• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

মেলায় বইয়ের নামে যেন `বই`ই প্রকাশ হয়!

মনজুরুল হক

প্রকাশিত: ১৬:৩৪, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩

আপডেট: ১৬:৩৫, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩

ফন্ট সাইজ
মেলায় বইয়ের নামে যেন `বই`ই প্রকাশ হয়!

কিছুদিন পরই শুরু হচ্ছে বইমেলা। আমি আড়ম্বরহীন মানুষ; তাই শুধু ‘বইমেলা’ লিখলাম। প্রাজ্ঞজনেরা লিখবেন-প্রাণের মেলা, অমর একুশে গ্রন্থমেলা। আঠারো কোটি মানুষের শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-সিকি শিক্ষিত, সরকারি আমলা-কর্মকর্তা, পুলিশ, উকিল-মোক্তার, প্রফেসর-মাস্টার, নেতা-নেত্রী, গায়ক-গায়ীকা, নায়ক-নায়ীকা, চেয়ারম্যান-কমিশনার থেকে শুরু করে চিটেগুড়ের দোকানদারও ‘সাহিত্যিক’ হয়ে উঠবেন। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক তো আছেনই পার্মানেন্ট স্টক হিসাবে।

 

বাংলাদেশের সাহিত্যের প্যারামিটার কি? এককথায় কবিতা। নিরেট অর্থে ছড়া বা ছন্দমাত্রিক পয়ার। বাংলাদেশে সাধারণভাবে সাহিত্য বলতে পদ্য বা ছাড়া কিংবা ছন্দ মিলিয়ে পয়ার লেখা বোঝায়। প্রাচীন যুগের চর্যাপদ, মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব কাব্য, বাউল পদাবলি, শাক্ত পদাবলি, ময়মনসিং ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা আর এক ফর্মা কাগজ আট ভাঁজ করে পয়ারের পরম্পরায় এই বাংলার সাহিত্য মূলত ছন্দমাত্রিক পদ্য বা কবিতা। দেখবেন সরকারি কোনো স্লোগান পয়ার ছাড়া হয় না! যেন সব্বাই এক একজন খনা। এখানে চ্যানেল-ট্যানেলের সাহিত্যাসরে সাহিত্যালোচনা করেন কবিগণ। বিভিন্ন খেতাব পান কবিগণ। বইমেলায় প্রায় ৮০ ভাগ প্রকাশ হয় কবিতার বই। বিক্রিবাট্টাও সেই কবিতার বইয়ের বেশি। বইয়ের প্রচ্ছদের সৌকর্য বিচারেও কবিতার বই শীর্ষে। 

সে কারণে এ জাতি কবিদের রূপংদেহী-জলংদেহী-সুধামঞ্জরী সব নামও দিয়েছে কবিদের! বিশ্বকবি, কবিগুরু, মহাকবি, বিদ্রোহী কবি, মধুকবি, পাশ্চাত্যের মিল্টন, দত্তকুলোদ্ভব কবি, কিশোর কবি, কান্ত কবি, পদাতিক কবি, রপসী কবি, পল্লী কবি, স্বভাব কবি, চারণ কবি, দুঃখ কবি, ছন্দের জাদুকর, কবিশেখর, দেহবাদী কবি, মৈথালি কবি, কবি কঙ্কন, আদি কবি, শুদ্ধতম কবি, জাতিসত্তার কবি, মুসলিম রেঁনেসার কবি, কিংবদন্তির কবি, প্রবাসী কবি, চেতনার কবি, গণমানুষের কবি, নাগরিক কবি, নৈসর্গের কবি, প্রেমের কবি, প্রকৃতির কবি, আত্মমগ্ন কবি, দ্রোহের কবি, সংবেদের কবি, কবিকুলের সেরা কবি…. আরও কত কত প্রিয় নাম প্রিয় উপাধি।

অথচ উপন্যাসিক, গল্পকার, কথাসাহিত্যিকদের বেলায় কী কেপ্পনতা! বিদ্যাসাগর আর সাহিত্য সম্রাট। ব্যাস শেষ। ইদানিং অবশ্যি গল্প-উপন্যাস লিখতে পরলেই কথাসাহিত্যক তকমা জুটে যায়। ওই ‘শ্রদ্ধা’কে জামা পরিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধা বানানোর মত। উপন্যাসিকদেরও কালে-ভদ্রে কেউ কেউ আদর করে কালজয়ী উপন্যাসিক বলেন। গল্পকারদেরকেও খানিকটা আদুল গলায়-বিশিষ্ট গল্পকার কিংবা খ্যাতনামা উপন্যাসিক বলেন-টলেন, কিন্তু যারা রাশি রাশি রেফারেন্স বইপত্তর ঘেঁটে, দুনিয়ার অন্তর্জাল চষে, ন্যারেটিভ-কাউন্টার ন্যারেটিভ-এর দ্বন্দ্বকে একই সমান্তরালে রেখে তিন-চার বছরের গলদঘর্ম চেষ্টায় একটা প্রবন্ধ সংকলন বা ইতিহাসের কিংবা জিও পলিটিক্যাল ঘটনাবলির ইতিহাস লেখেন তাদের বই ছাপা হয় ২ শতাংশ। তাদের উপাধি—লেখক। সিম্পলি লেখক। অনাড়ম্ব, আটপৌরে, নিরাভরণ—লেখক। এদের অধিকাংশের ঘাড়ের দুপাশ দিয়ে উত্তরীয় ঝোলে না। এরা কোনো ক্যাফে আলোকিত করে বসেন না। কোনো পাঠের স্টেজে পাঠ করার মতও কিছু নেই এদের। এদের মধ্যে যারা ক্ষমতাসীনদের ছায়া অনুসরণ করে হাঁটেন তাদের অবশ্যি তকমা টকমা জোটে। কারো কারো পুরস্কারও মিলে যায়।

আমার যাপিত জীবনে বেশ কয়েকজন গুণি লেখক-গবেষকের সাক্ষাত জুটেছিল। তাদের মধ্যে সবার আগে আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, নাজমা জেসমিন চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ, সরদার ফজলুল করিম, বোরহান উদ্দীন খান জাহঙ্গীর, শওকত আলী প্রমুখ। এঁদের মধ্যে নাজমা জেসমিন ছিলেন সবচেয়ে নির্মোহ ও স্পষ্টবাক। তিনি বলতেন—এই অঞ্চলের বাঙালির পরম্পরা পূর্ববঙ্গ গীতিকা আর মঙ্গলকাব্য। এরা তা থেকে আজও বেরুতে পারেনি। বদরুদ্দীন উমর আক্ষেপ করে বলেছিলেন—মেলায় বইয়ের নামে রাশি রাশি আবর্জনা প্রকাশ হয়। এর মধ্যে পড়ার মত বই কোথায়? আর আজাদ? তিনি মুখ বাঁকা করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলেন—এই সমস্ত কবিরা যদি কবিতা না লিখে টেম্পো চালাত, দেশের কাজে লাগত (যদিও তিনি ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’, ‘নারী’ লিখে বিখ্যাত হওয়ার আগে মূলত কবিই ছিলেন)! 

সংযুক্তি: আমাকে দিয়ে কবিতা হয় না। চেষ্টা করে দেখেছি; হয় না। যেহেতু হয় না, তাই হয়ত কবিদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে এতসব বললাম। আপনারা এসব বক্র কথাবার্তায় পিছুপা হবেন না। বিপুল উদ্যোমে কাব্যচর্চা হোক। হতেই থাকুক। কাব্য দিয়েই আমাদের সাহিত্যাকাশে তীব্র শক্তির হ্যালোজেন বাল্বের মত আলোকিত হবে। হবেই। 

ইতিহাসের টিপস: একবার ভারতীয় সাহিত্য সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হলেন বাট্রান্ড রাসেল। তাঁর বিমান দিল্লির পালাম এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলে তিনি ধীরে-সুস্থে ল্যান্ডিঙে বেরিয়ে অবিভূত! হাজার হাজার মানুষ ফুলের মালা নিয়ে উল্লাস করছে! তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন; কিন্তু কেউ তার দিকে এগিয়ে আসছে না দেখে অবাক হলেন! নিচে নেমে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন চিকণ গোঁফের একজন রাশান টুপি পরে নামছেন….সবার নজর তার দিকে। অবশেষে দুজন সাহিত্য পর্ষদের প্রতিনিধি তাঁর কাছে এসে অভিবাদন জানালেন-‘আমরা আপনাকে রিসিভ করতে এসেছি স্যার’। রাসেল বিস্মিত প্রশ্ন করলেন-উনি কে? একজন উত্তর দিলেন-রাজ কাপুর। ‘বলিউডের অভিনেতা। মস্কোতে ‘মেরা নাম জোকার’-এর রাজসিক প্রদর্শনী শেষে দেশে ফিরলেন’।

২৮ জানুয়ারি, ২০২৩
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার  বাংলাভিশন নিবে না।)

মন্তব্য করুন: