• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

কোভিড-উত্তর শিক্ষা কার্যক্রমঃ তিন অধ্যাপকের মূল্যায়ন

প্রকাশিত: ১৯:০৫, ২১ অক্টোবর ২০২১

আপডেট: ২১:৪৭, ২১ অক্টোবর ২০২১

ফন্ট সাইজ
কোভিড-উত্তর শিক্ষা কার্যক্রমঃ তিন অধ্যাপকের মূল্যায়ন

দীর্ঘ ১৮ মাস পর স্বাভাবিক হতে চলেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। বেশক'টি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে খুলেছে। কোথাও কোথাও সশরীরে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার তারিখ ঘোষণা হয়েছে। তবে দীর্ঘ করোনাকালে শিক্ষা ব্যবস্থায় নানান চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার পথ বাতলেছেন তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক।

বিভিনিউজ২৪.কম-এর পাঠকদের জন্য পরামর্শগুলো উপস্থাপন করা হলো।


ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্লেন্ডেড পদ্ধতি এবং শিক্ষা ভাতা সংযুক্ত হতে পারে

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার 
অধ্যাপক ও পরিচালক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সর্বপ্রথম অনলাইনে ক্লাস এবং পরে একটি প্রশংসনীয় পরীক্ষা পদ্ধতিতে কয়েকটি শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা সমাপ্ত করায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। তবে করোনা এখনও পুরোপুরি নির্মূল হয়নি, আছে ডেঙ্গুর আতংকও। উপরন্তু, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সবুজ গাছগাছড়ায় আচ্ছাদিত হওয়ায় মশা এবং কীটপতঙ্গের আধিক্য এখানে বেশি। তাই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব একটু ভিন্ন। ২১ অক্টোবর থেকে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে এবং কোন্ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আগে প্রবেশ করবেন, সেই বিষয়ে একটি রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী ১১ অক্টোবর হল খোলার দিন থেকেই ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে।

এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ ওয়াশেবল মাস্ক, হ্যান্ড-স্যানিটাইজার, অক্সিমিটার, অ্যাম্বুলেন্স, আইসোলেশন সেন্টার ইত্যাদি স্থাপন করা হয়েছে। প্রস্তুত আছে শক্তিশালী কোভিড-১৯ প্রতিরোধ কমিটি, হলের প্রভোস্ট, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, ডিরেক্টর ও ডিন মহোদয়ের সমন্বয়ে মনিটরিং কমিটি, প্রক্টরিয়াল বডির টহল, টিএসসি’র তত্ত্বাবধানে মনোবিজ্ঞানীদের পরামর্শ সেবা। কেউ আক্রান্ত হলেই আইসোলেশনে পাঠানো হবে এবং প্রয়োজনে ব্লেন্ডেড পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলবে। গত ১৯ মাসের অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিভিন্ন ধরনের ছুটি কমিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস নিতে হবে। আর্থিক সংকট মোচনে কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ফি এবং হলের বকেয়া মওকুফ করেছে। প্রয়োজনে সবার জন্য শিক্ষা সহায়ক প্রণোদনা বা বৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারে। শিক্ষার্থীদেরও আগের চেয়ে বেশি লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে হবে। তাই আপাতত সব ধরনের রাজনীতি ও সভা-মিছিল-মিটিং থেকে বিরত থেকে দ্রুততম সময়ে লেখাপড়া শেষ করতে হবে। সর্বোপরি, এতো ভোগান্তির পর যে ক্লাসের দরজা খুলেছে, আমাদের কোনো অসাবধানতায় যেন আবার তা বন্ধ হয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবাইকে।

মূল্যায়ন উপকরণগুলো যেন অনলাইন এবং অফলাইনে মূল্যায়ন করা যায়

ড. মোস্তফা কামাল নাসির
অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, কম্পিউটার বিজ্ঞান অ্যান্ড প্রকৌশল বিভাগ।
সাবেক ডিন, ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

    
করোনা'র সংক্রমণ শিক্ষাক্ষেত্রে যেভাবে আঘাত হেনেছে, তা মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত বা প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম ছিলাম না। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় বন্ধ থাকায় যে দীর্ঘ সেশনজট তৈরি হয়েছে, তা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের উপর পাঠ্যক্রম ঠিক রাখতে বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে। তাই সুনির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি এবং পরীক্ষাসূচি তৈরি করে তা পরিপালন করতে সচেষ্ট থাকতে হবে। 

এখন সময় হলো সবার জন্য ‘শিক্ষা ও তথ্য প্রযুক্তি’ নিশ্চিত করার। সরকার তথ্য প্রযুক্তিতে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছে কিন্তু এখনও তথ্য প্রযুক্তিতে সবার জন্য সুযোগ-সুবিধা সমান নয়। একুশ শতকের পরের পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং এসডিজি'র লক্ষ্য অর্জনে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তথ্য প্রযুক্তির বিভিন্ন উপকরণের ব্যবহার নিশ্চিত এবং সহজলভ্য করতে হবে। 

একথা অনস্বীকার্য যে, করোনা অতিমারির পর সামনের দিনগুলোতে অনেক বিষয়ে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। আমরা অনলাইন ক্লাস এবং পরীক্ষা কার্যক্রমের জন্য বিভিন্ন উপকরণ যেমন জুম, গুগল ক্লাসরুম, গুগলমিট ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছি। আমাদের উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে অনলাইন এবং প্রচলিত পদ্ধতির ঠিক সমন্বয় করতে হবে। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষতা এবং দ্রুততার সংগে পরিচালনার জন্য লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়নের উপকরণগুলো এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে, যাতে যে কোনো সময় অনলাইন, এমনকি অফলাইনে মূল্যায়ন করা যায়। করোনা-উত্তর উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কার্যক্রমসমূহ অ্যাক্রিডেশন কাউন্সিল কর্তৃক অ্যাক্রেডিট করার জন্য আউটকাম বেজড শিক্ষা চালু করতে হবে।

সব শেষে, দীর্ঘ লকডাউনের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারিদের টিকা প্রদানসহ ক্যাম্পাসে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে।

উচ্চশিক্ষার ব্লেন্ডেড লার্নিংই হতে পারে টেকসই ও নিরাপদ পদ্ধতি

অধ্যাপক ড. মো. আকতারুজ্জামান
পরিচালক, ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। 

আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং ইন্টারনেটের স্বল্পগতির প্রেক্ষাপটে কোভিড-উত্তর শিক্ষাব্যবস্থা অনলাইন বা ফেস-টু-ফেস নয়, বরং স্মার্ট পদ্ধতিতে ব্লেন্ডেড হতে পারে। গত দেড় বছরে আমরা অনেক কিছু শিখেছি, বুঝেছি। কোভিড-১৯-এর আবির্ভাবের কারণে আমরা অল্প সময়ের মধ্যে ব্লেন্ডেড এবং অনলাইন শিক্ষায় অনেক উন্নতি করেছি, যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়তো ৫-১০ বছর লাগতে পারতো। এখন আমাদের কাজ হলো কীভাবে এটাকে আরও এগিয়ে নেওয়া যায়।

ব্লেন্ডেড লার্নিং এখন একটা বাস্তবতা, যেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিভিন্ন উপায়ে এটা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যেমন, ক্লাস শিডিউল এমনভাবে করা যেতে পারে, যেন একটি সেকশনের শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে ২-৩ দিন ফেস-টু-ফেস পদ্ধতিতে ল্যাবনির্ভর ক্লাসগুলো এবং বাকি ২-৩ দিন অনলাইনে তত্ত্বীয় ক্লাসগুলো করতে পারে। শিক্ষকদের জন্য চার দিন ফেস-টু-ফেস এবং একদিন অনলাইনে কাজ করার অপশন থাকতে পারে। সামষ্টিক মূল্যায়ন (ফাইনাল পরীক্ষা) ব্যতীত অন্য সব ধরনের ধারাবাহিক মূল্যায়ন যেমন- কুইজ, প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট, এমনকি মধ্যবর্তী পরীক্ষা অনলাইনে হতে পারে। এই পদ্ধতিতে অনেক সময় এবং স্থান বাঁচবে, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে যানজট, ক্লাসরুমের অভাব এবং অন্য সমস্যা নিত্যদিনের সংগী। শিক্ষকরা এই সময়কে গবেষণা, উদ্ভাবন কাজের জন্য ব্যবহার করতে পারেন এবং শিক্ষার্থীরা  গবেষণায়, বাড়িতে পড়াশোনা অথবা খণ্ডকালীন কাজ বা টিউশনিতে যুক্ত হতে পারে। 

জাতীয় ব্লেন্ডেড লার্নিং পলিসি ২০২১ অনুযায়ী প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টার এবং লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম থাকতে পারে; যার উদ্দেশ্য হলো, জবাবদিহিতা এবং পেশাদারিত্ব বিকাশের মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নীত করা। আমাদের কাজ হলো নীতিগুলো প্র্যাকটিস করা এবং বৈশ্বিক শিক্ষাব্যাবস্থার সংগে তাল মিলিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক এবং জাতীয়ভাবে সেগুলো শক্তিশালী করা, যাতে ভবিষ্যতে দুর্যোগকালে আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে বসে থাকতে না হয়।

মূল্যায়ন সংগ্রহ ও গ্রন্থণাঃ মাহবুব আলম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি

বিভি/রিসি/এসডি

মন্তব্য করুন: