শতাব্দীর সেরা মাটির সৈনিক কৃষকযোদ্ধা শহীদ জিয়া এবং আজকের প্রেক্ষাপট

কৃষকদের সাথে এভাবেই মিশে যেতেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মার্কিন মুল্লুকে দেশপ্রেমের ব্যক্তি বিতর্কে সৈনিকদের হিরো উপস্থাপিত করে, কৃষকদের খাটো করে দেখাটা মেনে নিতে পারেননি তৎকালীন কৃষিগবেষক, কবি ফ্রেডরিক সিম্পিচ।
১৯৪৩ সালের এপ্রিলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের “কৃষক তাদের খাইয়ে রাখে” শিরোনামে সিম্পিচ লিখলেন- ‘মাঠে। সেখানেই এখন আমেরিক্যান কৃষকরা, যাদের মধ্যে নারী, মেয়ে এবং স্কুলের বাচ্চারাও রয়েছেন, লড়াই করছেন। হিম, তাপ, ধুলো, খরা, কাদা, বন্যা এবং পোকামাকড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ফসল উৎপাদন করছেন। খাবার টিএনটির মতই যুদ্ধাস্ত্র। ট্যাঙ্ক এবং কামানের মতো খামারের ট্রাক্টর এবং দুধের গাড়িও যুদ্ধের অস্ত্র। যুদ্ধক্ষেত্রে কৃষকরা নিহত বা আহত হয়না, পদক দিয়ে সজ্জিত হয়না, অথবা কাদা ও তুষারে ঘুমাতে হয়না। তবুও এই মাটির সৈনিক ছাড়া সমস্ত সেনাবাহিনীকে শীঘ্রই পদত্যাগ করতে হত,কারণ এখনো সত্য যে,একটি সেনাবাহিনী তার পেটে ভ্রমণ করে।’
দেশ প্রেমের প্রতিযোগীতায় কৃষক সৈনিকের চেয়ে কোন অংশেই কম না। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে ব্রিটিশ কৃষি বিপ্লব শুরু হয়। শিল্প বিপ্লবের সময় কৃষির অগ্রগতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। আর একারনে ব্রিটিশ শিল্প বিপ্লবের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত রয়েছে ব্রিটিশ কৃষি বিপ্লব।
এশিয়া সাব কন্টিনেন্টে কৃষকদের নিয়ে ভাবনার উল্লেখযোগ্য তথ্য সম্ভার রিসার্চ করে আমরা পাই- ১৯৩৬ সালে ১১এপ্রিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের লৌখনো অধিবেশনে সর্ব ভারতীয় কৃষক সভা ( ISKS) গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়।
১৯৫৩ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় শের-ই বাংলা একে ফজলুল হকের বাসভবনে কৃষক প্রজা পার্টির কর্মীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের একটি উল্লেখ যোগ্য ঘটনা হলো, ‘তেভাগা আন্দোলন(১৯৪৬-১৯৪৮)’। এই আন্দোলনের জনক ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ। কৃষক আন্দোলন হল একটি সামাজিক আন্দোলন। কৃষি নীতির সাথে জড়িত এই আন্দোলন কৃষকদের অধিকার দাবি করে।
এদেশে কৃষক আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক সমাবেশের নাম ‘কাগমারী সম্মেলন’। ১৯৫৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী থেকে ১০ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত টাঙ্গাইল জেলার কাগমারী নামক স্হানে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে কাগমারী সম্মেলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক অধ্যায়।
এরপর স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে কৃষকরা খানিকটা ঝিমিয়ে পরে। পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন আসে। বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষে পীড়িত কৃষককুল ছিল দিকনির্দেশনাহীন, অশান্ত ও দিশেহারা। এই ক্লান্ত কৃষকদের প্রানে নতুন প্রানের আশা জাগানিয়া হয়ে দেবদূতের মত আবির্ভূত হলেন এক কৃষকবান্ধব রাষ্ট্রনায়ক।
তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অগ্রসৈনিক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেয়ে ১৯ দফা ঘোষণার সবচেয়ে যে সেক্টরটিতে তীক্ষ দৃষ্টি দিলেন, সেটি হল কৃষি ও কৃষক। কৃষকবান্ধব এই মানুষটি নিজের সুখ শান্তি পেছনে ফেলে কৃষকদের পাশে গিয়ে কোদাল কাস্তে হাতে মাটির মায়ায় মিশে গিয়ে কৃষি বিপ্লবের এক ইতিহাস গড়বার লক্ষ্যে নিজেকে দাঁড় করালেন।
সারাদেশের কৃষককুল তথা ছাত্র- জনতা নারী- পুরুষ সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ফসল উৎপাদনের লক্ষে স্বশরীরে ক্ষেত খামারে কাজ করবার একটি নতুন দিনের সম্ভাবনা ছড়িয়ে। জেগে উঠলো কৃষক।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত সারাদেশে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দেড়হাজারের বেশি খাল খনন করতে সমর্থ হলেন। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ হাজার কিলোমিটার। খুব অল্প সময়ে কৃষকের উন্নয়নে তাঁর সুচারু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কৃষি বিপ্লবের নজিরবিহীন এক অধ্যায় রচনা হতে চললো। তাঁর নিজস্ব ক্ষমতা বলে কৃষকদের জন্যে নাম মাত্র সুদে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেবার ব্যবস্হা করলেন ।
বীজ অধ্যাদেশ প্রণয়ন করলেন। কৃষি খাতে বিদেশ থেকে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি, আমদানি, চিনি ও সার কারখানা নির্মাণ, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠাসহ নানাবিধ কৃষি উন্নয়নের এক মাইলফলক অধ্যায় তৈরিতে তিনি হয়ে দাঁড়ালেন মাটির সৈনিক।
পশ্চিমা বিশ্বে নোবেল জয়ী কৃষি বিজ্ঞানী ড.নরমান বোরলোগ, ভারতে সোয়ামিনাথান যেমন সবুজ বিপ্লবের জনক, তেমনি খুব অল্পদিনে বাংলাদেশে কৃষকের ত্রাণকর্তা তথা কৃষকের জনক হয়ে দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এই অবিসংবাদিত নেতার অকাল প্রয়াণে থমকে দাঁড়ালো এদেশের কৃষক তথা কৃষিখাত।
আজকের প্রেক্ষাপটে তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরি সুযোগ্য সন্তান এদেশের ভবিষ্যত কান্ডারী তারেক রহমান পিতার অসমাপ্ত কৃষি কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে একটি স্বনির্ভর কৃষি বিপ্লবের দেশ হিসাবে দাঁড় করাবার পরিকল্পনা সত্যিকার অর্থে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় তৈরি হবে বলে কৃষি গবেষকরা মনে করছেন।
তিনি তাঁর দীর্ঘ বিদেশ জীবনে রাজনৈতিক দর্শন, রাজনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি সারা বিশ্বের কৃষিতে সমৃদ্ধ দেশ গুলোর ফসল উৎপাদনে বৈঞ্জানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের সূত্রগুলো চর্চা করে নিজেকে তৈরি করে ফেলেন।
তিনি মনে করেন, যেহেতু প্রায় এককোটি ৬৫ লক্ষ কৃষক পরিবারের ৮৪ শতাংশই প্রান্তিক,ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক।কৃষকদের জীবন- মানের উন্নয়ন ঘটাতে পারলেই কৃষিতে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। তাই দেশসেবার সুযোগ এলে তিনি কৃষকদের জন্য প্রথমেই "ফারমার্স কার্ড" চালু করতে চান। এই কার্ডে থাকবে কৃষকের নাম,জমির পরিমান ও দাগনম্বর সহ প্রয়োজনীয় সব তথ্য।সরকারি সহায়তা ও ভর্তুকি প্রদানের ক্ষেত্রে এ কার্ড ব্যবহার করা হবে,যাতে কৃষকদের ভোগান্তি লাঘব হয়।
আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ে মেধাবী শিক্ষিত বেকার যুবকদের 'এসএমই' ঋণ সহায়তা প্রদান করে সুপরিকল্পিত ভাবে ফসল উৎপাদন ও কৃষিভিত্তিকশিল্পে আত্মনিয়োগ করাতে পারলে খুব অল্প সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, রাশিয়া, ইউক্রেন, চীন, তুরস্ক, এবং ভারতের সারিতে এদেশের নাম যোগ করা সম্ভব হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
তারেক রহমানের মতে, কাঠামোগত শোষণের শিকার হয়ে প্রান্তিক কৃষকেরা ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ শোষণ থেকে কৃষককে বাঁচাতে ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, ন্যায্য বাজার ব্যবস্থাপনা তৈরি, ঋণ ব্যবস্থাপনা ও আমদানি নীতির সহজীকরণ প্রয়োজন। লোকসান ঠেকাতে সরকারের সরাসরি কৃষকের কাছ ধান ও চাল কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করা, কৃষকের ফসল বিক্রির সুবিধার্থে ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা, ফসল সংরক্ষণের জন্য কৃষি জোনভিত্তিক কমিউনিটি সংরক্ষণাগার নির্মাণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য শস্য বিমা চালু, ফসলহানি হলে ঋণ মওকুফের ব্যবস্থা করা।
স্বপ্নদ্রষ্টা তারেক রহমান তাঁর কৃষক নিয়ে ভাবনার স্তরগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে এদেশকে পেছনে ফিরে তাকাতে হবেনা। আগামীর বাংলাদেশ হয়ে দাঁড়াবে সোনা ফলার সোনার দেশ। আজ সেই মাটির সৈনিক কৃষকের নয়ন মনি শহীদ জিয়ার ৪৪ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্বপ্নের কৃষককুলের স্বপ্ন যেন বারবার মনে করিয়ে দেয় সবুজ বিপ্লবের হাতছানিকে। আর তাই শহীদ জিয়ার প্রয়ান দিবসে আমাদের শপথ হোক-
“কৃষক বাচঁলে, বাচঁবে দেশ
শহীদ জিয়ার বাংলাদেশ।”
লেখক: যুগ্মসম্পাদক, কৃষকদল কেন্দ্রীয় কমিটি
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
মন্তব্য করুন: