• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ইউক্রেন যুদ্ধ এখন রাশিয়া-ন্যাটো যুদ্ধের প্রক্সি যুদ্ধ

মনজুরুল হক

প্রকাশিত: ০০:১৫, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ফন্ট সাইজ
ইউক্রেন যুদ্ধ এখন রাশিয়া-ন্যাটো যুদ্ধের প্রক্সি যুদ্ধ

সংগৃহীত ছবি

ইউক্রেনের সংঘাত এখন পর্যন্ত রাশিয়া এবং ন্যাটোর মধ্যে একটি প্রক্সি যুদ্ধ। পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান সংঘাতে যোগদান এবং রাশিয়াকে কৌশলগতভাবে পরাজিত করার লক্ষ্য রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী এবং পশ্চিমা সামরিক ইউনিটগুলির মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটা ঘটলে ইউক্রেনের সংঘাত রাশিয়া-ন্যাটো যুদ্ধে পরিণত হবে। এমন পরিস্থিতি অনিবার্যভাবে পারমাণবিক ঝুঁকি সামনে চলে আসে। ইদিানিং যে আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক ব্লককে সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর জন্য প্ররোচিত করছে! এমনকি যদি মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো যায় তার পরও রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমের সামগ্রিক শত্রুতা বাড়তে থাকবে। রাশিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও অবনতি হতে থাকবে।

 

পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে এবং একে তারা সরাসরি হুমকি হিসাবে দেখছে এবং তাদের নিজস্ব ব্লকের অভ্যন্তরীণ সংহতি বাড়াতে এই রাশান হুমকিকে ব্যবহার করছে। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে, ইউরোপীয় নিরাপত্তা আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং পররাষ্ট্রনীতির একটি মন্ত্র। কিন্তু এখন, পশ্চিম ইউরোপীয়রা কলম ছেড়ে দিয়ে তলোয়ার হাতে নিয়েছে – আরও স্পষ্টভাবে বললে আর্টিলারি সিস্টেম হাতে তুলে নিয়েছে। যেন পয়েন্ট অব নো রিটার্ণ।

ইউক্রেন বর্তমানে রাশিয়া এবং পশ্চিমের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র, শুধু তাই নয়, সংঘর্ষের অগ্রভাগে রয়েছে উত্তরে বেলারুশ, কালিনিনগ্রাদ এবং বাল্টিক হয়ে আর্কটিক পর্যন্ত এবং দক্ষিণে মোল্দোভা, কৃষ্ণ সাগর, ট্রান্সককেশিয়া, কাজাখস্তান এবং মধ্য এশিয়ার মধ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। ২০২৩ সালে বিশেষ গুরুত্বের মধ্যে রয়েছে কাজাখস্তান এবং আর্মেনিয়া, যেখানে পশ্চিমারা সক্রিয়ভাবে রাশিয়া-বিরোধী জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সমর্থন করছে এবং মোল্দোভা এবং জর্জিয়া, যেখানে ইউক্রেনীয় ছাড়াও অন্য একটি দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার জন্য পুরানো বিরোধ পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে।

রাশিয়া-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সংলাপ দীর্ঘদিন ধরে একটি হাইব্রিড যুদ্ধে পর্যবেশিত হয়েছে। যদিও ইউক্রেন শুধুমাত্র একটি দিক, অন্য লক্ষণীয় দিকটি হলো ওয়াশিংটনের লক্ষ্য সক্রিয়ভাবে তার বিশ্বব্যাপী আধিপত্য দেখানো এবং এই লক্ষ্যে গুরুতর ও ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিতেও পিছু-পা না হওয়া। মার্কিনীদের হালের যুদ্ধ বিস্তারের নিদর্শন সেসবের ঈঙ্গিত দিচ্ছে। 

দিমিত্রি ট্রেনিন-এর ওই ভবিষ্যদ্বানীর প্রতিধ্বণি করেছেন সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ। তিনি কয়েকদিন আগে নতুন মার্কিন-বিরোধী সামরিক জোট গঠনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন— ইউক্রেন সংকট ওয়াশিংটনের প্রতি বিরক্ত এবং কিক্ষুব্ধ দেশগুলোর একটি ব্লক গঠনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যেটা হওয়া উচিৎ এবং যত দ্রুত সম্ভব।
 
কিয়েভকে ক্রমাগত সামরিক সাহায্য প্রবাহ স্পষ্টভাবে দেখায় যে সম্মিলিত পশ্চিমা শক্তি রাশিয়াকে ধ্বংস করতে চাইছে। তবে এই প্রচেষ্টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের জন্য শেষ পর্যন্ত ব্যাকফায়ার হতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

মেদভেদেভ লিখেছেন—রামস্টেইনের বৈঠক এবং কিয়েভকে ভারী অস্ত্র বরাদ্দ করায় সন্দেহ নেই যে আমাদের শত্রুরা খুব শিগগিরই আমাদের নিকেশ করার চেষ্টা করবে। ইউক্রেনের শত্রুতা দীর্ঘায়িত হওয়া শেষ পর্যন্ত একটি নতুন সামরিক ব্লকের উত্থানের দিকে নিয়ে যেতে পারে যা আমেরিকানদের প্রতি বিরক্ত জাতিগুলোকে একত্রিত করবে। দীর্ঘ যুদ্ধের সময় মানবজাতির ইতিহাসে সর্বদাই এমনটি ঘটেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে পুরানো ইউরোপ এবং দুর্ভাগা ইউক্রেনীয়দের যা অবশিষ্ট আছে তাও শেষ করে দেবে। এবং বিশ্ব আবার ভারসাম্যের দিকে ফিরে আসবে। 

মস্কো বারবার সম্মিলিত পশ্চিমকে অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনকে পাম্পিং বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। এই শীর্ষস্থানীয় রাশিয়ান কর্মকর্তারা বারবার ইউক্রেনের সাথে সংঘাতের পরিবর্তে রাশিয়া এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধ হিসাবে কী ঘটছে তার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আসছেন। এবং এখন পর্যন্ত যুদ্ধ নিয়ে মেদভেদেভ যতগুলো ভবিষ্যদ্বানী করেছেন, যে যে পয়েন্টে সাবধানবানী দিয়েছেন, তার সবগুলো ফলে গেছে। সুতরাং এটা এখন প্রায় নিশ্চিত যে মেদভেদেভ যা দেখতে পাচ্ছেন সেটাই অন্যেরা দুদিন বা এক সপ্তাহ পরে দেখতে পাবেন।

 ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমারাও দ্বিধাগ্রস্ত:
মেদভেদেভ যখন পশ্চিমা যুদ্ধ শক্তিকে প্রতিহত করবার জন্য দ্রুত এন্টি-আমেরিকান নতুন ব্লক সৃষ্টির জন্য তাগাদা দিচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে শীর্ষ মার্কিন জেনারেল মার্ক মিলি মন্তব্য করেছেন— রাশিয়ার সাথে লড়াই করা ইউক্রেনের জন্য খুব, খুব কঠিন যদিও কিয়েভ এখন রাশিয়ার ভূখণ্ডের বিশাল অংশ দখল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মিত্রদের খুশি করতে, অথচ বাস্তবতা হচ্ছে মস্কোর বাহিনী একাধিক মূল যুদ্ধে জয়লাভ করেছে।

ইউক্রেন তার প্রাক্তন ভূখণ্ড থেকে রাশিয়ান বাহিনীকে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে লড়াই করবে, এটা তাদের দাতা দেশগুলোকে খুশি করারই চেষ্টা মাত্র। ওদিকে ওয়াশিংটনের বেসামরিক কর্মকর্তারা যখন জোর দিচ্ছেন যে কিয়েভকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে মিলি বারবার যুদ্ধের সাফল্যের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কারণ তিনি ইউক্রেনকে দেওয়া অস্ত্র সাহায্যের কোনো ইতিবাচক ফলাফল দেখছেন না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই গত ফেব্রুয়ারি থেকে কিয়েভকে ১১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে। ইউক্রেনকে পদাতিক যুদ্ধের সরঞ্জাম থেকে শুরু করে এন্টি-এয়ার সিস্টেম এবং এক মিলিয়নেরও বেশি আর্টিলারি শেল সহ ক্রমান্বয়ে ভারী অস্ত্র দিয়েছে। এর ফলে ইউক্রেনের ন্যাটো-প্রশিক্ষিত সৈন্যরা পশ্চিমা-পরিকল্পিত প্রধান যুদ্ধ ট্যাঙ্কগুলি ব্যবহারের মত সামরিক সক্ষমতাও লাভ করেছে। তার পরও সোলেদার এবং ক্লেসচেভকার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ডনবাস বসতি দুটোই মস্কোর সৈন্যদের দখলে চলে গেছে এবং আর্টিওমভস্কের মূল শহরটি এখন রাশিয়ান ঘেরাওয়ের পর দখল হয়ে গেছে।
ক্রিমিয়াসহ চারটি হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করার ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেনস্কির দাবি কতটা সত্যি নিশ্চত হওয়া যায়নি। 

 রাশিয়া এবং পশ্চিমা 'সত্যিকারের যুদ্ধের' দ্বারপ্রান্তে – ল্যাভরভ:
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন—ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে রাশিয়া এবং পশ্চিমের মধ্যে সংঘাতকে আর ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ বলা যায় না বরং এটা একটি বাস্তবে বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধটাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। পশ্চিমা শক্তিগুলো রাশিয়ান ভাষা থেকে শুরু করে শতাব্দী ধরে ইউক্রেনে বিদ্যমান সংস্কৃতি পর্যন্ত সবকিছু ধ্বংস করতে চাইছে, এমনকি লোকেদের তাদের মাতৃভাষা বলতেও নিষেধ করছে। ইউক্রেনজুড়ে এই ঘৃণ্য কাজগুলো সাধারণ হয়ে উঠেছে এবং দেশটির শেষ দুই রাষ্ট্রপতি, পিওত্র পোরোশেঙ্কো এবং বর্তমান নেতা ভ্লাদিমির জেলেনস্কি, উভয়েই ক্ষমতা লাভের পরে যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রপতি এবং ‘রুশোফোবিক নেতা’ হয়ে উঠেছেন। 

 রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করবে যুক্তরাষ্ট্র:
রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক হামলার প্রেক্সাপটে এবার নতুন করে রাশিয়ার প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি ওয়াগনার গ্রুপকে অপরাধী সংগঠন হিসাবে ট্যাগ লাগাতে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সদ্য ইউক্রেনীয় বাহিনীকে বেশ কয়েকটি আকস্মিক গেরিলা যুদ্ধে হারানোর পর ওয়াগনারের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের এই সর্বশেষ পদক্ষেপ। 

ওয়াগনার গ্রুপ ২০১৭ সাল থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় রয়েছে। এই ওয়াগনার গ্রুপের বস রাশিয়ান ব্যবসায়ী ইয়েভজেনি প্রিগোজিন মার্কিন ঘোষণাকে বাতিল করে রয়টার্সকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছিলেন- ওয়াগনার মার্কিন সামরিক বাহিনীকে টার্গেট করে তুলবে এবং তাদের সম্পর্ক এখন অপরাধী গোষ্ঠীর শোডাউন হয়ে উঠবে।
২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়াগনার মূলত আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছে। ওয়াগনার যোদ্ধারা বর্তমানে ডনবাসে মোতায়েন করা হয়েছে, যেখানে তারা এই মাসের শুরুর দিকে ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাত থেকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর সোলেদারকে মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং ক্লেসচেভকা অঞ্চলও দখল করেছে। তাদের এই সাফল্য নিকটবর্তী শহর আর্টিওমভস্কে যাকে ইউক্রেনীয় ভাষায় ‘বাখমুত’ বলা হয় সেটার গ্যারিসনও এখন ওয়াগনারের দখলে।

 জার্মান গোয়েন্দারা ইউক্রেনের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে 'শঙ্কিত' - মিডিয়া
জার্মানির ফেডারেল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (বিএনডি) কিয়েভ এবং মস্কোর মধ্যে সংঘর্ষে ইউক্রেনীয় সেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির জন্য আতঙ্কিত। রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয় সৈন্যরা গত সপ্তাহে আর্টিওমভস্কের কৌশলগত ডনবাস শহর নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছিল কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি কিয়েভের জন্য বিশেষ ভালো মনে হচ্ছে না। মিডিয়া বিএনডি কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি গোপন বৈঠকের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী জার্মান এমপিরা। 

আর্টিওমভস্ক ইউক্রেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিগুলোর অন্যতম। বর্তমানে সেই শহরটিও রাশিয়ার সেনাবাহিনীর দখলে চলে গেছে। তার মানে সেখানে অবস্থানরত কয়েক হাজার ইউক্রেনীয় সৈন্য এখন অবরুদ্ধ। এটা কিয়েভের জন্য গুরুতর পরিণতি ঘটাতে যাচ্ছে। বিএনডি সতর্ক করেছে, আর্টিওমভস্কের উপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ মানেই ইউক্রেনীয়-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর অনেকগুলোই এখন টালমাটাল অবস্থা। কিয়েভে ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে আর্টিওমভস্ক শহরটি ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। ইউক্রেনীয় বাহিনীর তৈরি করা ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ এই অঞ্চল। রাশিয়া ডোনেটস্ক পিপলস রিপাবলিকের বাকি অংশের সাথে শহরটির সার্বভৌমত্ব দাবি করে গত সপ্তাহে দখল করে নিয়েছে। এর মানে হলো এখন শত চেষ্টা করেও ইউক্রেনীয় বাহিনী বা ন্যাটো প্রশিক্ষিত বাহিনী ডনবাস অঞ্চলের দিকে এক পা-ও এগুতে পারবে না।

পশ্চিমা ট্যাঙ্কগুলি ইউক্রেনে গেম চেঞ্জার?
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইউক্রেনে পশ্চিমা দেশগুলো নতুন ধরণের শক্তিশালী ট্রাঙ্কবহর পাঠাচ্ছে। এ নিয়ে অতিরঞ্জিত খবর হলো এইসব ট্যাঙ্ক নাকি ‘গেম চেঞ্জার’! আমেরিকা এবং জার্মানির Leopard 2  এবং M1 Abrams ট্যাঙ্ক হাতে পেলেই ইউক্রেন যেন রাশিয়াকে কড়া জবাব দিয়ে দিতে পারবে। সেইমত পরিকল্পনা করে যে ট্যাঙ্কবহর পাঠানো হচ্ছে তা নিয়ে রাশিয়ার মন্তব্য শোনা যাক: 

রাশিয়ার পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস সচিব দিমিত্রি পেসকভ সতর্ক করে দিয়েছেন যে এই জাতীয় সাপ্লাইয়ের গুরুত্বকে অতিরঞ্জিত করা উচিত নয়। তারা এসব দিতেই পারে, তার মানে এটা নয় যে এইসব ট্যাঙ্ক দিয়েই ইউক্রেন যুদ্ধ জয় করতে পারবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা যদি ইউক্রেনকে ভারী ট্যাঙ্ক সরবরাহ করে তবে কিয়েভের পরিণতি কেবল নেতিবাচকই হবে। এসব  রাশিয়ার সামরিক অভিযানকে প্রভাবিত করবে না।

মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ আগেই ঘোষণা করেছিল যে বৈঠকে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বার্লিনকে কিয়েভে তার Leopard 2 ট্যাঙ্ক সরবরাহ করতে রাজি করানো, অথবা অন্তত পোল্যান্ড এবং ফিনল্যান্ডের মতো অন্যান্য দেশকে তাদের নিজস্ব জার্মান তৈরি ট্যাঙ্ক সরবরাহ করার অনুমতি দেওয়া। তবে, জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াসের মতে মন্ত্রীরা এই বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন। বার্লিন দীর্ঘদিন ধরে মিত্র দেশগুলিকে কিয়েভে Leopard 2 পাঠানোর অনুমতি দিতে অনিহা প্রকাশ করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথমে নিজস্ব Abrams ট্যাঙ্ক পাঠানোর জন্য অপেক্ষা করছে। ব্যাপারটা এমন যে আগে আমেরিকা দিক, তারপর আমরা দেব।  

রাশিয়া বারবার জোর দিয়ে বলেছে যে ইউক্রেনে পাঠানো যে কোনো অস্ত্র শুধুমাত্র সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করবে এবং অপ্রয়োজনীয় রক্তপাত ঘটাবে। ট্যাঙ্কগুলো যদি  ইউক্রেনে পৌঁছে দেওয়া হয় তবে তাদের পরিনতি হবে পশ্চিমাদের পাঠানো আগের অস্ত্রগুলোর মত, যা শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার দখলে চলে আসবে, তা না হলে আগেরগুলোর মত জ্বলতে থাকবে।

ইউক্রেন পারমাণবিক কেন্দ্রে অস্ত্র মজুত করছে: 
মস্কোর বিদেশী গোয়েন্দা প্রধান বলেছেন কিয়েভ পশ্চিমা তৈরি অস্ত্রশস্ত্রের মজুদ আসলে কভার হিসাবে ব্যবহার করছে। মূল লক্ষ্য পারমানবিক অস্ত্রের মজুদ। ইউক্রেনের বাহিনী পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পশ্চিমাদের পাঠানো ক্ষেপণাস্ত্র এবং কামানের গোলা মজুত করছে। এমন বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে যে ইউক্রেনীয় সেনারা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভূখণ্ডে পশ্চিমাদের পাঠানো অস্ত্র এবং গোলাবারুদ মজুদ করছে। অস্ত্রগুলোর মধ্যে মার্কিন তৈরি HIMARS লঞ্চারগুলোর জন্য রকেট এবং বিদেশী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি বড় ক্যালিবার আর্টিলারি শেল রয়েছে।

শুধুমাত্র ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পশ্চিম ইউক্রেনের রোভনো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মারাত্মক বিপজ্জনক কার্গো বোঝাই বেশ কয়েকটি গাড়ি রেলপথে পাঠানো হয়েছিল। 

জেলেনস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠির জন্য ইউক্রেন খুলে দিয়েছেন:
ইউক্রেন ইতিমধ্যেই অর্থ ও সামরিক শিল্পের কিছু জায়ান্টের সাথে কাজ করছে, ইউক্রেনে কাজ করতে আগ্রহী যে কোনও আমেরিকান কোম্পানিকে বড় ব্যবসার সুযোগ দিচ্ছে ভ্লাদিমির জেলেনস্কি। তিনি বেশ গর্ব করেই বলেছেন-এতে করে ইউক্রেনের অর্থনীতি মজবুত হবে এবং ইউক্রেন দেশেই অত্যাধুনিক অস্ত্রভাণ্ডার পেয়ে যাবে।

জেলেনস্কি ইতিমধ্যেই ব্ল্যাকরক, জেপি মরগান এবং গোল্ডম্যান শ্যাক্সের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক ও বিনিয়োগ জগতের জায়ান্টদের সাথে সহযোগিতা শুরু করেছে। স্টারলিঙ্ক বা ওয়েস্টিংহাউসের মতো আমেরিকান ব্র্যান্ডগুলো ইতিমধ্যে ইউক্রেনের অংশীদার হয়ে উঠেছে। এবার অনেক পুরোনো একটা অংকের হিসাব মিলবে হয়ত। অনেকেই প্রশ্ন করেন-আমেরিকা কোন স্বার্থে ইউক্রেনের বালিতে বিলিয়ান বিলিয়ান ডলার ঢালছে, যা মুহূর্তে শুষে নিচ্ছে বালি? সেই প্রশ্নের উত্তর হলো আমেরিকা বিনা লাভে তুলোও বয়ে নেয় না। আমেরিকার এই জায়ান্ট কোম্পানিগুলো ইউক্রেনের যুদ্ধ দেখতে যাচ্ছে না। যাচ্ছে ইউক্রেনের লাগামহীন বেকারত্বর সুযোগ নিয়ে সস্তা শ্রমে অস্ত্র উৎপাদন করতে। হিসাব বরাবর। দেব আর নেব। কতটুকু দেব আর কতটুকু দেব সেটা আমাদের বিজনেস, নট ইয়োর কনসার্ণ।

রাশিয়া ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের যৌথ বাহিনী নিয়েও ভাবছে:
রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান আর্মি জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভ বলেছেন— ইউক্রেনের হাইব্রিড যুদ্ধের পাশাপাশি ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকি, যা মোকাবেলায় মস্কো নতুন সামরিক জেলা স্থাপন করবে এবং নতুন ইউনিট একত্রিত করবে।

রাশান ওয়ার এক্সপার্টরা বলছেন-এই মুহূর্তে মার্কিন এবং তার মিত্রদের হুমকি হল ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকে অন্তর্ভুক্ত করে ন্যাটোর সম্প্রসারণ। সেইসাথে ইউক্রেনকে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে একটি হাইব্রিড যুদ্ধ চালানোর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা। 

গেরাসিমভের মতে এই চ্যালেঞ্জগুলোর জবাবে রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর জবাব পরিষ্কার। মস্কো এবং লেনিনগ্রাদে আরও সামরিক জেলা তৈরি করা এবং খেরসন এবং জাপোরোজিয়ে অঞ্চলে তিনটি মোটর চালিত রাইফেল বিভাগ গঠন করা, যে অঞ্চলগুলো (ডোনেটস্ক এবং লুগানস্ক প্রজাতন্ত্র) গণভোটের পরে শরৎকালে রাশিয়ায় যোগদান করেছে। এছাড়াও এজেন্ডায় রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিমে এবং ফিনল্যান্ডের সীমান্তবর্তী কারেলিয়া প্রজাতন্ত্রে একটি সেনা কর্পসকে একত্রিত করা হচ্ছে। এসবই নতুন হুমকির পরে সিদ্ধান্ত নিয়ে করা হচ্ছে।
 
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাশিয়ান সামরিক বাহিনী দেশের আধুনিক ইতিহাসে এমন তীব্র শত্রুতা দেখেনি এবং মস্কো প্রায় সমগ্র সম্মিলিত পশ্চিম দ্বারা বিরোধিতায় পড়েছে। এতে করে যেটা হয়েছে, রাশিয়া নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিদিনই নতুন নতুন পরিকল্পনা করতে পারছে, এবং সেইসব পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালনা করায় রাশিয়ার ক্ষয়-ক্ষতিও কমানো গেছে।

এর মধ্যে রাশিয়াকে এখন নতুন করে এমন ভাবনাও ভাবতে হচ্ছে যে ন্যাটো যদি পূর্ণ শক্তি নিয়ে আক্রমণে নামে তাহলে তাদের পরিকল্পনা কী হবে? রাশিয়া তেমন ছক কষে রেখেছে। তার মানে এটা এখন পরিষ্কার যে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে দীর্ঘমেয়াদের যুদ্ধ হিসাবেই বিবেচনা করছে। অর্থাৎ সহসা, মানে এই ২০২৩ সালেও যুদ্ধ থেমে যাবে, রাশিয়া সৈন্য প্রত্যাহার করবে, এমন কোনো সম্ভবনা অন্তত রাশিয়ার তরফে নেই। বরং পশ্চিমা হাজার হাজার স্যাঙ্কশনে প্রথমদিকে খানিকটা পর্যুদস্ত রাশিয়া গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল, গ্যাস, কয়লা, গম, অস্ত্র এবং অন্যান্য প্রচলিত বাণিজ্য যথারীতি পূর্ণ উদ্যোমে চলেছে। এখন কোটি ডলারের প্রশ্ন হলো; মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট ইউক্রেন নামক ‘রেসের ঘোড়া’য় চড়ে আর কত দূর যেতে চাইবে বা যেতে পারবে?

(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার  বাংলাভিশন নিবে না।)

মন্তব্য করুন: