কোন এজেন্ডায় আউয়াল কমিশন?
আচ্ছা রকমের শ্বাস-নিশ্বাস কষ্টে ভুগছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নির্বাচন কমিশন। কষ্টের কথা গোপনও রাখেননি। গেল নির্বাচনের আগে এর সামান্য বললেও পানি এতো গড়ায় না। শেখ হাসিনাকেও পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয় না। দুর্গতিতে পড়ে সিইসি এখন সংবিধান আংশিক অথবা পুরোপুরি স্থগিত রাখার কথা বলেছেন। ‘নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংকটে’ উল্লেখ করে জানিয়েছেন, আলোচনার জন্যও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কমিশনের প্রধান হিসেবে পত্রিকায় লিখে জনগণকে অবহিত করেছেন। রাষ্ট্রপতি বা প্রধান উপদেষ্টার সাথে আলোচনা করেননি। গণমাধ্যমেই ভরসা খুঁজেছেন। নানা সমালোচনা চলতে থাকলেও বলা যায়, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্মরণ করে অন্তর্বতীকালীন সরকারকে সাহায্য করেছেন। লেখায় ভালো-মন্দ মিলিয়ে তার বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ এসেছে। সেই সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের বিতাড়নে তার কষ্টের কথাও জানা হয়েছে পাঠকদের। অর্ন্তবর্তী সরকারকে ‘বিপ্লবী সরকার’ অভিহিত করে তাদের শপথ নেওয়ার কথা বলেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে আগাম বৈধতা নেওয়া হয়েছে। পরে আপিল বিভাগকেই বিদায় করা হয়েছে।’ আপিল বিভাগের বিদায় যে স্বৈরশাসনকে টিকিয়ে রাখায় উচ্চ আদালতের বিতর্কিত ভূমিকা এবং নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণে ঘটেছে, তা উপেক্ষা করেছেন। আবার ‘গণ-অভ্যুত্থান কার্যকর করতে আদালতের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না’, এ কথাও লিখেছেন। লেখায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি এক ধরনের শ্লেষ রয়েছে।
‘গণ-অভ্যুত্থান একটি স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা (সেলফ এভিডেন্ট)। আইনের ঊর্ধ্বে এর অবস্থান। তবে বিপ্লবোত্তর সময়ে আইনের ঊর্ধ্বে একটি ফরমান অনিবার্যভাবে প্রয়োজন। সামরিক আমলারা তা জানেন। সুশীল আমলারা সেটা বোধ করি জানেন না।’ – লেখার এ অংশটির মাঝে আমলা হিসেবে কাদের ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা বুঝতে কোনো পাঠকের কষ্ট হওয়ার কথা নয়। হাবিবুল আউয়ালের নিবন্ধটি ছাপা হয়েছে দৈনিক সমকাল পত্রিকায়। তার চেয়েও বেশি কিছু তিনি লিখেছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে এমন কিছু বক্তব্য আছে, যা সমকাল–এ ছাপা হয়নি, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত বিপ্লবের ইতিহাস মনে করালেন তিনি। বিভিন্ন দেশে বিপ্লব ও প্রতি-বিপ্লবের ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত টেনে সম্ভাব্য প্রতি-বিপ্লবের ঝুঁকির কথাও বলেছেন। আর সেখানে লিখেছেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে এক সামরিক বিপ্লবে হত্যা করা হলো। নভেম্বরে আবারও সামরিক বিপ্লব এবং পরে অচিরেই সৈনিক-জনতার অংশগ্রহণে এক সফল প্রতিবিপ্লব।’
৩ নভেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানকে বিপ্লব ও ৭ নভেম্বরের পরিবর্তনকে ‘প্রতি–বিপ্লব’ অভিহিত করার বয়ানটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনের একটি গুরুতর বিতর্কের উৎস। একপক্ষীয় বয়ান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তার জবাব কী হবে, সেটা অনুমান করা থেকে বিরত থাকলেও প্রসঙ্গটি উত্থাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করা আবশ্যক। প্রধান নির্বাচন কমিশনার পত্রিকায় কলাম লিখতেই পারেন, সেটা তাঁর অধিকার। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বাস্তবতা মেনে পরিবর্তনের পথকে সুগম করতে পদত্যাগ না করে তিনি এমন কিছু কথা লিখেছেন, যাতে একটা রাজনৈতিক সুর আছে। সুরটির মাঝে একটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিফলনও আছে। এখনো পরিস্কার নয়, তিনি যা লিখেছেন, তা কেবল তার অভিমত, নাকি পুরো কমিশনের? তার আগে-পিছেই বা কারা আছে? তিনি ও তার কমিশন এখনও আছে কী করে, সেই প্রশ্ন ঘুরছে বিশেষ কিছু মহলে। এসব মহলের কাছে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের বক্তব্য ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত অভ্যুত্থানের প্রতি অশ্রদ্ধার প্রকাশ। প্রতি-বিপ্লবের গন্ধ খোঁজা এটি ঔদ্ধত্য। আওয়ামী লীগ সরকারের খাস পছন্দের বিচারপতিদের বিদায়ের দুঃখে তিনি সমব্যথী। একবার বলছেন এটি বিপ্লব, আবার বলছেন ‘সংসদ অসাংবিধানিকভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছে’। তার এই কথা সংসদ ভাঙার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করার পর্যায়ে।
সংবিধানের ১২৩(৩)খ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘সংসদ সদস্যদের আসনগুলো শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। এটি লঙ্ঘনের জন্য কমিশন সদস্যদের মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজার ঝুঁকি আছে।’ অথচ তিনি ও তাঁরা সংবিধানের ১১৮(৬) অনুচ্ছেদের কথা বলেন না, যেখানে বলা আছে— ‘রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন’।
আউয়াল কমিশনকে জনগণ আচ্ছা মতো চেনে। শেখ হাসিনার সরকারটিকে বার বার ক্ষমতায় আনা ও ধরে রাখার বিষয়ে তাদের অবদানও সবার জানা। এই তিনিই ২০২৪ এর নির্বাচনের আগে বলেছিলেন—‘বড় বড় রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, নির্বাচন অশুদ্ধ হবে না। নির্বাচন অবৈধ হবে না’। এখন যে আরও কতো কিছু অবৈধ হয়ে গেল! তবে হাবিবুল আউয়ালরা আছেন। আছেন বলেই মনমনন ও আকাঙ্খার জানান দিয়েছেন। তিনিসহ তার পারিষদ থাকবেন ক’দিন? বা রাখা হবে ক’দিন? মোটাদাগে সামনে চলে এসেছে প্রশ্নটি।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
বিভি/পিএইচ
মন্তব্য করুন: