গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে দলতন্ত্র: বাংলাদেশে PR পদ্ধতি কি আদৌ বাস্তবসম্মত?

বাংলাদেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটে Proportional Representation (PR) পদ্ধতি প্রয়োগের বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের রাজনীতি, সামাজিক কাঠামো, ভোটার আচরণ ও নির্বাচন সংস্কৃতির জটিল বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে। অনেক তাত্ত্বিক সুবিধা থাকলেও বাস্তবিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে PR পদ্ধতির কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। নিচে তার কিছু মূল কারণ তুলে ধরা হলো:
১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ঝুঁকি: PR পদ্ধতির ফলে ছোট দলগুলোও সংসদে প্রবেশ করতে পারে। কারণ, অল্প ভোট পেলেও অনুপাতে কিছু আসন তারা পাবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই ছোট দলগুলোর অনেক সময় আদর্শিক ভিত্তি নেই। তারা ক্ষমতার ভাগাভাগিতে যেতে পারে, বার্গেনিং-এর রাজনীতি করতে পারে। এর ফলে বারবার জোট সরকার, দুর্বল সরকার এবং নীতিগত অচলাবস্থা (policy deadlock) তৈরি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
২. দলীয় নেতৃত্বের একচেটিয়া ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে: PR পদ্ধতিতে দলীয় তালিকা অনুযায়ী সাংসদ নির্বাচিত হয়। অর্থাৎ, ভোটার সরাসরি প্রার্থী নির্বাচন করে না, বরং দলকে ভোট দেয়। বাংলাদেশে যেহেতু দলীয় প্রধানের কর্তৃত্ব প্রবল, তাই তালিকা তৈরিতে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং দলনির্ভর চাটুকারদের অগ্রাধিকার পাওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। এতে জনগণের প্রতিনিধিত্ব না হয়ে দলের নেতার প্রতিনিধিত্ব দেখা যাবে সংসদে।
৩. ভোটার ও জনসম্পৃক্ততা কমে যেতে পারে: FPTP পদ্ধতিতে জনগণ একজন প্রার্থীকে সরাসরি ভোট দেয়, তার এলাকায় সাংসদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকে। PR পদ্ধতিতে সেই স্থানীয় সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়। কারণ, ভোট একটি জাতীয় বা আঞ্চলিক তালিকাকে দেওয়া হয়।সাংসদ নির্দিষ্ট এলাকার প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন না।
৪. ভোটারদের শিক্ষাগত ও রাজনৈতিক সচেতনতা এখনও সীমিত: PR পদ্ধতি বোঝা অনেক সময় শিক্ষিত ভোটারদের জন্যও কঠিন।
বাংলাদেশে এখনো অনেক ভোটার রাজনৈতিক দলের প্রতীক ছাড়া প্রার্থীকেই ঠিকঠাক চিনতে পারেন না, সেখানে জটিল PR পদ্ধতি বোঝা এবং তাতে অংশগ্রহণ করা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
৫. সংসদের গঠনজটিলতা ও অপরিপক্ব রাজনৈতিক দলগুলো: PR পদ্ধতিতে অনেক অখ্যাত দলও ১-২টি আসন পেয়ে যাবে, ফলে সংসদ হবে বিচিত্র ও খণ্ডিত। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক সহনশীলতাবিহীন পরিবেশে এমন পরিস্থিতি বিরোধিতা, বিশৃঙ্খলা এবং কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে।
তাহলে কি PR পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক?
না, একেবারে অপ্রাসঙ্গিক বলা যাবে না। বিশেষ করে নারী, সংখ্যালঘু, আদিবাসী, ধর্মীয় বা ভাষাগত বৈচিত্র্য; এইসব কম প্রতিনিধিত্ব পাওয়া গোষ্ঠীর জন্য কিছুটা PR যুক্ত (যেমন: Mixed-Member Proportional system) চিন্তা করা যেতে পারে। কিন্তু, সেটাও পাইলট স্কেলে বা ধাপে ধাপে রূপান্তরের অংশ হিসেবে প্রয়োগযোগ্য হতে পারে।
PR পদ্ধতি বিশ্বে অনেক দেশে কার্যকর হলেও বাংলাদেশের মতো দলনির্ভর, নেতাকেন্দ্রীক, সহনশীলতাহীন এবং দলবাজিতে পূর্ণ রাজনীতিতে এটি প্রয়োগ করলে সংসদ ও গণতন্ত্র আরও দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। তবে, দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নয়ন, দলীয় গণতন্ত্র চর্চা ও ভোটার সচেতনতা বাড়লে একদিন এই পদ্ধতি গণতন্ত্রের পরিপক্ব স্তরে অবদান রাখতে পারে।
লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, সমাজসেবক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকারকর্মী ও রাজনীতিবিদ;
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র ও ডেমোক্রেসি রিসার্চ সেন্টার (ডিআরসি)
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
বিভি/পিএইচ
মন্তব্য করুন: