গোপন বন্দিশালায় ৯৪ দিন: ‘কবর আর ওই রুমের কোনো পার্থক্য নেই’
গোপন বন্দীশালায় ৯৪ দিন কাটিয়ে এসেছেন গাইবান্ধার ব্যবসায়ী আতাউর রহমান মণ্ডল। তিনি জানতেন না কী তার অপরাধ? তার পরিবার জানতো না তিনি বেঁঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন? তার মুখেই শুনবো কেমন ছিল তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বীভৎস দিনগুলোর বর্ণনা।
মে ২,২০১৯, রাত আনুমানিক আটটা কাজ শেষ করে আমি এবং আমার ব্যবসায়িক পার্টনার আকিজ গ্রুপে কাজ শেষ করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার জন্য দুজন উবারে কল করি।ওর বাইকটা আগে আশায় ও আগেই চলে যায় আর আমি আমার বাইকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি এবং বাইকের লোকেশন দেখতে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছি, এমন সময় একটা সাদা রংয়ের মাইক্রোবাস সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো, ভেতরে বসা একজন দরজা খুলে দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ পিছনে দুজন এসে ধাক্কা দিয়ে মাইক্রোবাসের ভিতরে উঠিয়ে নেয়। আমি অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই পরিস্থিতি থেকে ছুটে পালানোর।
অবশেষে মাইক্রোবাসে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে মাথায় একটা লম্বা ব্ল্যাক মাক্স পরিয়ে দেয়। তারপর পিছন থেকেহাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দেয় এবং জিজ্ঞেস করে তোমার নাম কি আতাউর রহমান মন্ডল, আমি হ্যাঁ বললাম। এরপর মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে চিল্লাচিল্লি করতে বাধা দেয় এবং একজন আমার পায়ের উপরে চেপে বসে। ভয়ে আমার গলা মুখ জিব্বা পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। কোন কথা বলতে পারছিলাম না। ততক্ষণে আর বুঝতে বাকি রইল না যে আমি একটা ট্রাপে পড়ে গেছি।
অনেক কষ্টে ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম তোমরা আমাকে কেন ধরেছ? উনারা কোন উত্তর না দিয়ে বলল ওখানে গেলেই বুঝতে পারবা। তারপর সমস্ত শরীর হাতাহাতি করে পকেট থেকে মানিব্যাগ, ফোন, ল্যাপটপসহ ব্যাগ, হাতের ঘড়ি খুলে নেয় এবং একজন আরেকজনকে বলতে থাকে ভালো করে চেক কর। ওতো কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ওর কাছে কোন গোপন ট্রাকার থাকতে পারে। এরপর ৩/৪ ঘন্টা শহরের মধ্যেই এদিক সেদিক, এদিক সেদিক ঘুরিয়ে রাত আনুমানিক বারোটার দিকে আমাকে মাইক্রোবাস থেকে নামায়। এরপর দুজনে আমাকে দুপাশ থেকে ধরে সামনে ডান দিকে যেতে বলে। সামনে সিঁড়ি আছে পা উঁচু করে ফেলো, এরপরে কয়েক কদম ফেলতেই একটি রুমে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে ফেলে। রুমের ভিতরে আগে থেকেই কয়েকজন অবস্থান করছিলেন।
রুমটি এসি, সাউন্ড প্রুফ এবং উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধের পারফিউম স্প্রে করা, যে গন্ধের ট্রমা এখনো আমার ভিতর থেকে যায়নি। ওই গন্ধ কোথাও পেলেই আমার শরীর ভয়ে ডরে শিউরে ওঠে। এমনকি অনেকদিন পর্যন্ত আমি কোন পারফিউমের গন্ধ সহ্য করতে পারছিলাম না। আমাকে হ্যান্ডকাপ পড়ানো অবস্থায় একটা টুলে বসিয়ে দেয় এবং ওই ব্ল্যাকহুড এর উপরে আরো একটি অনুরূপ হুডও তার উপরে আরো একটি পট্টি পরিয়ে দেয় যাতে আমি কোন কিছুই অনুমান না করতে পারি।
আগে থেকেই অবস্থান করা একজন খুব সম্ভবত ডাক্তার, সে আমার প্রেসার দেখে এবং জিজ্ঞেস করে তোমার কি কোন শারীরিক অসুস্থতা আছে? আমি বললাম আমার অনেক ব্যাকপেইন হচ্ছে সে বলল টেনশন করো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভালো করে দিব।
এরপর শুরু জিজ্ঞাসাবাদ করা, প্রথমেই বলে তোমাকে কেন এনেছি অনুমান করতে পেরেছ? আমি বললাম না। তখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করল- তুমি কি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে ওদের আইটিটিমের সাথে কাজ করো? বললাম যে- আমি ওদের ডাটা সেন্টারে কাজ করি। ততক্ষণে আমারও আর বুঝতে কিছুই বাকি রইল না।
এরপরে আমাকে বলে তুমি কোন দল কর? বললাম কোন দল করি না, তারপর বলে কোন দল সাপোর্ট করো? বললাম আমি কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই জড়িত না। এরপর বলেন, Road Safety Movement (We Want Justice) আন্দোলনের তুমি তো অনেক সক্রিয় ছিলা। ফেসবুকে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ বিরোধী অনেক পোস্ট করেছো।তখন ওদেরকে বলেছি আমি একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। কোনটা ইথিকাল আর কোনটা আনইথিকাল তা খুব ভালো করে বুঝি, এবং তা কতটুকু করা যাবে সেটাও আমার খুব ভালো জানা আছে। আমি ফেসবুকে খুবই ইররেগুলার, তখন তারা পাসওয়ার্ড নিয়ে facebook ঘাঁটাঘাটি করে, আমি তা বুঝতে পারি।
এরপর তারা অনেকভাবে আমাকে স্বীকার করানোর চেষ্টা করে যে, আমি অন্য কোন দলের সঙ্গে জড়িত আছি কি না এবং ধমকের স্বরে বলে এদেশে থাকতে হলে বাঁচতে হলে একটাই দল করতে হবে সেটাই আওয়ামী লীগ। এর বিকল্প চিন্তা করলেই শেষ। এ সময় অন্য সদস্যরা আমাকে ভয় দেখানোর জন্য গান লোড আনলোড করতে থাকে এবং বিভিন্ন লাঠির শব্দ করতে থাকে। একজন বলে ও যদি শিকার না করে তাহলে ওর গোপনাঙ্গে ইলেকট্রিক শক দাও এবং আজীবনের জন্য পঙ্গু বানিয়ে দাও। এবং বলে তুমি রিসেন্টলি ইন্ডিয়া গিয়েছিলে নিশ্চয়ই ওখানে সমস্ত ডাটা পেনড্রাইভে কপি করে তাদেরকে দিয়ে এসেছ। এরকম অনেক আবোল তাবোল ও অপ্রাসঙ্গিক কোয়েশ্চেন করে যাচ্ছিল যা আমার কাছে পাগলের প্রলাপের মতো লাগতেছিল।
তারা যে আমাকে শুধু হয়রানি করার জন্যই এনেছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না। এক পর্যায়ে আমি তাদেরকে বলি আপনারা আমাকে এরকম ভাবে ধরে আনলেন কেন আমাকে কল করে আপনাদের অফিসে ডাকলেই তো পারতেন। আমি আপনাদেরকে সহযোগিতা করতে পারতাম। এর মধ্যে একজন আমাকে বলে আমাকে কি তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে। আমি ইংল্যান্ড থেকে পড়ালেখা করে এসেছি আমার অনেক জ্ঞান আছে। তারপর ৪০/৪৫ মিনিট জিজ্ঞাসাবাদের পর আমার কাছ থেকে আমার ল্যাপটপ, মোবাইল, সমস্ত email, ফেসবুক এর পাসওয়ার্ড জেনে নেয় এবং বলে তোমাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বলে রাখি, এটিই হচ্ছে এদের টর্চার শেল/রুম তথাকথিত জিজ্ঞাসাবাদরুম।
টর্চার/জিজ্ঞাসাবাদ রুমের সাথে লাগানো উত্তর পাশের যে রুম আছে যেখানে টিভিও আছে এবং ওই রুমে অনেক কালারফুল লাইট জ্বলতে দেখেছি। ঠিক ওই রুমের সামনের (পশ্চিম সারির) রুমেই ওরা আমাকে ১০ দিন রাখে। রুমের দরজা দুইটি, একটি লম্বা রডের জেলখানার দরজার সাদৃশ্য আরেকটি সলিড কাঠের মাঝখানে ছোট একটা ভিউফাইন্ডার এর মত ফুটা আছে। যা দিয়ে বাহিরে থেকে রুমের ভিতরে দেখা যায় ভিতর থেকে বাহিরে দেখা যায় না। আমাদের দেখাশোনা করার জন্য ওদের কিছু ইমপ্লয়ী আছে। যারা আমাদেরকে খাবার ও পানি সরবরাহ করে। নামাজের ওযু, গোসল ও টয়লেটের জন্য সাহায্য করে। ওদের একজন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের রুম থেকে এই রুমে আনে। তখন রাত ঠিক কয়টা বাজে আমি অনুমান করতে পারছিলাম না। ওকে জিজ্ঞেস করলে ও বলে দেড়টা বাজে।
আমার প্যান্ট গেঞ্জি ও জুতা খুলে নিয়ে যায় এবং একটি লুঙ্গি ও টি শার্ট দিয়ে দেয়। টি-শার্টটা অনেক পুরনো লম্বা ঢিলেঢালাও ছেরা ফাটা সম্ভবত আমার মত অন্য কেউ আগে অনেকবার ব্যবহার করেছে। তিন চারদিন পরে ও আমাকে আরেকটি টি শার্ট দেয়। ওরা বলে যায় কোন কিছু প্রয়োজন হলে মানে পানি অথবা টয়লেট যাওয়ার দরকার হলে দরজার এই তালা দিয়ে জোরে জোরে শব্দ করবে তাহলে আমরা কেউ একজন আসবো।
এই রুমের সাইজ ৫ ফিট বাই ৮ ফিট আনুমানিক, দরজার উপরে এবং পশ্চিম পাশের ওয়ালে ছাদ সংলগ্ন দুইটি একজস্ট ফ্যান লাগানো আছে এবং দরজার উপর চোখ বরাবর হাই ভোল্টেজের একটি লাইট ২৪ ঘন্টা জ্বলতে থাকে। প্রস্রাব করার জন্য একটি বোতল সাদৃশ্য পট দিয়ে যায় যা ভর্তি হলে পরবর্তীতে গোসল অথবা টয়লেটের সময় সাথে নিয়ে খালি করে আনতে হয় পুনরায় ব্যবহারের জন্য। নামাজের ওযু গোসল ও টয়লেটের জন্য চারবার রুম থেকে বের করতো। এর বাইরে জরুরী টয়লেটে যেতে চাইলে লোহার দরজায় জোরের শব্দ করলে ওদের লোক এসে নিয়ে যেতে। চোখ বেঁধে হাতে হাত কড়া লাগিয়ে টয়লেটে দেওয়া হতো। তারপর হাত খুলে দেওয়া হতো।
দরজার নিচ দিয়ে তিন বেলা খাবার দিতো। সকালে শক্ত রুটি আর সবজি অথবা সেমাই। দুপুরে ও রাতে ভাত ডাল মিশ্রিত সবজি, বড় সাইজের গন্ধওয়ালা কই মাছ অথবা ডিম। সপ্তাহে ২-১ দিন মুরগি অথবা গরুরমাং স দিত। ঈদের দিনে বিশেষ খাবার পরিবেশন করতো। খাবার জঘন্য ধরনের ছিল। এই খাবারে চার ভাগের এক ভাগও আমি কোনদিন ভালোভাবে খাই নাই। চোখের পানিতে খাবার ভিজে যেত। আমার রুম থেকে হাতের ডান পাশে একই সরিতে উত্তর দিকে দুই তিনটা রুম পরে একটা লো কমোডের বাথরুম আছে। (এটিই এদের পুরাতন বিল্ডিং)
এরপর শুধু অপেক্ষার প্রহর গোনা। একদিন দুইদিন তিন দিন পার হয়ে যায় আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে ওরা আমাকে কত দিন রাখবে। কিংবা আদৌ ছাড়বে কি না।
দিন দশেক পরে ওরা আমাকে এই রুম থেকে নতুন বিল্ডিং এর একটি ছয় ফিটবাই ৮ ফিট রুমে নিয়ে যায়। রুমের ছাদ অনেক উঁচুতে এবং এখানেও ২৪ ঘন্টা একটি হাই ভোল্টেজ বাতি জ্বলতে থাকে। ওই রুমে ঢুকে আমার শরীর শিওরে ওঠে দেয়ালে তাজা রক্তের ছাপ দেখে। খুব সম্ভবত আমার আগে যে ছিল তার রক্ত। সেখানে আগে থেকেই একটি সিঙ্গেলের চেয়েও ছোট ৩x৬ ফিট লোহার খাট, একটি বালিশ, একটি কম্বল, একটি গামছা, আরেকটি নূরানী নামাজ শিক্ষার বইও প্রস্রাব করার জন্য দুইটা প্লাস্টিকের পট ছিল। পড়ার জন্য আমি বুখারীশ রীফের তৃতীয় খন্ড চেয়ে নিয়েছিলাম। এই বইটির পেজ ভাঁজ দিয়েই হিসেব করেছি বন্দি দশার দিনপঞ্জি। নতুন বিল্ডিংটি লো কমোড বাথরুমের। উত্তর পাশের গলি দিয়ে যেয়ে ওই বাথরুমের পিছনে অর্থাৎ পশ্চিম সাইডে অবস্থিত। এবং এটি তুলনামূলকভাবে একটু উঁচু। এই নতুন বিল্ডিং এর বাথরুম টাইলস করা, গোসলের জন্য ছাদে একটি শাওয়ার, একটি হাই কমোড ও একটি লো কমোড আছে।
বাথরুমের এই শাড়িতেই পাঁচটি রুম আছে যার চার নাম্বার রুমে ওরা আমাকে রাখে ।এর প্রত্যেকটি রুমেই একজন করে গুম হওয়া মানুষ ছিলেন। মাঝেমধ্যে দরজায় শব্দ করে ডাকাডাকি করত, উচ্চস্বরে কান্নাকাটি ও হাউমাউ করে চিল্লাচিল্লি করত।ওদের চিৎকারে ভয়ে ডরে জড়োসড়ো হয়ে থাকতাম, ঘুমাতে পারতাম না এবং ভাবতাম কখন যে আমার আসে।
আনুমানিক ১৫-১৭ দিন পর যখন দুপুরে গোসলের জন্য বাথরুম গিয়েছি হঠাৎ দরজা খুলে একজন একটি কালো হুড নিয়ে ঢুকে পড়লো। ও বলল তোকে ইন্টারভিউ এর জন্য নিয়ে যাব। এ বলে কালো হুডটি দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে দেয় এবং তার ওপর একটি চ্যাপ্টা মোটা ফিতা দিয়ে চোখ বরাবর বেঁধে দেয়। পিছন থেকে হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দেয় ও বলে শক্ত করে লুঙ্গি পড়ে নে, তোর আজ খবর আছে। তারপর ওই টর্চার সেলে আমাকে ৩০ মিনিটের মতো বসিয়ে রেখে ওরা ফটোশুট করে। আমি ক্যামেরার ফ্লাশের লাইট ও ক্লিকের শব্দ বুঝতে পাচ্ছিলাম। এরপর ওরা আবার আমাকে আমার রুমে নিয়ে আসে ও চোখের বাঁধন ও হ্যান্ডকাফ খুলে দেয়।
এটি ওই বিল্ডিং এর লাস্ট সারি। যা একেবারেই পশ্চিম দিকে অবস্থিত। এরপরে বিল্ডিং এর সাথে লাগানো সড়ক। যেখান দিয়ে অনবরত অটোরিক্সা চলাচল করে এবং অটোরিকশারহর্ন খুব স্পষ্টই শোনা যায়। আমার রুমে একটি ভেন্টিলেটর ছিল ছাদ সংলগ্ন। এই রুমেও অনুরূপভাবে দুইটি একজাস্টফ্যান লাগানো আছে। মাঝে মাঝে আজান খুব স্পষ্টই শোনা যেত।
পরবর্তীতে একজনের সঙ্গে একটু খাতির হলে সে আমাকে আরেকটি ব্লু কালারের টি-শার্ট ও একটি লুঙ্গি দেয়। ওই একটা টি শার্ট দুইটা লুঙ্গি দিয়েই আমার বাকি দিনগুলো প্রায় ৮৫ দিনের কাছাকাছি পার হয়ে যায়।
এখানে আমার একমাত্র সঙ্গী আল্লাহ ও বুখারী শরীফের ৩ নাম্বার খন্ড। কবর এবং ওই ঘরের মধ্যে আমি কোন পার্থক্যই খুঁজে পেতাম না। আমাদেরকে যখন দাফন করা হয় তখন থেকে পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, না থাকে কোন মোবাইল কানেকশন না থাকে ইন্টারনেট কানেকশন, নেই কোন যোগাযোগের মাধ্যম। ঠিক এর সবগুলোইআমি অনুভব করেছি ওই রুমে থাকা অবস্থায়।কোথায় বাবা-মা, কোথায় স্ত্রী সন্তান, কোথায় ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন।
আমার ওয়াইফ তখন ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট, ছোট একটা বাচ্চা আছে, বাসায় অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা-মা। সবকিছু মনে করে এক অন্ধকার কালো জগৎ এসে ভর করে। চোখে মুখে হতাশার ছাপ, বুকটা যেন এক বায়ু শূন্য খাঁচা। ভাবতাম এরকম কি মানুষের জীবনে হয়। কোনদিন একটু অন্যায় করিনি, মানুষের উপকার হয়ত কখনও করতে পারিনি কিন্তু কাউকে কখনো কষ্ট দেইনি। জীবনে কখনো থানায় পা দেয়নি। জেলখানায় যাইনি এমনকি কোর্টে যাওয়ার প্রয়োজন কখনো বোধ করিনি। আমার নামে না আছে কোন মামলা, রাজনীতিতে নেই কোন দলের সম্পৃক্ততা।
২০১৯ সালের ৪ অগাস্ট রাত দশটা, সাড়ে দশটা, সালাতুত তসবি নামাজ পড়ার সময় একজন রুমে ঢুকলেন, তার হাতে আমার ব্যাগ পরনের সেই জিন্স প্যান্ট জুতা বেল্ট আমাকে দিয়ে দ্রুত তৈরি হতে বললেন। বুঝতে পারলাম ওরা আজ আমাকে ছেড়ে দেবে, এই ভেবে একটু আনন্দ লেগেছিল, আমার পাশের ছেলেকেও ঠিক এরকম করেছিল আমি দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেরেছিলাম। আবার হঠাৎ পরক্ষণেই আবার মনে পড়ে গেল ওরা হয়তো আজ আমাকে ক্রসফায়ার দেবে।
তারপর আবারো ডাবল করে কালো হুড মাথায় লাগিয়ে ও হ্যান্ডকাপ পিছনে পরিয়ে সেই টর্চার রুমে নিয়ে গেল। সেখানে বেশ কয়েকজন বসা ছিল। আমার শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করল এবং বলল আমরা যেখানে যেখানে যাব তুমিও সেখানে যাবে। তোমাকে এক জায়গায় নামিয়ে দেবো। আমি তোমাকে কিছু ইনস্ট্রাকশন দিব এই ইনস্ট্রাকশন আগামী ১০ বছর পর্যন্ত ফলো করতে হবে। এরপর তাদের মধ্যে থেকে একজন একটি মোটাগোল লাঠি দিয়ে ওঝাদের মত করে সমস্ত শরীরে লাঠিটি চেপে চেপে ঘোরাতে থাকে এবং বোঝাতে থাকে এখানে তুমি যা দেখেছো তোমার সঙ্গে যা কিছু হয়েছে তা তুমি কাউকে বলবা না এমনকি তোমার স্ত্রীকেও বলবা না। এর যদি একটি শব্দ বাহিরে যায় তাহলে তোমাকে এবং তোমার ফ্যামিলিকে চিরদিনের জন্য মিশিয়ে দেবো। আরো অনেক ভয় ভীতি দেখাইতে থাকে কেউ আবার রিভলভার মাথায় ঠেকিয়ে দেয়। বলতে থাকে ডিনামাইট দিয়ে আমাদের বিল্ডিং উড়িয়ে দিবে।
এরপর রাত আনুমানিক ১২:৩০ দিকে আমাকে লা মেরিডিয়ান হোটেলের কাছের ওভারব্রিজের গোড়ায় নামিয়ে দেয় এবং বলে তুমি নেমে প্রস্রাবের জন্য বসবে আমাদের গাড়ির দিকে কোনোভাবেই তাকাবে না। তাকালেই তোমাকে শুট করব। তারপর আমি একটি সিএনজি করে রাত আনুমানিক দেড়টার সময় বাসায় চলে আসি।
৯৪ দিনের প্রত্যেকটা দিন অঝোরে কাঁদাতাম। শারীরিক-মানসিক সামাজিক কতই না হেয় প্রতিপন্ন হয়েছি। অনেক পরিচিত জনের বুলিং এর শিকার হয়েছি। চাকুরীর ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি। আর্থিকভাবেও এখনপঙ্গু হয়ে গেছি।
এখনো পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে ট্রমা থেকে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ওই ধরনের পারফিউমের কোন গন্ধ এখনো সহ্য করতে পারি না। শরীর সাথে সাথেই শিউরে ওঠে ভয়ে হাত পা গুটিয়ে যায়। আপনি আপনিই দীর্ঘশ্বাস চলে আসে। অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে।
এরপর তীরে এসে ডুবল তরী ।ফিরে এসে একদিন পরেই চলে গেলাম আমার কর্মস্থলে, সবার সঙ্গে দেখা হলো কথা হলো। এমডি স্যার এসে অনেকক্ষণ কথা বললেন এবং আমাকে আশ্বস্তও করলেন যে আপনি আমাদের সঙ্গেই আছেন এবং থাকবেন, আপাতত আপনি তিন চার দিন বাসায় রেস্ট করেন। এরপর ৪-৫ দিন পর আবার অফিসে গেলাম জয়েন করার জন্য তখন ম্যানেজমেন্ট থেকে আমাকে বলল আপনার জিএম হজ করতে গেছেন উনি আসলে ঠিকঠাক করে তারপর আপনি জয়েন করেন। এরপর উনি হজ থেকে আসলেন, ম্যানেজমেন্টের সাথে উনি কি বলেছেন আমি জানি না। আমাকে একটা ডিসমিস লেটার ধরিয়ে দিলেন। আমার অন্ধকার যেন আরও ঘনিভূত হতে লাগলো। এবং আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে জিএম তার শেষ খেলা খেলে দিয়েছে। আমি এখনো বিশ্বাস করি না ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তে আমার চাকরি চলে গেছে।
স্বামীকে ফিরে পেতে ২০১৯ সালের ৩ মে তেজগাঁও থানায় জিডি ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বরাবর আবেদন করেছিলেন আমার স্ত্রী তানিয়া আক্তার। এবং জাতীয় পত্রিকা গুলোতে এ বিষয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। জুলাই ৪ তারিখে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
এখন এই নতুন সরকারের কাছে আমি ন্যায্য বিচার চাই। আমার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা চাই, আমার মতো অন্য যারা গুমের শিকার হয়েছে আমার বিশ্বাস তাদের সবার পাশে নিশ্চয়ই দাঁড়াবে এই সরকার।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: