বিদায় মাদার অফ ডেমোক্রেসি
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক আপসহীন নেতৃত্বের আন্তর্জাতিক প্রতিধ্বনি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা শুধু একটি দেশের সীমানায় সীমাবদ্ধ ছিল না। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতা, সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রাম এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ইতিহাসে তিনি ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি পরিচিত কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল।
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির চেয়ারপারসন এবং ১৯৯১ সাল থেকে তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নির্বাচিত নারী সরকারপ্রধান- যা তাঁকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক ব্যতিক্রমী অবস্থানে নিয়ে যায়। পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টোর পর দক্ষিণ এশিয়ায় গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় আসা নারী নেতৃত্বের ধারায় তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান মুখ।
তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট, দিনাজপুর জেলায়। তাঁর পিতা ইস্কান্দার মজুমদার ও মাতা তৈয়বা মজুমদার। দেশভাগের অভিঘাত তাঁর পারিবারিক জীবনকেও স্পর্শ করেছিল- ভারতের জলপাইগুড়ি অঞ্চল থেকে তাঁর বাবার তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে গমন এবং পরিবারের আদি নিবাস ফেনীতে স্থিত হওয়া উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনেরই প্রতিফলন। ১৯৬০ সালে তিনি জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করেন- যিনি পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী রাষ্ট্র নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় বেগম খালেদা জিয়া ফার্স্ট লেডি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, নেদারল্যান্ডের রানি জুলিয়ানাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি এমন এক সময়ে বাংলাদেশের উপস্থিতি তুলে ধরেন, যখন দেশটি বিশ্ব রাজনীতিতে নিজস্ব অবস্থান সুসংহত করার চেষ্টা করছিল।
তবে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল ভিত্তি গড়ে ওঠে ১৯৮১ সালের ট্র্যাজেডির পর। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর বাংলাদেশ এক গভীর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত হয়। সেই সংকটময় সময়ে, ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি তিনি বিএনপিতে সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগ দেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর নেতৃত্বগুণ ও সংগঠকসুলভ দক্ষতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৮৩ সালে ভাইস-চেয়ারম্যান এবং ১৯৮৪ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে তিনি কার্যত সামরিক শাসনবিরোধী রাজনীতির মুখ হয়ে ওঠেন।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতায় আশির দশক ছিল সামরিক ও আধা-সামরিক শাসনের যুগ। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ- সবখানেই গণতন্ত্র চাপে ছিল। বাংলাদেশে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সক্রিয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তিনি সাত দলীয় জোট গঠনের অন্যতম স্থপতি হিসেবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন।
১৯৮৬ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁকে দক্ষিণ এশিয়ার বিরোধী রাজনীতির এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তে পরিণত করে। সে সময় অনেক রাজনৈতিক শক্তি সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলেও তিনি আপোষ করেননি। এই অনমনীয় অবস্থান তাঁকে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্রপন্থী মহলে একজন দৃঢ় ও আপোষহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিত করে তোলে।
১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার কারাবরণ সত্ত্বেও তিনি আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াননি। তাঁর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দেশব্যাপী ৩২১টির মধ্যে ২৭০টি সংসদে বিজয় ছাত্র আন্দোলনকে গণআন্দোলনের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এই ছাত্রসমাজই স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ পুনরায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসে- যা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সময়ে অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তনের সূচনা হয়। কর্মসংস্থানের হার বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পে পাঁচ বছরে প্রায় ২৯ শতাংশ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ঘটে। প্রায় দুই লাখ নারী এই খাতে যুক্ত হন—যা দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে নারী শ্রমশক্তির অগ্রযাত্রার একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
পরবর্তীতে আরও দুইবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি আঞ্চলিক কূটনীতি, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সুসংহত করার চেষ্টা করেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল সাফল্য ও বিতর্কের সমন্বয়ে গঠিত, তবে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট ও দৃঢ়।
আজ বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেমন এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক ইতিহাসেও একটি পরিচিত অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। তিনি ছিলেন এমন এক নেত্রী, যিনি ক্ষমতার ভেতরে ও বাইরে- উভয় অবস্থাতেই গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
বিদায় মাদার অফ ডেমোক্রেসি। আপনার নেতৃত্ব ও সংগ্রামের প্রতিধ্বনি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসেও দীর্ঘদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক: কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী।
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
বিভি/এজেড




মন্তব্য করুন: