আল্লাহ নিজেই দেবেন রোজার সওয়াব

রমজান ছাড়া অন্য কোন মাসের নাম আল্লাহপাক কোরআনে উল্লেখ করেননি। শুধুমাত্র রমজান মাসের নাম উল্লেখ করায় বোঝা যায় এটি অত্যন্ত ফজিলত পূর্ণ মাস। এটি কোরআনুল করিমের মাস। এই মাসেরই লাইলাতুল কদরের রাতে আল্লাহ কোরআন নাজিল করেছেন সমগ্র মানবজাতির হেদায়েতের জন্য। তাই নবীজি বলেন, রোজা ঢাল স্বরূপ। যুদ্ধের ময়দানে ঢাল যেমন নিজেকে রক্ষা করে, তেমনি সঠিকভাবে রোজা পালন শয়তান, নফসের ধোকা থেকে নিজেকে হেফাজত করবে। আল্লাহর ভয়ে মানুষ যাবতীয় পানাহার এবং হারাম থেকে বিরত থাকবে।
নামাজেরও আগে রোজার প্রচলন ছিল। আদম (আ.) ছিলেন প্রথম রোজাদার। আদম (আ.) জান্নাত থেকে দুনিয়ায় এসে আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না। জান্নাতের আবহাওয়া ছিল সুন্দর, অত্যন্ত মনোরম। তিনি মনোরম পরিবেশে সুন্দর ছিলেন। আর দুনিয়ার আবহাওয়া ছিল ধূলা-বালি মিশ্রিত। দুনিয়ার আবহাওয়ায় এসে তাঁর পুরো শরীর কালো হয়ে যায়।
তখন আল্লাহ নিদের্শ দেন, হে,আদম, তুমি ৩টি রোজা রাখ। ৩টি রোজা রাখলে তোমার শরীরের কালো দাগ চলে যাবে। তখন তিনি চাঁদের ১৩ তারিখ প্রথম রোজা রাখলেন। তখন তাঁর শরীরের তিনভাগের এক ভাগ কালো দাগ চলে গেল। চাঁদের ১৪ তারিখে তিনি দ্বিতীয় রোজা রাখলেন।তখন তাঁর শরীরের তিনভাগের দুই ভাগ কালো দাগ চলে গেল। আর যখন তিনি পূর্ণিমার চাঁদের রাতে তৃতীয় রোজা রাখলেন তাঁর পুরো শরীর
থেকে সব কালো দাগ চলে গেল।
তিনি আল্লাহর হুকুমে চাঁদের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ ৩টি রোজা রাখলেন। এগুলো হলো- আইয়ামে বিজের রোজা। পরে মহানবী (সা.) চাঁদের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ রোজা রাখাকে মোস্তাহাব করে দেন। হযরত নূহ, হযরত ইবরাহীম ও হযরত দাউদ (আ.) এর যুগেও রোজার প্রচলন ছিল। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় হযরত দাউদ (আ.)’র রোজা। তিনি একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন বিনা রোজায় থাকতেন। প্রত্যেক নবী-রাসূলগণ এভাবে রোজা রেখেছেন। তাই মানুষ মোত্তাকী হয় রোজার মাধ্যমে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন, ‘যারা ঈমান এনেছ তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাক্ওয়া অবলম্বন করতে পার।’ (সূরা বাকারা:১৮৩)।
সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, কামাচার, পাপাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস ও অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোজা। ইসলামী বিধান অনুসারে, প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য রমযান মাসের প্রতিদিন রোজা রাখা ফরজ। যার অর্থ ‘অবশ্য পালনীয়’।
একাধারে ১২ মাস রোজা রাখা নিষেধ। একদিন বাদ দিয়ে একদিন এভাবে ৬ মাস রোজা রাখা জায়েজ। এটি হলো মুহাম্মদ (সা.) এর শিক্ষা। মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, সবচেয়ে উত্তম রোজা হলো হযরত দাউদ (আ.)’র রোজা। তিনি একদিন রোজা রাখতেন, একদিন ছেড়ে দিতেন। এভাবে তিনি বছরে ৬ মাস রোজা রাখতেন। দাউদ (আ.) এর রোজা আল্লাহপাক পছন্দ করেছেন।
সব ধরণের গুনাহ থেকে মাফ পাওয়ার মাস রমজান। এ মাসে যিনি গুনাহ ক্ষমা করাতে পারবেন না, তিনি দূর্ভাগা। মুহাম্মদ (সা.) একদিন খুতবা দেওয়ার সময় ৩ বার আমিন বললেন। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ কি কারণ? আপনি থেমে থেমে ৩ বার আমিন বললেন। তখন মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, জিবরাইল (আ) আমাকে ৩টি বিষয় শুনালেন। প্রথমবার শুনালেন, যে সমস্ত মানুষ মা-বাবাকে পেয়েও
জান্নাত অর্জন করতে পারে না, তাদের উপর আল্লাহর লানত। তখন আমি আমিন বলেছি। যে সমস্ত মানুষ রমজান পেয়ে গুনাহ ক্ষমা করাতে পারে না, তাদের উপর আল্লাহর লানত। তখন আমি আমিন বলেছি। যে সমস্ত মানুষ আমার নাম শুনে দরুদ পাঠ করে না, তাদের উপর আল্লাহর লানত। তখন আমি আমিন বলেছি।
মহানবী বলেছেন, রমজানের শুরুর ১০ দিন রহমতের, মাঝের ১০ দিন গুনাহ থেকে মুক্তির এবং শেষের ১০ দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তির। সুবহানাল্লাহ। এই কারণে আমরা রমজানকে মূল্যায়ন করি। গুনাহ থেকে ক্ষমার চেষ্টা করি। এই রমজানে পুরো ১১ মাসের সগীরা গুনাহর কাফফারা হবে। সাথে তওবা করে আল্লাহর কাছে তওবা কবুল করিয়ে নিলে কবিরা হুনাহ’র মাফ মিলবে। তাই, রমজান আমাদের কাছে
গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মানুষের গুনাহকে জ্বালিয়ে ফেলে রমজান।
রমজানে আল্লাহপাক ইমানদারের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। একটি নফল ইবাদত করলে ফরজের সওয়াব দেন। একটি ফরজ ইবাদত করলে তাকে ৭০ গুণ সওয়াব বাড়িয়ে দেন। সুবহানাল্লাহ। তাই ১১ মাস গুনাহ হলেও রমজানে যাতে গুনাহ না হয় সতর্ক থাকতে হবে। শয়তান মানুষদের কু-মন্ত্রনা দিয়ে পাপে লিপ্ত করে। রমজানেও মানুষকে বিভিন্ন কু-মন্ত্রনা দিয়ে থাকে তাই মানুষ পাপাচারে লিপ্ত হয়। তাই, রমজানে সমস্ত পাপমুক্ত হয়ে ইবাদতে সময় কাটানো ইমানদারদের দায়িত্ব। দিনের বেলায় রোজা সাথে কোরআন তেলওয়াত, রাতের বেলায় তারাবি, তাহাজ্জুদ, নফল নামাজ পালন করতে পারি। এভাবে কাটালে আপনার রমজান সফল হবে। বেশি বেশি ইবাদতের মাধ্যমে নিজের জীবনকে দামি বানাতে পারবেন। তওবার মাধ্যমে আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে পারি।
আল্লাহপাক এই রমজান মাসে কোরআন নাজিল করেছেন মানুষের হেদায়েতের জন্য। পুরো ৩০ প্যারা কোরআন শবে কদরে আল্লাহপাক লওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমান বাইতুল ইজ্জতে পাঠান। সেখান থেকে মানুষের ও সমাজের চাহিদামতে ২৩ বছরে রাসূল (সা.) এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। প্রথম হয়েছে শবে কদরে। দ্বিতীয়টি হয়েছে ২৩ বছরে। তাই, রমজান মাস কোরআনের মাস। কদরের রাতের কারণে এই মাসের মর্যাদা বেশি। কোরআনের কারণে রমজানকে দামি হিসেবে দেখতে পাই।
আল্লাহপাকের সব আসমানি কিতাব তওরাত, যবুর, ইনজিল ও সবশেষ আল কোরআন নাজিল হয়েছে রমজানে। আল্লাহপাক তাই বলেছেন, মানুষের হেদায়েতের জন্য আমি রমজান মাসে কোরআন নাজিল করলাম। এই কোরআনের মধ্যে রয়েছে স্পষ্ট জীবন বিধান। কোরআনের ব্যাখ্যা হলো হাদিস। যে সমস্ত আমল কোরআন ও হাদিসে স্পষ্ট থাকবে সেগুলো আমরা গ্রহণ করতে পারি। কোরআন ও হাদিসে যা স্পষ্ট থাকবে না তা আমাদের বর্জন করতে হবে। কারণ, আমাদের প্রধান দলিল কোরআন। দ্বিতীয় দলিল হলো, হাদিস। ইবাদতের ক্ষেত্রে কোরআন এবং হাদিসের কোন বিকল্প নেই। কোনটা ইবাদত আর কোনটা বিদআত এর মাপকাঠি হলো আল কোরআন এবং সুন্নাহ। সহীহ হাদিস এবং
কোরআন দ্বারা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে সেগুলি আমল করলে সওয়াব পাওয়া যায়। বরং কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী আমল সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হবে বিদআত হওয়ার কারণে।
আল্লাহপাক বলেন, যারা রমজান পাবে তারা যেন রোজা রাখে, তবে কোন মানুষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে এবং সফরের মধ্যে কষ্ট হলে রোজা ছাড়তে পারবে। পরবর্তী সময়ে তাদের কাজা আদায় করতে হবে। যারা স্থায়ীভাবে অসুস্থ রোজার রাখতে পারেন না তাদের ফিদায়া দিতে হবে। স্থায়ী অক্ষম ব্যক্তি ফিদায়া দিলে আদায় হবে। কিন্তু, অস্থায়ী অক্ষম ব্যাক্তি ফিদায়া দিলে আদায় হবে না। তাকে যখন সক্ষম হবেন তখন রোজা রাখতে হবে। আল্লাহপাক বান্দাদের জন্য সব সহজ করতে চান। কোনকিছু কঠিন করতে চান না।
হাদীসে আছে- ওযরবিহীন কোন রোজা ছাড়লে পরবর্তী জীবনভর নফল রোজা রাখলেও একটি ফরজ রোজার সওয়াব অর্জন করতে পারবে না। রমজানের একটি রোজার মর্যাদা অনেক। তাই আল্লাহপাক বলেছেন, রোজা আমার জন্য, এর ফজিলত আমি নিজে দেব। কেন?
আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ক্ষুধার্ত থাকা। কারণ, ফেরেশতাদের খাবারের কোন প্রয়োজন নেই, তারা রমজানের কষ্ট বুঝবেন না। তবে, অসুস্থ অথবা সফরের মধ্যে থাকলে রোজা ছাড়তে পারবেন। কিন্ত, পরবর্তীতে তারা কাজা আদায় করবেন।
রমজানে ৪টি নেয়ামত আল্লাহপাক আমাদের প্রদান করেন। জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়। জান্নাতের সাথে ইমানদারের সংযোগ হয়ে যায়। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানকে বন্দি করে রাখা হয়। ইফতারের সময় মানুষের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। সুবহানাল্লাহ। ইফতারের সময় গুনাহ ক্ষমা চাওয়া সুন্নাহ। এছাড়া রোজাদারের জন্য দুটি খুশী। একটি হলো ইফতারের সময়। অপরটি হলো ইদুল ফিতর। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে রোজা রাখা এবং তাকওয়া অর্জনের তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
বিভি/পিএইচ
মন্তব্য করুন: