নিবন্ধন বাতিল : এখন কী করবে জামায়াত?

অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ চাপকে পাশে ঠেলে আরেকটা একতরফা নির্বাচনের দিকে ধেয়ে চলছে দেশ। ধাবমান এই পথে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল খারিজ করে দেয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় জামায়াতের আপিল খারিজ (ডিসমিসড ফর ডিফল্ট) করে আদেশ দেন। জামায়াতের আপিলটি শুনানির জন্য উঠলে এ মামলায় নিয়োজিত সিনিয়র আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য ছয় সপ্তাহ সময়ের আবেদন করেন আইনজীবী মো: জিয়াউর রহমান। তবে বারবার সময় আবেদন করায় আদালত তা নাকচ করে আপিল খারিজ করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ।
আদেশের বিষয়ে জামায়াতের আইনজীবী মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং হরতালের কারণে তাদের সিনিয়র আইনজীবী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী শুনানি মুলতবি করার আবেদন দিয়েছিলেন। তার মুলতবির আবেদনটি আদালত আমলে নেননি, খারিজ করে দিয়েছেন। সেই সাথে আপিল বিভাগ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন মামলার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে যে আপিল করা হয়েছিল সেই আপিলটিও ডিসমিসড ফর ডিফল্ট হিসেবে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। ফলে তাদের আপিলটি ডিসমিসড ফর ডিফল্ট হিসেবে শুনানির জন্য কার্যতালিকায় থাকবে না। এখন কী করবে জামায়াত? এ নিয়ে তাদের মধ্যে তেমন তাড়না দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু, অনেকটা নির্ভার মতিগিতি। এর রহস্য কোথায়? নিবন্ধন বাতিল স্বাভাবিকভাবে জামায়াতের রাজনীতি বহাল থাকবে। আইনত সেই সুযোগও তারা পাবেন।
তারা বিষয়টি আবার শুনানির আবেদন করতে পারেন। তখন আদালত তা গ্রহণ করতে পারেন, নাও পারেন। জামায়াতও তা করবে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। এর আগে ১২ নভেম্বর আপিল বিভাগ জামায়াতে ইসলামীকে দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ১৯ নভেম্বর শুনানির জন্য তারিখ ধার্য করেছিলেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে জামায়াতকে বিরত রাখতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে এবং জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে রিট আবেদনকারীদের করা আবেদন শুনানিতে আপিল বিভাগ শুনানির এই দিন ধার্য করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় আপিল ও আবেদন শুনানির জন্য ওঠে। তখন আইনজীবী মো. জিয়াউর রহমানের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আবেদন (সময় আবেদন) রিফিউজ (প্রত্যাখ্যান) করছি। আপনি প্লেস (আপিল) করেন। একপর্যায়ে আদালত বলেন, আপিলকারীর অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড কোথায়? তখন মো. জিয়াউর রহমান বলেন, অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন। তিনিও উপস্থিত নেই। পরে আদালত বলেন, ‘ডিসমিসড ফর ডিফল্ট।’
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে রিট করেন সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ। একই সঙ্গে আদালত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সনদ দেন, যা পরবর্তী সময়ে আপিল হিসেবে রূপান্তরিত হয়। এ ছাড়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে একই বছর দলটির পক্ষ থেকে লিভ টু আপিল (সিপি) করা হয়। এর পর থেকে তাদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যতিব্যস্ততাও লক্ষ্য করা যায়নি।
তারা এ নিয়ে এখন কী করবে, সেই তাড়নাও দেখা যাচ্ছে না। যেন এটি কোনো ঘটনাই নয়। তাহলে রহস্যটা কোথায়?
আনুষ্ঠানিক অবস্থান না জানালেও নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের কি 'বিকল্প কোনো চিন্তা' আছে? দলের খিঙ্কট্যাঙ্করা বলেছেন, জামায়াতের নিবন্ধন থাক বা না থাক, এ নিয়ে কিছু না করে ছাড়বে তারা। কী হতে পারে সেই করনীয়টা? বিকল্প ভাবনার মধ্যে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে নাও পারে। আবার বর্জনও হতে পারে। তারা তো নতুন দল গঠনও করতে পারে। সেই আবেদন করাও আছে তাদের। স্বতন্ত্র নির্বাচনও করতে পারে। কিন্তু, কোনোটার আভাস নেই জামায়াতের পক্ষ থেকে। কোনটা করবে সেই আভাস নেই। তবে, এ ধরনের গ্যাড়াকল থেকে বের হওয়ার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে জামাতে ইসলামীর। নিষেধাজ্ঞার শিকার তারা সেই পাকিস্তান আমলে ও হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পরও হয়েছে। আবার তা উৎরেও উঠেছে। এবার কী করবে? নমুনা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু, তাদের নির্ভার-রিলাক্সভাব স্পষ্ট।
আদালতে দলের নিবন্ধন বাতিল রাখার পরও তেমন চিত্তবিকার নেই জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে। বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানে হেফাজতকে হ্যান্ডেলের বিষয়ে বড় দুই দলের মানসিকতা প্রায় কাছাকাছি। তবে, আওয়ামী লীগ পারছে শক্ত হাতে। বিএনপির তদ্দূর কুলাচ্ছে না। বাস্তবিক এ অবস্থায় বামপাড়ার দলগুলোর মধ্যেও নতুন কিছু হিসাব-নিকাশ চলছে। বাম গণতান্ত্রিক জোট মনে করে, দেশের রাজনীতিতে বিদ্যমান শূন্যতা তৈরি করতে যার সঙ্গেই হোক মাঠে তৎপর থাকতে হবে। তাই কোনো না কনোভাবে তারা কৌশলে জামায়াতকে হ্যান্ডেল করতে চায়। আবার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাহবাও নেয়।
এমন প্রেক্ষাপটে জামায়াত নিয়ে কী করবে এ ব্যাপারে এখনো কোনো ক্লু মিলছে না। জামায়াত নেতাদের দিক থেকেও সামান্যতম আভাস নেই। সেইসঙ্গে প্রশ্ন জাগছে, জামায়াতও কি এমন একটি প্রশ্নমালার অপেক্ষাই করছিল। এই আদেশের ফলে এখন জামায়াতে ইসলামী দলীয়ভাবে কিংবা দলীয় প্রতীক নিয়ে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। নেপথ্যের খবর হচ্ছে, জামায়াত আপাতত রাজনীতিতেই থাকতে চায়, নির্বাচনে নয়। আর নির্বাচন করতে চাইলে স্বতন্ত্রভাবে করতে পারবে। নতুন নামে দলও করতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন নামে সেই আবেদন তাদের করাও আছে। এমন গোলক ধাঁধার অবসানে এখন অপেক্ষাই ভরসা।
লেখকঃ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলাপোষ্ট
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
মন্তব্য করুন: