রোহিঙ্গা সংকটে প্রেসিডেন্ট জিয়ার কৌশলী নেতৃত্ব: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উজ্জ্বল অধ্যায়

রোহিঙ্গা সংকটে জিয়ার কৌশলী নেতৃত্ব: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উজ্জ্বল অধ্যায়
গত কয়েক দশক ধরেই রোহিঙ্গা সংকট বিষয়টি শুধুমাত্র বাংলাদেশই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও অত্যন্ত আলোচিত জটিল এক অধ্যায়। ২০১৭ সালে ফ্যাসিস্ট হাসিনার অবৈধ সরকারের সময়ে এদেশে রোহিঙ্গাদের বেআইনিভাবে গণঅভিবাসন যে এক জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী মানবিক সংকটের সূত্রপাত করেছিলো তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে এখনো এদেশ মুক্ত নয়। অথচ রোহিঙ্গাদের এই অভিবাসন ১৯৭৮ সালে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) তাঁর অসাধারণ তীক্ষ্ণ কূটনৈতিক দক্ষতায় শক্ত হাতে দমন করেছিলেন৷ তাঁর ঐ বিচক্ষণ কূটনৈতিক নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এক নতুনরূপে আবির্ভূত হয়েছিলো।
শুধুমাত্র রণাঙ্গনে একজন বীর সৈনিকের ভূমিকাই নয়, এদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পথ তৈরি করা, রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও তিনি তাঁর বিচক্ষণতা প্রমাণ করে গেছেন। তিনি এদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে স্বাধীন, ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুমুখীকরণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং তাতে যথেষ্ট সফলও হয়েছিলেন। ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে আমেরিকা, চীন ও মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে তিনি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। এই নীতির ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের এক স্বাধীন চিত্র অঙ্কিত হয়।
পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন স্টেটর উত্তরাংশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মূলতঃ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান ও আরাকানীদের সংমিশ্রণে উদ্ভুত এক জাতিগোষ্ঠী। ৭ম-৮ম শতাব্দীর দিকে উদ্ভুত হলেও মায়ানমার সরকারের মতে রোহিঙ্গারা সেখানকার অবৈধ অধিবাসী এবং একারণে ঐতিহাসিকভাবে মায়ানমারের স্হায়ী জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও তারা সকল প্রকার মৌলিক ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তথাকথিত 'অবৈধ অভিবাসী" শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে ১৯৭৮ সালের মার্চে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আরাকানে নাগরিক পুনঃনিবন্ধন অভিযান বা 'অপারেশন নাগা-মিন' (ড্রাগন কিং) চালিত হয় যার মাধ্যমে প্রায় ২লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বর্ডারে অবস্হিত জাতিসংঘের ১৩টি রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়।
যুদ্ধ-বিধ্বস্হ মহামারীতে আক্রান্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল বাংলাদেশের জন্য এটি একইসাথে চ্যালেঞ্জ ও হুমকিস্বরূপ ছিলো। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অসাধারণ কূটনৈতিক নেতৃত্বে বাংলাদেশ এই সমস্যা থেকে মুক্ত হয়েছিলো এবং রোহিঙ্গারাও মায়ানমারে ফেরত গিয়েছিলো।
রাষ্ট্রপতি জিয়া তিন স্তরে রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় কাজ করেন:
১. মানবিক সহায়তা: আশ্রয় প্রদানের পাশাপাশি খাদ্য ও চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন।
২. আন্তর্জাতিক সংযোগ: সেসময় জিয়াউর রহমান সরকারের অন্যতম সফলতা ছিল যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সম্পৃক্ত করে বিষয়টিকে বৈশ্বিক মানবিক সংকট হিসেবে উপস্হাপন করা, ঢাকা ও রোহিঙ্গাদের যৌক্তিক অবস্থান বোঝাতে পারা এবং বাংলাদেশের সাপোর্টে রাখতে পারা।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সম্পৃক্ত করে বিষয়টিকে বৈশ্বিক মানবিক সংকট হিসেবে উপস্থাপন করে জিয়া সরকার।
৩. কূটনৈতিক তৎপরতা: রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে বড় সফলতা ছিলো মায়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করানো। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মায়ানমার সরকারকে স্পষ্ট বার্তা দেন "Either you take them back or face them"। কক্সবাজারে একটি ক্যান্টনমেন্ট স্হাপন করে বলেন যে রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেয়া হলে এদেশের সেনাবাহিনী তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সহযোগিতা প্রদান করবে যেনো তারা সশস্ত্ররূপে তাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে পারে। এরই ফলস্বরূপ ১৯৭৮ সালের ৭-৯ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত মায়ানমারের জেনারেল নে উইন -এর সোশালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি-র সরকার এবং বাংলাদেশের জিয়াউর রহমানের সরকারের মধ্যে "Repartitian Agreement" নামে একটি ঐতিহাসিক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো যেখানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মায়ানমার সরকার তাদের দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলো।
সাংবাদিক Anders Corr ২০১৬ সালে Forbes ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাঁর "Opinion Secret 1978 Document Indicates Burma Recognized Rohingya Legal Residence" আর্টিকেলে লিখেছেন, “The Government of the Socialist Republic of the Union of Burma agrees to the repatriation at the earliest of the lawful residents of Burma who are now sheltered in the camps in Bangladesh on the presentation of Burmese National Registration Cards along with the members of their families …”
ফলস্বরূপ ১৯৭৮ সালের ১ আগস্ট থেকে পরবর্তী ৬ মাস ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মায়ানমার সরকার কর্তৃক গৃহীত "Hintha Project" এর মাধ্যমে রাখাইন ষ্টেটে পুনর্বাসিত হতে থাকে। ১৯৭৯ সালের ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মো. শামসুল হক পুনর্বাসন কার্যক্রম নিরীক্ষণের উদ্দেশ্যে মায়ানমার সফর করেছিলেন।
২০১৭ সালে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের অবৈধ আমলে উদ্ভূত রোহিঙ্গাদের বেআইনি অনুপ্রবেশের কারণে বাংলাদেশ যে আর্থ-সামাজিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলো তা থেকে এখনো উত্তরণ ঘটেনি এদেশের। বরং বর্তমানে এদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ যা ঘনবসতিপূর্ণ স্বল্প আয়ের বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরপ। অথচ দুঃখজনকয়কর হলেও সত্যি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় তো নয়ই এমনকি এখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ১৯৭৮-৭৯ এর ঐ দ্বিপাক্ষিক ঐতিহাসিক চুক্তির কথা তুলে ধরছেনা। ফলস্বরূপ বাংলাদেশ তো বটেই রোহিঙ্গারাও অমানবিক দুঃখ-দুর্দশা থেকে এখনো রেহাই পায়নি।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিলো। শুধু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানই নয়, তিনি বৈদেশিক চাপমুক্ত স্বাধীন আত্মনির্ভরশীল পররাষ্ট্রনীতির চর্চা করেছেন যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছিলো। তিনি ভারসাম্যপূর্ণ পরাশক্তি সম্পর্কে জোর দিয়েছিলেন। জিয়ার এই বিদেশী বলয়মুক্ত স্বাধীন কূটনীতি প্রসঙ্গে 'বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও স্বাধীনতা'—গবেষণাপত্রে ড. রেহমান সোবহান বলেন, "জিয়ার পররাষ্ট্রনীতি ছিল জাতীয় স্বাধীনতার প্রতীক, যা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান প্রদান করেছে।"
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের গণমানুষের নেতা। তাঁর মননে-চিন্তায়-কর্মে সর্বদাই 'Bangladesh First" বিষয়টির প্রভাব লক্ষণীয়। এমনকি ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে বক্তব্য প্রদানের সময় বলেন, "বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হবে স্বাধীন, অটল এবং জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করা।" আজ, ৩০মে এই মহান নেতার প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ'- আদর্শ, দূরদর্শী পররাষ্টনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা এখনো বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শিক্ষনীয়। আর তাইতো জিয়াউর রহমান-এর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিই স্বগৌরবে ঘোষণা করেছে "সবার আগে বাংলাদেশ"।
লেখক: এফ. ফিল শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ।
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: