খালেদা জিয়া: এক মহিয়সীর মহাপ্রয়াণ
বেগম খালেদা জিয়া
বিদায়, আপসহীনা বেগম খালেদা জিয়া, বাংলাদেশের কোটি কোটি জাতীয়তাবাদী, ভক্ত ও অনুসারীদের আদর্শস্থানীয়, অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ও প্রেরণাদায়ী, যিনি তাঁর জীবন ও সংগ্রামের সমান বড়। সংগ্রামী স্যালুট জানাই তাঁর মহাপ্রয়াণের এই বিদায় লগ্নে। এ যে এক মহিয়সীর মহাপ্রয়াণ, যার মৃত্যুতে থমকে গেছে গোটা দেশ, স্তব্ধ সমগ্র জাতি, শোকাহত সারা দুনিয়ার বাঙালী। উল্লেখ্য, রাজধানীর এভারকেয়ারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার ভোর ৬টায় বেগম জিয়া ৮০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব)।
মৃত্যু হচ্ছে একজন মানুষ বা জীবের জীবন ও সমস্ত জৈবিক প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি। মৃত্যুর চেয়ে নিশ্চিত কোন ভবিষৎ আর নেই। মৃত্যু নামক এই অনিবার্য ও প্রাকৃতিক কার্যবিধির স্বাদ রাজা, প্রজা, আমির, ফকির নির্বিশেষে সবাইকে ভোগ করতেই হবে। এ যে বিধাতার অমোঘ বিধান। কিন্তু সে মৃত্যু যদি হয় বীরের, সেটাই সার্থক মৃত্যু। যেমনটা হয়েছে আমাদের খালেদা জিয়ার, বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি'র শাসনামলে তিনবারের প্রধানমন্ত্রীত্বের তকমা তাঁর নামের সাথে জড়িত।
সুতরাং, গভীর দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে লিখতে হচ্ছে আদর্শবান ও দেশপ্রেমিক এই নারীর মৃত্যু নিয়ে এক শোকগাঁথা, এক অবিচুয়ারি (obituary) কারণ মহান রবের ডাকে উনি এই ইহকালীন যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে অনন্তকালের যাত্রা শুরু করেছেন। উনার এই অন্তিম যাত্রার মধ্য দিয়ে নিভে গেল এক প্রাণপ্রদীপের, বাংলাদেশের রাজনীতির এক বাতিঘরের, এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের, এক দিশারী আলোর ও জাতির যেকোনো ক্রান্তীলগ্ন উত্তরণের এক মহান অভিভাবকের। পরিসমাপ্তি ঘটল একটি দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী লড়াই, ত্যাগ ও সংগ্রামে ভরপুর মহাকাব্যিক উপাখ্যানের। এ যেন এক মহাকালের সমাপ্তি।
মা, মাটি ও মানুষের জন্য তিনি আজীবন লড়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সয়েছেন নির্যাতন-নিপীড়ন, থেকেছেন গৃহবন্দী, করেছেন কারাবরণ। অকালপ্রয়াত স্বামী, বিএনপি'র প্রতিষ্ঠাতা ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-প্রবর্তিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ ও গণমানুষের অধিকার আদায়ে আপসহীন এই নেত্রীর পার্থিব ভুলত্রুতি ক্ষমা করে দিয়ে মহান আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকাম দান করুন। বিএনপি পরিবারকে এই গভীর শোক, সন্তাপ ও বেদনা সহ্য করার ধৈর্য ও মানসিক শক্তি দান করুন। উনি চিরজাগরুক থাকুক প্রতিটি বাঙালীর মনে, হৃদয়ে ও প্রার্থনায়। তবে আমি আর্জি জানাবো তাদের যারা উনার মৃত্যুতেও রাজনীতি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তারা মানুষের কষ্ট ও শোকের মাঝেই হয়তোবা পৈশাচিক আনন্দ পায়। কি অমানুষ, পাষণ্ড তারা!
খালেদা জিয়া কেন মহিয়সী?
বাংলাদেশের রাজনীতির সমসাময়িক ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায় সাধারণ গৃহবধূ থেকে কিংবদন্তী দেশনেত্রী হয়ে উঠা বেগম খালেদা জিয়ার এক অনন্য, সার্থক জীবন ও রাজনৈতিক সংগ্রামের কাহিনী। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে একদল বিপথগামী সামরিক সদস্যের দ্বারা স্বামী জিয়াউর রহমানের নৃশংস খুনের পরে খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষা করে বড় হয়েছেন, মুখোমুখি হয়েছেন অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের। একাই সামলেছেন ঘরে ও বাহিরে। মমতাময়ী মা হিসেবে ছেলেদের বড় করেছেন, পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করেছেন। পাশাপাশি স্বামীর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি'র হাল ধরেছেন যাতে কোনভাবেই দলে বিভেদ-বিশৃঙ্খলা, বিভাগ-বিভাজন না হয়, দলে যেন একতা বজায় থাকে। সেজন্যই তিনি ঐক্যের প্রতীক। সেজন্যই তিনি দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে একজন জনপ্রিয় নেত্রী, কারণ তিনি সব নেতাকর্মীকে আপন ভাবতেন।
তিনি বলেছিলেন, "আমার এই স্বজনহীন জীবনে দেশবাসীই আমার স্বজন। আল্লাহ আমার একমাত্র ভরসা। আমি যেমন থাকি, যেখানেই থাকি, যতক্ষণ বেঁচে থাকব, দেশবাসীকে ছেড়ে যাব না।" সেজন্যই তিনি বলতে পেরেছেন, "দেশের বাহিরে আমার কোনো ঠিকানা নাই, এটাই হলো আমার ঠিকানা। এই দেশ, এই দেশের মাটি-মানুষই আমার সবকিছু।" অথচ জাতি দেখেছিলো মইনুল রোডের স্মৃতিবিজড়িত বাসা থেকে বের করে দেয়ার পরে তাঁর অঝোর কান্না। কিভাবে পারলো হাসিনা গং তাঁকে লাঞ্চিত করতে! অথচ বেগম জিয়া সবসময় ঘৃণা করতেন প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার রাজনীতি। সেজন্যই তিনি হয়ে উঠেন মহিয়সী।
কিংবদন্তী খালেদা জিয়া
সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ছাড়াও সামরিক শাসন, ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সাহসী নেতৃত্ব বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর শাসনামলে নারী শিক্ষার প্রসার এবং বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা চালুর মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলো দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অটুট রাখতে নিরলস কাজ করেছেন। খালেদা জিয়া তাঁর শাসনামলে ধর্মীয় উগ্রবাদ-জঙ্গিবাদ দমন, মাদকের মূলোৎপাটন, এসিড সন্ত্রাস রোধসহ জাতীয় বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নির্মূলে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন ও জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা কিংবা দেশের ভূখন্ড ও অখণ্ডতা রক্ষাসহ যেকোনো জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে তিনি ছিলেন অটল ও এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্য বিস্তারের যেকোনো চক্রান্তের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়াতেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের মাঝামাঝিতে তিনি ভারতের ক্ষমতাসীনদের ভিত্তি নড়ে দিয়েছিলো ফারাক্কা ইস্যুতে। ভারতীয় "র" -সহ অনেক দেশী-বিদেশী স্বার্থান্বেষী চক্র বিএনপি নেত্রীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন তখন। তাদের প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য ছিল দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলা।
আদর্শ ও ঐক্যের মূর্তপ্রতীক
জাতি দেখেছিলো কিভাবে খালেদা জিয়া ভালোবেসেছিলেন এই দেশ ও মানুষকে। সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তেও তিনি তাঁর আদর্শ থেকে এক বিন্দু বিচ্যুত হন নাই। বারবার কারাবরণ আর নানা প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি যেভাবে নিজের আদর্শে অবিচল ছিলেন, তা এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর আদর্শই বর্তমান ও আগামীর রাজনৈতিক পথচলার আলোকবর্তিকা। তিনি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকটে সমমনা ও ভিন্নমতের দলগুলোকে এক আলোচনার টেবিলে এনে সমস্যার সমাধান করতেন তিনি। গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে, বিশেষ করে নারী শিক্ষায়, তাঁর অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বেগম জিয়ার ইন্তেকালে দেশ একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেত্রীকে হারাল, যা জাতীয় জীবনে ও চব্বিশের অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকালে এক অপূরণীয় ক্ষতি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর অবদান ইতিহাস সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। বেগম জিয়ার গণতন্ত্রের লড়াই, কল্যাণধর্মী মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকে সামনে এগিয়ে নিতে সকল রাজনৈতিক দল এবং দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের একযোগে কাজ করতে হবে।
জাতির অহংকার
অপরিসীম ভালোবাসা আমাদের সবচেয়ে কঠিন সময়েও শক্তি ও প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। বাঙালী জাতি আজ একজন পথপ্রদর্শককে হারালেন যিনি দেশের গণতান্ত্রিক পথযাত্রায় অনিঃশেষ ভূমিকা রেখেছেন, যিনি নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশ ও মানুষের জন্য। আজীবন লড়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অথচ জাতি দেখেছিলো কিভাবে একটার পর একটা উদ্দেশ্য-প্রণোদিত, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় হাসিনা তাঁকে পেরেশানিতে ফেলেছিলেন ও অবৈধভাবে জেলে রেখেছিলেন। তিনি সর্বোচ্চ নিপীড়ন তথা সিস্টেমেটিক কিলিং-এর শিকার, কেননা বারবার গ্রেফতার ও কারাবরণের ফলে যথাযত চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন।
শেষ করছি বেগম জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপি'র কান্ডারি জনাব তারেক রহমানের এক উদ্ধৃতি দিয়ে: "তবুও যন্ত্রণা, একাকিত্ব ও অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকেও তিনি অদম্য সাহস, সহানুভূতি ও দেশপ্রেম সঞ্চার করেছিলেন পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাঝে। দেশের জন্য তিনি হারিয়েছেন স্বামী, হারিয়েছেন সন্তান। তাই এই দেশ, এই দেশের মানুষই ছিল তাঁর পরিবার, তাঁর সত্তা, তাঁর অস্তিত্ব। তিনি রেখে গেছেন জনসেবা, ত্যাগ ও সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিক্রমায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।"

লেখক: জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিক ও বগুড়া মিডিয়া অ্যান্ড কালচারাল সোসাইটি-ঢাকা'র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
বিভি/এজেড




মন্তব্য করুন: