• NEWS PORTAL

  • সোমবার, ০২ জুন ২০২৫

Drama: Jamai Bou Chor
Drama: Jamai Bou Chor

সেদিন জিয়া মরেনি, মরে গিয়েছিল একটি বাংলাদেশ

নাসির উদ্দিন

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ২৯ মে ২০২৫

ফন্ট সাইজ
সেদিন জিয়া মরেনি, মরে গিয়েছিল একটি বাংলাদেশ

১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোর। চট্টগ্রামের আকাশ ঢেকে ফেলেছিল বঙ্গোপসাগর থেকে ছুটে আসা মেঘ। সার্কিট হাউসের ছাদে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মধ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। ভোর ৪টায় সেনা অফিসাররা অতর্কিতে সার্কিট হাউজে আক্রমণ করে। তারা প্রথমে রকেটলাঞ্চার নিক্ষেপ করে। পরে গুলি করতে করতে ঝড়ের বেগে সার্কিট হাউজে ঢুকে পড়ে। 

জিয়াউর রহমান পালিয়ে থাকা মানুষ নন। তিনি গুলির শব্দ শুনে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। কি হয়েছে জানতে গোলাগুলির উৎসের কাছে চলে যান। কয়েকজন অফিসার তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। ওই সময় লে. কর্নেল মতিউর রহমান মাতাল অবস্থায় টলতে টলতে ‘জিয়া কোথায়, জিয়া কোথায়’ বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসে। পলকেই কয়েক হাত সামনে থেকে চাইনিজ স্টেনগানের গুলি চালিয়ে দেয় জিয়াউর রহমানের উপর।অন্তত ২০টি বুলেট জিয়াউর রহমানের শরীরে বিদ্ধ হয়। তোমরা কি করছো, তোমার কি করছো বলে মুহূর্তের মধ্যে কার্পেটের ওপর ঢলে পড়েন জিয়াউর রহমান। ‍তার পুরো শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। রক্তের স্রোতধারা বয়ে যায় ফ্লোরের কার্পেটজুড়ে। তিনি শহীদ হন। 

বিপথগামী সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াকে। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারাদেশের মানুষ ক্ষোভ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।অবস্থা বেগতিক দেখে সকালের আলো ফোটার আগেই তার মরদেহ সরিয়ে ফেলা হয়। ইতিহাসের নিকৃষ্ট ঘাতকচক্র পালানোর পথ খুঁজে নিতে তড়িঘড়ি করে শহীদ জিয়ার মরদেহ নেয় রাঙ্গুনিয়ার পোমরায় যা আজকের জিয়া নগর। সকালে লাশ দাফনের সময় সেনা সদস্যরা সাথে নেয় পাশের কয়েকজন গ্রামবাসীকে। অস্ত্রের মুখে তাদের হুমকি দেওয়া হয় বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য। এ কথা জানালে পরিবার পরিজনসহ হত্যারও হুমকি দেওয়া হয়। অস্ত্রের মুখে কবর খোড়া ও দাফন কাজে জড়িতদের একজন ছিলেন স্থানীয় তালেব ফকির। চট্টগ্রাম থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে রাঙ্গুনিয়ার পোমরার পাহাড়ি এলাকায় তড়িঘরি করে দাফন করা হয়েছিলো শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরদেহ। হত্যার পর ঘাতকরা মনে করেছিলো, পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলে পুতে রাখলেই দেশের মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা যাবে তাদের প্রিয় নেতাকে। 

কিন্তু, ৩১ মে সকালে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ওইদিন সকালে পাহাড়তলী চৌমুহনী বাজারে চায়ের দোকানে রুটি বানানোর কাজে ব্যস্ত ছালামত উল্ল্যাহ বদি। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো মাটি খোড়ার কথা বলে। পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলের মাটি খুড়ে তুলে এনেছিলো শহীদ জিয়ার লাশ। ‘রাঙ্গুনিয়ায় জিয়ার লাশ দাফন করা হয়েছে। তা তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’ এই দৃশ্য দেখতে উৎসুক হাজারো মানুষের মতো এসেছিলেন সেদিনের তরুণ এনামূল হক তালুকদার। তিনি জানান, তিনটি লাশ ছিলো একই কবরে।

একই কথা বলেন, প্রয়াত বিএনপি নেতা ক্যাপ্টেন ডাক্তার এম এন ছাফাও। তিনটি লাশ কবর থেকে তুলে আনা হয় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে।সবার মরদেহ ছিলো একই পলিথিনে মোড়ানো। কবরে যেভাবে ছিল, ঠিক একই অবস্থায় তাদের তুলে আনা হয়। দুপুরে ক্যান্টনমেন্টের গেইটে জড়ো হন হাজার হাজার মানুষ। জিয়াভক্ত এসব মানুষকে সামাল দিতে হিমশিম খায় সেনা সদস্যরা। 

বিকাল পৌনে ৪টায় বিমান বাহিনীর একটি বিমানে চট্টগ্রাম থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ ঢাকায় নেওয়া হয়। তার কফিনটি প্রেসিডেন্ট ভবনে আনার পর সেখানে বেগম খালেদা জিয়া, তার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকোসহ অন্য আত্মীয়-স্বজন সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখান থেকেই তারা জিয়াউর রহমানকে শেষ বিদায় দেন। জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ১৬ জনই সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার। এই দলের নেতৃত্ব দেন লে. কর্নেল মতিউর রহমান, লে.কর্নেল মাহবুব, মেজর খালেদ ও লে. কর্নেল ফজলে হোসেন। এদের মধ্যে গ্রেফতারের সময় কর্নেল মতিউর এবং কর্নেল মাহবুব নিহত হয়। জেনারেল মঞ্জুর এবং কর্নেল মতিউর রহমান যে গাড়ির বহরে পালিয়েছিলো, সেখানে ছিলেন মেজর রেজা। জেনারেল মঞ্জুর চা বাগানের এক কুলির ঘরে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে খেতে বসলো, তখন তারা হঠাৎই কুকুরের অনবরত ডাক শুনতে পান। কিছুক্ষণ বিতর্কের পর ক্যাপ্টেন এমদাদ জেনারেল মঞ্জুরের হাত-পা বেঁধে টেনেহিঁচড়ে তাকে গাড়িতে তুলে নেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে জেনারেল মঞ্জুর গণপিটুনিতে মারা যায়। 

৩০ মে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর চট্টগ্রামবাসী দাবি করে, জিয়ার স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজকে জাদুঘরে রূপান্তর করার যেখানে থাকবে প্রিয় নেতা কর্মকাণ্ডের সমস্ত অনুষঙ্গ। চট্টগ্রামবাসীর এই প্রাণের দাবি বাস্তব রূপ লাভ করে হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ একযুগ পর। সেই সার্কিট হাউজ আজ জিয়া স্মৃতি জাদুঘর যেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ আসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সমস্ত কর্মকাণ্ড একপলক দেখে নিতে, শ্রদ্ধা জানাতে।

তাকে হত্যার পর খুনিরা ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ হন। কারণ, আবদুস সাত্তার ততক্ষণে দ্রুততার সঙ্গে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সমর্থনে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে নেন। এই নাটকীয় পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দৃশ্যপটে চলে আসেন। জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে; এমন খবর শুনে তিনি অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। এর আড়াই বছর পরে আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে দলের দায়িত্ব নেন বেগম খালেদা জিয়া। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপির দায়িত্ব খালেদা জিয়া নিজ হাতে নেন ১৯৮৪ সালের ১৩ জানুয়ারি। অস্থিতিশীল এই দেশে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়। 

জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিকে মধ্যপন্থী উদার দল হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপির নীতি-আদর্শ বিবেচনা করলে দেখা যাবে, ইউরোপের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের রাজনীতির দর্শন এখানে প্রয়োগ করেছিলেন জিয়াউর রহমান।তিনি বাকশালের একদলীয় শাসনের পরিবর্তে ফিরিয়ে আনেন বহুদলীয় গণতন্ত্র। এমনকি বাকশালে বিলুপ্ত হওয়া আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেন তিনি। পাশাপাশি অন্যান্য দলকেও রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান জামায়াতকে রাজনীতি করার যেমন সুযোগ দিয়েছিলেন, তেমনি বিলুপ্ত আওয়ামী লীগকেও বাকশালের গহ্বর থেকে তুলে এনেছিলেন।

১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। ১৩ দিনের মাথায় শহীদ হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। শেখ হাসিনা তার শাসনামলে শহীদ জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের খেতাব কেড়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু, দেশের পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রায় সকল নেতাকর্মী এখন পলাতক। আর চরম দমন, নির্যাতনের মুখেও জিয়াউর রহমানের হাতেগড়া দল টিকে গেলো হিমালয়সমান বাধাকে মোকাবিলা করে। এর কারণ, জিয়াউর রহমানের নীতি ও উদারপন্থী রাজনৈতিক দর্শন। 

জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড ছিল ‘পরিকল্পিত’। বাংলাদেশকে সেবাদাসে পরিণত করার জন্য এবং পরনির্ভরশীল একটা রাজ্যে পরিণত করার জন্য সেদিন এই জাতীয়তাবাদী নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এখনো সেই ষড়যন্ত্র চলমান। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে সবুজ বিপ্লবের বাংলাদেশ।স্বপ্নদ্রষ্টা তো একজনই, যার নাম জিয়াউর রহমান। মা-বাবার আদরের কমল। সেদিন জিয়া মরেনি, মরে গিয়েছিল একটি বাংলাদেশ।

 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)

বিভি/পিএইচ

মন্তব্য করুন: