• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

যে উপায়ে পৃথিবী হবে ভূ-স্বর্গ

প্রসেনজিৎ হালদার

প্রকাশিত: ২১:২০, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৩:২১, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ফন্ট সাইজ
যে উপায়ে পৃথিবী হবে ভূ-স্বর্গ

প্রতিকী ছবি

গ্রেটা থুনবার্গের কথা আমরা ভুলে যাইনি। জলবায়ু রক্ষায় সেই কিশোরী প্ল্যাকার্ড হাতে একাই রাস্তায় নেমেছিলেন। ধরীত্রি শান্ত রাখতে এবং জলবায়ু বিপর্যয় রোধে কারও তোয়াক্কা করেনি সে। তার দাবি, বাসযোগ্য সবুজ পৃথিবী। সময় পেছনে পড়লেও অনেকের কাছে আদর্শ বিপ্লবী গ্রেটা। আজ অনেকেই তার অনুসারী। প্রকৃতি ধ্বংস করে এমন কার্যক্রম রোধে সুইডিশ এই তরুণীর পদক্ষেপ আজও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। 

বিশ্বব্যাপী বড় বড় জলবায়ু সম্মেলনে যখন দেন-দরবার নিয়ে বিতণ্ডা হয়, তখনও প্রকৃতির পরিচর্যা করেন অনেকেই। কারও নাম উম্মোচন হয়, কারও হয় না। তাই বলে, থেমে থাকে না কোন কিছুই। সৌরজগতের গতানুগতিক ধারায় চলতে থাকে পৃথিবীর পরিভ্রমণ, সঙ্গে বাস্তুসংস্থান।

দিন পার হয়, সপ্তাহ-মাস পেরিয়ে বছর শেষ হয়। এর মধ্যে কত-শত-লক্ষ-কোটি ঘটন অঘটনের সমাহার। এইতো কিছুদিন আগেই পুড়েছে লস এঞ্জেলেস, দাবানল। বিগত কয়েক যুগের তুলনায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েছে দেড় থেকে দুই ডিগ্রি। উষ্ণ মৌসুমে বিশ্ববাসী তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। 

জলবায়ু চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তা সুন্দর-সুষম রাখা মানবজাতির দায়িত্ব। কিন্তু, এই কাজ না করে উল্টো মানুষ চড়াও হয়। প্রকৃতিও বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখায়। কখনো বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস; কখনো খড়া-দাবানল-তুষারপাত-ভূমিকম্প। এতে মানুষসহ জীব-বৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য প্রাণীকূলও মারা পড়ে। কিন্তু, মানুষ ভুলে যায়, সে-ই সৃষ্টির সেরা জীব। 

গত কয়েক বছরে বিশ্বের নানা প্রান্তে বিপুল বনাঞ্চল দাবানলে পুড়েছে, ধ্বংস হয়েছে হলিউডের বিস্তীর্ণ এলাকা। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, স্পেনের মতো বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর চিত্র এই। দাবানল থামাতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে, কোন ক্ষেত্রে থামানো যায়নি। এর আগেই হয়তো হাজার হাজার একর বনাঞ্চল ভস্ম হয়েছে। ভয়াবহ বন্যায় ডুবেছে অস্ট্রেলিয়া। তাতে প্রকৃতির কোন ক্ষতি হয়েছে কী? না, বরং ক্ষতি হয়েছে জীবজগতের, বিশ্ববাসীর। একদিকে বন পুড়ছে, বাড়ছে কার্বন-ডাই অক্সাইড। অন্যদিকে, কমছে অক্সিজেনের সরবরাহ। এতে উভয়সংকটে প্রাণীকূল। যে কারণে ভবিষ্যতে ভালো কিছু আশা করার নেই, তা হলফ করেই বলা যায়। শীতকালে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা, আর গরমে ব্যাপক তাপপ্রবাহ। সকলে ভুলে যায়, এ বিপর্যয় থেকে মুক্তির একমাত্র পথ সবুজ বৃক্ষ।

বিগত কপ-২৯ সম্মেলন নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। অর্থ বরাদ্দ নিয়ে হৈ চৈ দেখা দেয়। যদিও পরবর্তীতে তা সমাধান হয়েছে। কিন্তু, জলবায়ু শান্ত রাখার পথ তো একটাই। তা হলে সবুজায়ন, বৃক্ষরোপণ। মানুষ বাদ দিয়ে আর কোনো প্রাণীকে দোষারোপ করা যায় না। কারণ, বিবেক-বিচারের অধিকার কেবল তার মস্তিস্কেই রয়েছে। যে কারণে, মানুষকে বলা হয় ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। অথচ, এরপরও মানুষই অমানুষ হয়, ধ্বংসলীলায় মাতে। বনভূমি, বৃক্ষ নিধন করে নগরায়ন-শহরায়ন-উন্নয়নের নামে ইমারত তৈরি করে। ভুলে যায়, অক্সিজেন ছাড়া গতি নেই, সবুজের বিকল্প নেই।

উন্নয়নকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সৃষ্টিশীল অনেকেই মনে করেন, ‘প্রাণ-প্রকৃতির যথাযথ সংরক্ষণই উন্নয়ন’। পর্যাপ্ত তথ্যসূত্র না থাকলেও এ সংজ্ঞার বিশ্লেষণে উন্নয়ন বলতে প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে জড়িত প্রতিটি বস্তু বা ক্ষেত্রের উন্নতি সাধনে নিয়োজিত হতে বলা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ বৃক্ষরোপণ না করে যেমন ধরিত্রী শীতল রাখার সুযোগ নেই, তেমনি অবকাঠামোর উন্নয়ন না হলেও মানুষসহ প্রাণীর আবাস নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে। যেহেতু কৃত্রিম অবকাঠামো তৈরিতে একমাত্র মানুষেরই হাত রয়েছে, আর তাই এখানে সতর্ক হওয়ারও বিকল্প নেই। উন্নয়নের নামে যদি একাধারে বৃক্ষ নিধন হয়, তবে এর খেসারত মানবজাতিকেই দিতে হবে। কখনো বন্যা, কখনো ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, প্রাণহানিও ঘটছে। যে কারণে, এখন থেকেই সুন্দর-স্বচ্ছ ভাবনার বিকল্প নেই।

অক্সিজেনের তুলনায় প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইড বাতাসে মিশে যায়। পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে সৃষ্ট বায়ুদূষণে ভারতের মতো দেশেও স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে। রাজধানী ঢাকার বাতাসের মান মোটেও ভালো নয়। দূষণ তালিকার শীর্ষেই থাকে মেগাসিটি ঢাকা। মুখোশ (মাস্ক) ছাড়া এখানে চলাচল করা কষ্ট। জাপানের মতো পৃথিবীর অনেক দেশ জলবায়ু শীতল রাখতে বড় ভবন-ইমারতে সবুজায়ন করছে। প্রতি ইঞ্চি জায়গায় লতাগুল্ম বপন করছে। উদ্দেশ্য, জলবায়ু ও পরিবেশ শীতল-শান্ত রাখা। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রও তো প্রথম সারির দেশ। সে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প অস্ত্র তৈরির কারখানা। এখনো বিশ্বজুড়ে যত কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসৃত হয় তার বেশিরভাগ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর, যেহেতু বায়ুমণ্ডল আটকে রাখা যায় না, তাই তাদের বর্জ্যের ভাগাড়ে (কার্বন-ডাই-অক্সাইড) পরিণত হচ্ছে গোটা দুনিয়া। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে পড়তে হচ্ছে বহুমুখী সমস্যায়, দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

প্রথমেই গ্রেটা থুনবার্গের কথা বলা হয়েছে। ২০১৮ সালের ২০ আগস্ট ১৫ বছর বয়সী এই কিশোরী স্কুল ফাঁকি দিয়ে একাই জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের পক্ষে কথা বলেছে, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী ও সবুজায়নের কথা বলেছে। এর আগে এবং পরে অনেক সংগঠন দাড়িয়েছে। তারা এখনো কাজ করছে। অথচ, ক্রমবর্ধমান হারেই বেড়ে চলেছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা, ক্ষতি হচ্ছে বায়ুমণ্ডলের, বাস্তুসংস্থানের।

বলা হয়, ‘একটি বৃক্ষ নিধন করলে দুটি চারা রোপণ কর।’ কিন্তু, আমরা সে নমুনা দেখি কী? এ দেশে রাস্তা, ভবন, শিল্পকারখানা নির্মাণ করতে গিয়ে অগণিত গাছ ধ্বংস করা হচ্ছে। শহর শীতল রাখার দায়িত্বে ‘হিট অফিসার’ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একবারও কি ভেবে দেখেছি, আসলে একটি গাছ কাটার বিপরীতে দুইটি গাছ রোপণ করছি কি না? আমি মনে করি, না। যদি করতাম, তাহলে তাপমাত্রা এতো বৃদ্ধি পেতো না। 

অতীতে শুনেছি, আরবের দেশগুলোতে তাপমাত্রা অনেক বেশি। কথা সত্য। কারণ, সেখানে ধুঁ ধুঁ মরুভূমি। বৃক্ষরোপণের মাটি নেই, শুধু বালু আর পাথর। কিন্তু, পুরোনো সেই পরিবেশ আর আছে কী? এখন সেই মরুভূমির বুকে বৃক্ষরোপণ করছে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতারের মতো দেশ। এমনকি মরুভূমিতে যথাযথ প্রযুক্তি এবং স্বল্প পরিমাণ মাটি ব্যবহার করে শাক-সবজিও চাষ করছে। সবুজায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মরুভূমির দেশগুলোও। তারা প্রথম সারির দেশ, রয়েছে বিপুল সম্পদ। কিন্তু, আমাদেরও তো সম্পদ আছে। বাংলার মাটিকে ‘সোনার চেয়েও খাটি’ বলা হয়। যে কোনো বীজ ফেলে রাখলেই তা থেকে জীবন সৃষ্টি হয়, কুঁড়ি গজায়, পাতা গজায়, বেড়ে উঠতে থাকে একাই। ফলদ প্রতিটি গাছের নিচে পড়া বীজ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই রোপিত। এ যেন এক একটি প্রাণ। 

আমরা মানবসম্পদে এগিয়ে। পৃথিবীর অনেক দেশে আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধারা কাজ করে যাচ্ছে। সৌদি, আমিরাত, জাপান, আমেরিকা কিংবা কাতার-কুয়েতের মতো দেশকে আরও এগিয়ে রাখছেন এই যোদ্ধারা। তাদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রায় আমাদের দেশের অর্থনীতি সচল থাকছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে নেওয়া শ্রমিক দিয়েই উন্নত বিশ্বের আরও উন্নয়ন হচ্ছে। অথচ, আমাদের যথাযথ উন্নয়ন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, প্রাণ-প্রকৃতি এখানে কতটা সংরক্ষিত তা প্রশ্নবিদ্ধ।

দুর্বৃত্তায়ন গ্রাস করতে চায় মমতাময়ী ধরণীকে, প্রাণপ্রিয় বসুন্ধরাকে। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সকলের দায়িত্ব। ধরীত্রির ঋণ শোধ করার মতো নয়। গ্রেটার মতো এখানে এক একজন নিসর্গকর্মী, যারা বসুন্ধরাকে ভালোবাসে, ধরণীকে আঁকড়ে ধরে, তারাই পৃথিবী আগলে রাখার চেষ্টা করে। উপকার না করলেও কখনো ক্ষতির চিন্তা করে না। 

বলা বাহুল্য, গাছ অকৃত্রিম বন্ধু। এর ছায়া, ফলমূল, কাঠ সবই আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। দুঃসময়ের নীরব এই উপকারী গাছের ক্ষতি যেন না হয় সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। একটি গাছের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে আন্তরিক হওয়ারও বিকল্প নেই। অকারণে কখনো পত্রহানি করাও উচিৎ নয়। একটি গাছের সুষম বেড়ে ওঠার জন্য সঠিক পরিচর্যা করাও অতিজরুরি বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। 

একটা রহস্য আজও উম্মোচিত হয়নি। কোনো কালেও কোনো বৃক্ষের শিকড়ের (মূলরোম) শেষ অংশ খুঁজে পাওয়া যায় না। ভূগর্ভে কোথায় সেই শিকড় হারিয়ে যায় তা কেউ জানে না। বৃক্ষের সঙ্গে বসুধার এই যে প্রেম তারও তুলনা হয় না। অর্থাৎ, বৃক্ষ-বসুধা প্রেমের পরিণয় এই শিকড়ে। প্রাণসঞ্চারী সকল জীব বৃক্ষের দেওয়া ফলে-ফুলে-অক্সিজেনেই জীবন ধারণ করে। অথচ, তার কাছে ঋণী না হয়ে কুঠার দিয়ে আঘাত করে ধ্বংসকারীরা। 

মানুষের এতো নিকৃষ্টতার পরও বৃক্ষ ও ধরাকে বিচলিত হতে দেখেনি কেউ। ক্ষতিতো দূরে থাক একটি গাছ ফল-ফুল প্রদান করছে কোনকিছু প্রাপ্তির চিন্তা বাদ দিয়ে। বায়ু করছে সুরভিত। যারা গাছের তাৎপর্য বোঝে না, পৃথিবীর এই ভূমিকে আপন করে নিতে জানে না, তাদের বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মনে করার কোন কারণ নেই। 

বৃক্ষ কাটা পড়লেও বসুধার বুকে তার শিকড় থেকে যায়। প্রাণহীন সেই শিকড় আকড়ে ধরে নিজের সঙ্গে বিলীন করে ধরণী। নিশ্চিত করেই বলছি, এমন মমতার উদাহরণ কোথাও মিলবে না। বৃক্ষ-বসুন্ধরার যে প্রেম, যে নিগুঢ় ভালোবাসা, তার বিচ্ছেদ ঘটানো যায় না। যতই বৃক্ষ দমন করো, যতই বসুধাকে কষ্ট দাও, এতে মানুষেরই ক্ষতি। একটি গাছ দমনের যে ক্ষতি তার খেসারতও দিতে হবে। মাটির প্রতি যে অনাচার, এর শাস্তিও পেতে হবে। 

মোদ্দাকথা, বৃক্ষ-বসুন্ধরা-মানুষের ত্রিমুখী প্রেমের যে পরিণতি, তা-ই বাস্তুসংস্থানকে স্বর্গে রূপান্তরিত করবে। আর তাতেই সমগ্র পৃথিবী হবে ভূ-স্বর্গ।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

prosenjit8000@gmail.com

বিভি/পিএইচ

মন্তব্য করুন: