সাংবাদিকতায় এআই: প্রস্তুতি, সুযোগ ও সংকট
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন কেবল প্রযুক্তি নয়, এটি সাংবাদিকতার নতুন বাস্তবতা। বিশ্বব্যাপী মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো এআইকে খবর সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরিতে ব্যবহার করছে। নিউজরুমে এআইয়ের আগমন সংবাদ পরিবেশনের গতি বৃদ্ধি করেছে, পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ কমিয়েছে, কিন্তু একদিকে নতুন প্রশ্নও তৈরি করেছে—বিশ্বাসযোগ্যতা, নৈতিকতা ও সাংবাদিকতার মূল ভূমিকা কি একইভাবে রক্ষিত থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে এখন জরুরি ভিত্তিতে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও অনলাইন নিউজরুমে এআই ব্যবহার তুলনামূলকভাবে নতুন। অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো এ প্রযুক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। কিছু মিডিয়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে এআই ব্যবহার করছে—সংবাদ শিরোনাম তৈরি, অনুবাদ, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট প্রস্তুতি ইত্যাদি কাজে। তবে রুটিন নিউজরুমে এআই ব্যবহার এখনো সীমিত।
সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ সাংবাদিক ব্যক্তিগতভাবে এআই ব্যবহার করছেন, কিন্তু নিউজরুম পর্যায়ে এই হার মাত্র ২০ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রযুক্তির সঙ্গে সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত পরিচয় থাকলেও, প্রতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি এখনো অনেক দূরে। বিশেষ করে ছোট ও মধ্যম আকারের মিডিয়াগুলোতে অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ, নীতিমালা বা যাচাই প্রক্রিয়ার অভাব লক্ষ্য করা যায়। এই ধীর গতি ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তির সঙ্গে দ্রুত তাল মেলানো অপরিহার্য।
সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা
এআই-চালিত টুলগুলো সাংবাদিকদের পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ থেকে মুক্তি দিচ্ছে। তথ্য বিশ্লেষণ, সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং, নিউজ সারাংশ—সবই এখন দ্রুত করা সম্ভব। এটি ‘ভ্যালু অ্যাড’ জার্নালিজমের সুযোগ তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এআই ব্যবহারকারী সাংবাদিকদের উৎপাদনশীলতা গড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা বেশি সময় দিতে পারছেন মাঠ পর্যায়ের প্রতিবেদন, ডেটা বিশ্লেষণ ও প্রেক্ষাপটভিত্তিক খবর তৈরি করতে। এআই এখানে সহকারী হিসেবে সাংবাদিকদের কাজকে শক্তিশালী করছে।
তবে সুবিধার সঙ্গে এসেছে নতুন এবং গুরুতর চ্যালেঞ্জ। এআই এখনো মানুষের মতো প্রেক্ষাপট, নৈতিক মূল্যবোধ বা সামাজিক দায়বদ্ধতা বোঝে না। এ কারণে এআই দ্বারা সৃষ্ট আংশিক সত্য বা সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্যও আত্মবিশ্বাসীভাবে উপস্থাপন হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ‘ডিপফেইক’ বা বিভ্রান্তিকর খবর পাঠকের আস্থা নষ্ট করছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে ডিজিটাল নিউজের বিস্তার ত্বরান্বিত হচ্ছে, পাঠকের আস্থা বজায় রাখা সাংবাদিকতার জন্য ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কাঠামোর পরিবর্তন ও আস্থার সংকট
প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে বদলে যাচ্ছে সাংবাদিকতার কর্মপ্রকৃতি। রুটিন রিপোর্টিং বা সাব-এডিটিংয়ের অনেক কাজ এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা সম্ভব। এটি গণমাধ্যমে কর্মসংস্থান হারানোর ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে। তাই ভবিষ্যতে সাংবাদিকদের ভূমিকা হবে আরও বিশ্লেষণধর্মী, ব্যাখ্যামূলক ও প্রেক্ষাপটভিত্তিক। সাংবাদিকদের এখন অবশ্যই এমন বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে যা এআই পারবে না—যেমন গভীর মানবিক গল্প বলা, নৈতিক বিচার-বিবেচনা করা এবং তথ্যের পেছনের সত্য উন্মোচন করা।
এই পরিবর্তন কার্যকর করতে হলে নিউজরুম কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে। নতুন দক্ষতা ও নীতি-নির্দেশনা ছাড়া কেবল প্রযুক্তির ব্যবহার হিতে বিপরীত হতে পারে। সাংবাদিকতার মূল শক্তি হলো আস্থা। এআইয়ের যুগে তথ্য সহজেই সুলভ, কিন্তু বিশ্বস্ত তথ্য এখন মূল্যবান পণ্য।
নিউজরুমগুলোকে ভবিষ্যতের জন্য তিনটি দিক বিবেচনা করে প্রস্তুতি নিতে হবে:
১. মিডিয়া হাউসগুলোকে সাংবাদিকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। সাংবাদিকদের জানতে হবে এআই কীভাবে কাজ করে, কোথায় এর সীমাবদ্ধতা। এর জন্য মিডিয়া শিক্ষা কারিকুলামেও এআই-সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক।
২. নিউজরুমে এআই ব্যবহার ও যাচাই প্রক্রিয়া নির্ধারণ করতে শৃঙ্খলাবদ্ধ নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। কোন সংবাদে এআই ব্যবহার করা হবে, কোন ক্ষেত্রে চূড়ান্ত যাচাই মানুষের হাতে থাকবে, তা স্পষ্ট করতে হবে। সাংবাদিকতার নৈতিক ও মানবিক দিকগুলো বজায় রাখতে মানুষের ভূমিকা অপরিহার্য।
৩. পাঠকের আস্থা বজায় রাখতে প্রতিটি এআই-নির্ভর কনটেন্টে ‘এআই সহায়তায় তৈরি/সম্পাদিত’ লেবেল থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। এটি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং পাঠককে ভুল তথ্যের উৎস সম্পর্কে সচেতন করবে।
সাংবাদিকতা এখনও মানুষের কাজ; এখানে মানবিকতা, অভিজ্ঞতা, নৈতিকতা আর দায়বদ্ধতা—সবকিছুই মূল চালিকা শক্তি। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে হবে। প্রযুক্তি পরিবর্তন আনছে, কিন্তু সাংবাদিকতার মূল দায়িত্ব—সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা, মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো—মানবিক বোধের ওপর নির্ভর করছে।
এআই সাংবাদিকতার সহযাত্রী হতে পারে, কিন্তু কখনোই চালক নয়। ভবিষ্যতের নিউজরুম আরও স্মার্ট হবে, কিন্তু সেই নিউজরুমকে চালাবে এখনকার মতোই একদল মানুষ—যারা জানে, প্রযুক্তি নয়, সত্য ও মানবিকতাই সাংবাদিকতার মূল শক্তি।
লেখক: সহ-সম্পাদক, আরটিভি অনলাইন
ই-মেইল: asifsavar@gmail.com
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
বিভি/এজেড




মন্তব্য করুন: