বেগম খালেদা জিয়া: স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-গণতন্ত্রের অপরাজেয় নেতৃত্ব

বাংলাদেশের ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়া এক অনমনীয় নেতৃত্বের নাম যাঁর আপসহীন সংগ্রামী মনোভাব এদেশের মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে পথ দেখিয়েছে বারবার। সাধারণ একজন গৃহবধূ থেকে রাষ্ট্রের ক্রান্তিলগ্নে এক অপ্রতিরোধ্য নেতৃত্ব হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শুধুমাত্র স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধেই নয়, পরবর্তীতে ফ্যাসিস্ট হাসিনার কালো ছায়া থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশেও তিনি আপসহীন থেকেছেন এবং তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সর্বদা অবিচল থেকেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়া তাই পরিচিত গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীন, স্বাধীনতার প্রশ্নে অনমনীয় এক অনন্য নেতৃত্ব রূপে ; যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নেতৃত্বে একজন নারীর ক্ষমতায়ন সত্যিই প্রশংসনীয়। মেজর জিয়াউর রহমান-এর স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে যে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় সমস্ত বদ্বীপজুড়ে, সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হয়েও জীবনের মায়া ত্যাগ করে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন দৃঢ়চেতা। মুক্তিযুদ্ধের একজন সহযোদ্ধা হিসেবেই শুধু নন, বেগম খালেদা জিয়া শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর বিএনপি'র মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে গণতান্ত্রিকভাবে নেতৃত্ব দিতেও পিছপা হননি।
তৎকালীন বাংলাদেশের পুরুষকেন্দ্রিক রাজনীতিতে নারী রাজনীতিবিদ হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব তাঁর অকুতোভয় দৃঢ়চিত্তেরই বহিঃপ্রকাশ। বিশেষত স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর সফল নেতৃত্ব স্পষ্টরূপে এটাই প্রতিফলিত করে যে নারীরা কোনো অংশেই পুরুষদের তুলনায় কম প্রতিভাবান অথবা দুর্বল সংগঠক নন। স্বামীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাঁর অকুতোভয় সংগ্রাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমোঘ কবিতার লাইন দুটিকেই বারবার মনে করিয়ে দেয়-
"বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তাঁর নর"
একজন মা যেমন শত-সহস্র বিপদেও তাঁর পরিবারকে পরম মমতায় আগলে রাখে, বেগম খালেদা জিয়া এদেশের মানুষকে ঠিক তেমনভাবেই ভালোবেসেছেন। তাইতো, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেই হোক আর ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময়কালে দেশ ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে রাজপথ কিংবা বিনা অপরাধে কারাবরণ, কখনোই তিনি অন্যায়ের সাথে এতোটুকু আপস কিংবা জাতীয় স্বার্থকে হীন করে ব্যক্তিগত সুবিধা ভোগ করেননি। বরং স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্তে প্রতিবাদ করে গেছেন, একজন মমতাময়ী সংগ্রামী মা-এর মতই এদেশের মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। উদ্ভট ও মিথ্যা মামলায় কারাবরণ করেও কিংবা পরিবার থেকে দূরে থেকেও এদেশের মানুষকে অসহায় রেখে বিদেশে পালিয়ে যাননি বা সেইফ এক্সিট নেননি বরং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার দাবিতে দেশবাসীকে সংগ্রামী হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম:
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জোরপূর্বক এদেশে সামরিক শাসন জারি করেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেন। এর প্রতিবাদে দীর্ঘ নয় বছর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে আন্দোলন চালিয়ে যান এবং ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটিয়ে আন্দোলনকে সফল করেন। তাঁর এই অভূতপূর্ব নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ এদেশের জনগণ ১৯৯১ সালে এক গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের জন্য বিএনপিকে নির্বাচিত করে। স্বাধীনতার প্রায় ২০ বছর পর বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া শপথ গ্রহণ করেন এবং একইসাথে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্হা পরিবর্তন করে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান তাঁর "বেগম খালেদা জিয়া- মানচিত্রে মিশে থাকা নাম" শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ১৯৯১ সালে আধিপত্যবাদি শক্তির দোসরদের বিপরীতে সগর্বে মাথা উঁচু করে বেগম খালেদা জিয়া উচ্চারণ করেছিলেন "ওদের হাতে গোলামির জিঞ্জির, আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা"।
রাজনৈতিক অবস্থানই শুধু নয়, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের জনগণের সম্মুখে তাঁর প্রতিশ্রুতির প্রমাণ দিয়েছেন। ১/১১ এর অবৈধ সরকারের দেয়া মিথ্যা মামলায় যখন তিনি কারাবন্দী এবং তারঁ দুই পুত্র অকথ্য নির্যাতনের শিকার, তখনো তিনি শুধু নিজ পরিবারকে নয়, বরং এদেশের মানুষের গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের পথকেই বেছে নিয়েছেন।
ড. মো. আবুল কালাম আজাদ তাঁর "গণতন্ত্রের আপসহীন সংগ্রামী বেগম খালেদা জিয়া" শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে খালেদা জিয়ার কাছে জেলে যখন মাতৃত্ব ও নেতৃত্বের মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তখন তিনি নির্ভীকচিত্তে উত্তর দিয়েছেন, ‘আমি আমার দুই ছেলেকে আল্লাহর জিম্মায় রেখে নেতৃত্বকেই বেছে নিলাম’। তাঁর এই বক্তব্যে এটাই প্রতিফলিত হয়েছিলো যে তিনি শুধু একটি পরিবারেরই নন, বরং সমগ্র বাংলাদেশের মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর। শত নির্যাতন-অপমান সহ্য করে এবং মিথ্যা মামলায় আসামী হয়ে কারাভোগ করেও একজন "মা"-এর মতোই নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের ছায়া হয়ে দেশের মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার লড়াই করে গিয়েছেন।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে বেআইনিভাবে উচ্ছেদ করা হয়, ২০১৫ সালে নিরপেক্ষ নির্বাচন দাবির আন্দোলন চলাকালীন ফ্যাসিস্ট হাসিনার দখলদার সরকারের নির্দেশে দীর্ঘদিন গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে তাঁকে বালুর ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। ১/১১ এর সরকারের অবর্ণনীয় নির্যাতনের জেরে চিকিৎসারত অবস্থায় কনিষ্ঠ সন্তান আরাফাত রহমান কোকো মৃত্যুবরণ করেন, পরবর্তীতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা মামলায় ২০১৮ সালে পরিত্যক্ত-নির্জন কারাগারে বন্দি করে রাখা হয় তাঁকে।
তবে, ২০১৭ সালে বকশিবাজারের বিশেষ আদালতে তিনি বলেছিলেন, ‘এদেশের গতি প্রকৃতির সাথে আমার নাম লেখা হয়ে গিয়েছে।’ একারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেশপ্রেমিক হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার নাম অদ্বিতীয়। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর এই লড়াইকে স্বীকৃতি দিতেই ২০১৮ সালের ৩১জুলাই কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (সিএইচআরআইও) তাঁকে " মাদার অফ ডেমোক্রেসি" সম্মাননা প্রদান করে এবং ঐ সময়টিতেও তিনি কারাবন্দী ছিলেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁর 'বেগম খালেদা জিয়া : গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী' শীর্ষক লেখনীতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন "বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনি অবিচল। গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিরামহীন সংগ্রাম করেছেন।"
বেগম খালেদা জিয়া শক্তহাতে দেশের অর্থনীতি উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন যেনো বাংলাদেশকে কোনো বিদেশি শক্তির সামনে মাথা নোয়াতে না হয়। শুধুমাত্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই করেই নয়, একজন প্রকৃত মা-এর মতই এদেশের মানুষকে স্বাবলম্বী ও বিশ্বদরবারে যোগ্য করতে চেয়েছেন। সেই লক্ষ্যে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রচলন, ক্ষুদ্রঋণ কার্যের সম্প্রসারণ, কৃষকদের ভর্তুকি প্রদান, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইপিজেড) গঠন করে দেশের অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করেন। আর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেনো বাধাগ্রস্ত না হয় এই উদ্দেশ্যে সারা দেশে মহাসড়ক সম্প্রসারণ, নতুন রেলপথ তৈরি, যমুনা সেতুর প্রকল্প পরিকল্পনাসহ যোগাযোগ মাধ্যমকে গতিশীল করতে সচেষ্ট হন।
বেগম খালেদা জিয়া নারীর ক্ষমতায়নের পথকেও সুগম করেন। ফ্রান্সের কিংবদন্তী নেতা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যেমন রাষ্ট্র গঠনে শিক্ষিত মায়ের ভূমিকা উপলব্ধি করেছিলেন, তেমনই বেগম খালেদা জিয়া বুঝেছিলেন এদেশের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষিত নারীর গুরুত্ব অপরিসীম। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে প্রথমে মাধ্যমিক ও পরবর্তীতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার প্রচলন, উচ্চ শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য চট্টগ্রামে ১০৪ একর জমির উপর "এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন" প্রতিষ্ঠা, সহজ শর্তে ও কম সুদে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ নীতি গ্রহণ, দরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল ও বিনামূল্যে হস্তশিল্পের উপকরণ প্রদান, গার্মেন্টস শিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত, নারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে যৌতুকবিরোধী আইন প্রণয়ন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করেছেন।
গৃহবধু থেকে রাষ্ট্রনেতৃত্ব-এর পথচলা কিংবা জনগণের অবিসংবাদিত দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হয়ে ওঠা কিন্তু একজন নারী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য মোটেও সহজ ছিলোনা। দেশ ও জনগণের স্বার্থে নেতৃত্বের প্রশ্নে অনমনীয় এই জীবন্ত কিংবদন্তি বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বের কাছে একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে তাঁর আপসহীন মনোভাব এবং বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে বাঁচার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার অবিরাম চেষ্টা এদেশের মানুষকে বরাবরই অনুপ্রাণিত করেছে। তাই, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া'র প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ; যিনি ব্যক্তিগতভাবে হাজারো নির্যাতন সহ্য করেও এখনো পর্যন্ত গোটা বাংলাদেশকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছেন পরম মমতায় এবং সুদৃঢ় হাতে। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য মনোভাব, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় আপসহীন নেতৃত্বের প্রশ্নে তিনি সত্যিই অনন্য।
লেখক: এফ. ফিল শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ।
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: