা সরাসরি নাকচ করে দিয়ে সরকারকে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। তাহলে এই আগুন সন্ত্রাসী কারা, কে করছে এসব? কেউ কেউ মনে করছেন নির্বাচন প্রতিহত করতে বিএনপি'র ছদ্মবেশে এই আগুন সন্ত্রাসীর কার্যক্রম জামায়াতের লোকজন চালাচ্ছে।
তাদের এই অকার্যকর কার্যকলাপ দেখে জেলা, উপজেলার সাধারণ নেতাকর্মীদের মনে ভীতি কাজ করছে। একদিকে গ্রেফতারের আতঙ্কে আছে অন্যদিকে তারা নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগছে। দলের মহাসচিবসহ প্রথম সারির নেতারা জেলে অনেকের সাজাও হয়েছে। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শুনসান নিরবতা, পুলিশ ছাড়া কেউ নেই। তালাবদ্ধ অফিস প্রাণহীনভাবেই বেশ কিছুদিন ধরে। নির্বাচন পর্যন্ত পরিস্থিতি এভাবে থাকলে হয়তোবা ভোটের দিন ভোট দিতে যাবে না বিএনপির কর্মী-সমার্থকগণ। তাতে ভোটারের উপস্থিতি কমবে। ২০১৪ সালে বিএনপি ভোট বর্জন করায় ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয় নির্বাচনকে বিতর্কীত করেছিলো। কিন্তু এবার যেন তেমন না হয় যে জন্য তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও বিএসপি তিনটি দলকে নিবন্ধন দিয়ে বিকল্প তৈরি করে রাখা হয়েছে।
বিএনপি আজকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় তাদেরকেও ১৯৯৬ সালে আন্দোলন সংগ্রাম করে আওয়ামী লীগ ঠেকাতে পারেনি। তারাও নির্বাচন করেছিলেন। আরো পিছনে তাকালে দেখা যায় ১৯৮৬ ও ৮৮ সালে জাতীয় পার্টিকেও ঠেকানো যায়নি। যদিও পরবর্তীতে এরশাদ সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার মূল কারণ ছিল শক্তিশালী দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একত্রে মাঠে নেমে আন্দোলন সংগ্রাম করেছিলেন বলে। এখনকার প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন, বিএনপি ছাড়া বাকি যে নিবন্ধিত দলগুলো আছে তাদের ৩০০ আসনে একক প্রার্থী দেওয়ার সক্ষমতা নেই। দুর্বল দলগুলোকে একসাথে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন করলেও নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। যেহেতু অন্যান্য দলগুলোর নির্বাচন প্রতিহত করার ক্ষমতা নেই, কারণ মাঠ পর্যায়ের তাদের শক্তিশালী অবস্থান নেই। সেজন্যই তারা নির্বাচনমুখী। তাদের মনোনয়ন বিক্রির প্রক্রিয়া সম্পন্ন, চলছে এখন যাচাই-বাছাই। এই মুহূর্তে যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে তাহলে দলটি নতুন আরেক চ্যালেঞ্চের মধ্যে পরবে। জোটের শরীক দলগুলো ধীরে ধীরে বিএনপির সংঘ ছাড়তে শুরু করেছেন। এই মুহূর্তে নিজেদের টিকে থাকতে হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা কার্যকরভাবে প্রতিহত করতে হবে না হলে বিএনপি একা হয়ে যাবে। তবে হঠাৎ নির্বাচনে এলে অবশ্যই এবারের নির্বাচনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হবে।
শেষমেষ বিএনপি নির্বাচনে না এলে তাহলে সংসদে প্রধান বিরোধী দল কারা থাকছেন? তৃণমূল বিএনপি না, জাতীয় পার্টি? এমন প্রশ্ন হঠাৎ জেগে উঠেছে সাধারণ মানুষের কাছে। বিএনপির অনুপস্থিতিতে আলোচনায় তৃণমূল বিএনপি। তারা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে মনোনয়নপত্র বিক্রি করছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তারা দেখা করে নিজেদের চাহিদার কথা জানিয়েছেন। তারা চায় মূল বিএনপি মাঠে না নামলে তারাই ফাঁকা মাঠে গোল দিতে। যেহেতু তৃণমূল বিএনপির জন্ম বিএনপি থেকে। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নাজমুল হুদার মৃত্যুর পরে এখন যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা একসময় বিএনপি'র শীর্ষ নেতা ছিলেন। তাদের একেবারে বিএনপি'র মাঠ পর্যায়ের নেতাদের সাথে যোগাযোগ বা পরিচিতি আছে। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নিজেদের অবস্থানে রাখতে তৎপরত।
আর জাতীয় পার্টি বর্তমানে বিরোধী দলে আছে। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে সুযোগ-সুবিধা বুঝে সিদ্ধান্ত নেবে। সরকারের এবার সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। বিএনপি নেই বলে খালি মাঠে গোল দিবে এমনটা নয়, এইজন্য তৈরি হচ্ছে তৃণমূল বিএনপি। তাই সংসদে বিরোধী দল কারা থাকছে তা এখন সময় নির্ধারণ করবে।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
মন্তব্য করুন: