দেশকে জোর করে শ্রীলঙ্কা বানাচ্ছেন কারা, কেন ?

দেশের রিজার্ভ তিন বছর আগেও বর্তমানের চেয়ে তিন বিলিয়ন ডলার কম ছিল। ১৩ সালে এই রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫ বিলিয়ন ডলার। করোনা কালে আমদানি প্রায় বন্ধের দরুন এটি প্রথম চল্লিশের ঘর পেরিয়ে যায়। চল্লিশ থেকে ত্রিশের ঘরে আসতেই কয়েকটি মহলে রব উঠলো দেশ শ্রীলঙ্কা হলো বলে। আচ্ছা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিরোধী রাজনৈতিকরা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সরকারকে এক হাত নেয়ার চেষ্টা করবে, তাতে অবশ্য আমি দোষের কিছু দেখি না। তবে রিজার্ভ, জ্বালানী মজুদ নিয়ে এক সঙ্গে অনেকগুলো প্রধান গণমাধ্যমের ভুল রিপোর্ট দেখে মনে হলো - এবারকি গণমাধ্যমের উপর গুজব ভর করলো নাকি? এই কয়েক বছর আগে আমাদের রিজার্ভ বিশ বিলিয়ন ডলারের নীচে ছিল। ৪৬ বিলিয়নে উঠার পর এখন চল্লিশের নীচে। তাই বলে 'বেল আউট' ঘোষনার মত পরিস্থিতি হয়নি।
কিন্তু গণমাধ্যমে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সাথে অর্থমন্ত্রীর বৈঠক আর বাজেট সহায়তা ঋণ চাওয়ার ঘটনাকে শ্রীলঙ্কার মত' বেল আউট'ই বলে দিল। অথচ ছয় থেকে নয় মাসের খাদ্য কেনার রিজার্ভ রয়েছে। উৎপাদন পরিস্থিতির অবস্থা বিবেচনায় যেখানে আমাদের খাদ্য আমদানি না করাতে লাগার সম্ভাবনাই বেশী। শুধু তাই নয়, আমাদের বর্তমান সক্ষমতাতেই আগামী পাচ মাসের মোট আমদানি ব্যায় মেটানোর সক্ষমতা রয়েছে। এ বিষয়ে সরকার গণমাধ্যমকে খোদ আইএমএফের সফররত প্রতিনিধি দলের সাথে কথা বলার চ্যালেঞ্জ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করেছে।
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখন আর তেমন কারো অজানা নেই। বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যে ইউরোপ- আমেরিকাসহ সারা বিশ্বেই টালমাটাল। বিশেষ করে মূল্যস্ফিতি তথা নিত্যপণ্যের উর্ধগতিতে সীমিত আয়ের সব দেশেরই অবস্থা বেশ খারাপ। দেশেও সরকারের আপ্রান চেষ্টার পরও মূল্যস্ফিতি বাড়ছে। জ্বালানী, খাদ্য, সার সবক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রভাবে মূল্যস্ফিতি এত বেশী যে ধনী দোশগুলো সাশ্রয়ের নীতি নিয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে আমদানী নির্ভর জ্বালানী তেলে সরকারের ভর্তুকি বেড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যুদ্ধ কবে শেষ হবে কেউ জানে না। বিশেষজ্ঞদের পারসেপসনও নেতিবাচক। এই পরিস্থিতির সরকার স্বীকার করে নিয়ে প্রাথমিক ভাবে জ্বালানী সাশ্রয়ের কথা বলছে। সরকারী পড়যায়ে জ্বালানী সাশ্রয়ে সরকারি অফিস আদালতে জ্বালানী সাশ্রয়ের বিভিন্ন নিয়ম করা হচ্ছে। সাধারন মানুষকেও আহবান জানানো হচ্ছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রেখে জ্বালানী সাশ্রয়ের সিদ্ধান্ত এসেছে। ফলশ্রুতিতে ফিরে এসেছে লোডশেডিং। এই রেশনিং পদ্ধতি নিয়ে সমস্যা মানুষের আরো প্রকট হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের পর বিদ্যুতের সুবিধার বাস্তবতায় দেশের অনেক অঞ্চলের মানুষের প্রথম লোডশেডিং এর অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে সামনে রেখে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দূর্বলতার কারন অনুসন্ধানে নেমেছে। তবে বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনার বাইরে গিয়ে সরকারের পছন্দদের বিনাটেন্ডারে তথা আনসলিসিটেট বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেয়া, উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার দ্বিগুনে নিয়ে গিয়ে ব্যায় বাড়ানো বা সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বেশী নেয়া হচ্ছে কি না? যেখানে খরচ বেশী। এমন কি সর্বশেষ(২০১৮ সালের দিকে) অপ্রয়োজনীয় ভাবে এতগুলো অনসলিসিটেড ব্যায়বহুল ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কেন দেয়া হলো, আমদানি নির্ভরতা কমাতে কেন দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত জোর দেয়া হচ্ছে না, বিদেশীদের পরিত্যাক্ত কেন্দ্রে বাপেক্সের সফল গ্যাস উত্তোলনের পরও কেন বাপেক্সকে শক্তিশালী করা হচ্ছে না। এসব নিয়ে কোন অনুসন্ধান নেই। বরং ভারত থেকে আদানির যেই বিদ্যুৎ আনার লাইনই এখনো হয়নি, সেখানে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেয়ার ভুল রিপোর্ট করে বসলো ডয়েসেভেলে। ৫২ শতাংশ বিদ্যুৎ দিচ্ছে যে বেসরকারি খাত তারা নাকি বিদ্যুৎ না দিয়েই লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে গেছে,... এমন সব ভুল রিপোর্ট করে বসলো সরকার সমর্থক বলে পরিচিত সমকালের মত পত্রিকাও। যার ফলশ্রুতিতে মনে হচ্ছে- লোডশেডিং নিয়ে আপাতত সরকারের সাশ্রয়ী নীতির সঠিকতাই প্রতিষ্ঠা পেল।
এই পরিস্থিতিতে জ্বালানী তেলের মজুদ নিয়েও দেশের গণমাধ্যমে ঘটে গেল আরেক তেলেসমতি। শ্রীলঙ্কার ঘটনার আতঙ্ক যেন ভর করলো দেশের অনেকগুলো প্রধান গণমাধ্যমের উপর। বিরোধী পক্ষ কাওরানবাজারের সুশীলরা থেকে শুরু করে বাম্পার ফলনের সমর্থক অনেক পত্রিকা পর্যন্ত যোগ দিল এই তেলেসমতি গুজবে। আবিষ্কার করে ফেললো শ্রীলঙ্কা হতে মাত্র আর ৩৭ দিন বাকি। ডিজেল মজুদ আছে মাত্র এক মাস সাত দিনের। কি ভয়ংকর কথা! মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে শ্রীলঙ্কার মত অবস্থানে পৌছে যাওয়ার সম্ভাবনা! পেট্রোল-অকটেনের পরিস্থিতি নাকি আরো খারাপ। মজুদ রয়েছে ১৩ দিন আর ১৭ দিনের। অথচ দেশে ডিজেলের ধারন ক্ষমতাই হচ্ছে চল্লিশ দিনের। আগামী ছয় মাসের ডিজেল আমদানি নিশ্চিত করা রয়েছে। আর পেট্রোল তো আমদানিই করা হয়না। গ্যাস ক্ষেত্রের উপজাত রিফাইন করেই পেট্রোলে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশেই চাহিদার চেয়ে বেশী রয়েছে। অবশ্য এমন ভয়ংকর ভুল রিপোর্ট এরই মধ্যে প্রধান ইংরেজি পত্রিকাটি তাদের অনলাইন থেকে উঠিয়ে নিয়েছে। তবে কিছু দিন আগের লবনের গুজবের মত জ্বালানী গুজব যদি দুই চলতো, তাহলে এই উচ্চমূল্যের বাজারে পাবলিকের কি অবস্থা হতো একবার ভাবেন। উচ্চমূল্যের বাজারে মানুষের কষ্ট বেড়েছে এটাতো সরকারও অস্বীকার করছে না। তাই বলে দেশকে জোর করে শ্রীলঙ্কা বানানো। দেশ নিয়ে এমন আত্মঘাতী আকাঙ্খী মানুষদের আপাতত বলাই যায়- "শ্রীলঙ্কা দূর অস্তঃ শ্রীলঙ্কা বহু দূর"।
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলাভিশন
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
মন্তব্য করুন: