• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি-‘জুলিও কুরি’ পদক

অধ্যাপক কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দিন

প্রকাশিত: ২১:২৪, ২২ মে ২০২৩

আপডেট: ২১:৩০, ২২ মে ২০২৩

ফন্ট সাইজ
বঙ্গবন্ধুর প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি-‘জুলিও কুরি’ পদক

ছবি: ফাইল ফটো (‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক গ্রহণ করছেন বঙ্গবন্ধু)

বিশ্বের শান্তির জন্য সর্বোচ্চ পদক হলো ‘জুলিও কুরি’ পদক। বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিরাই এ পুরস্কার পেয়েছেন। বিশ্ব শান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক পান এবং এটি বিশ্ব শান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক।

বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদ–সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে এবং শান্তির পক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি ও সংগঠনকে শান্তি পদকে ভূষিত করে আসছে। জঁ ফ্রেডেরিক জুলিও কুরি ১৯৫৮ সালে মৃত্যুবরণ করলে বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাদের শান্তি পদকের নাম ১৯৫৯ সাল থেকে ‘জুলিও কুরি’ নামকরণ করে। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও এ বিরল সম্মান অর্জনকারীর মধ্যে আছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগণ্য নেতা–প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চিলির সালভেদর আলেন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, ভিয়েতনামের হো চি মিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা ও মার্টিন লুথার কিং প্রমুখ।

স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল সংগ্রামের। তিনি ছাত্র অবস্থায়ই রাজনীতি-সচেতন ছিলেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে এসে জড়িয়ে পড়েছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের একজন অতি উৎসাহী কর্মী ছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসকগোষ্ঠীর বাঙালিবিরোধী তথা গণবিরোধী ভূমিকার কারণে অবস্থান পরিবর্তন করতে দেরি করেননি। তিনি ছিলেন ন্যায়ের পক্ষে, জুলুমের বিরুদ্ধে। তার জীবন নিবেদিত ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নানামুখী তৎপরতায়। নিজের জীবনের সুখ-শান্তি হেলায় উপেক্ষা করেছেন। বাংলার মানুষের দুঃখ মোচনের লড়াইয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে ছিলেন বলেই তিনি ১৯৬৯ সালেই হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তার দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জনরায়ে তারই হওয়ার কথা পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নেতা ইয়াহিয়া খান বাঙালির হাতে শাসনক্ষমতা অর্পণ না করে চাপিয়ে দেয় এক বর্বর যুদ্ধ।

গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামী নেতা শেখ মুজিবকে বাধ্য হয়েই যুদ্ধের মোকাবিলায় ডাক দিতে হয় জনযুদ্ধের, স্বাধীনতা যুদ্ধের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায় প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অকৃত্রিম বন্ধুর মতো বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষের পক্ষে দাঁড়ান। বাংলাদেশ পায় সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কারাগারে বন্দি থেকেও হয়ে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা। তার নামেই চলে ৯ মাসের অসম সাহসী যুদ্ধ এবং তার প্রেরণাতেই ঘটে যুদ্ধজয়। বন্দি মুজিব বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়েন। তার সাহস, মনোবল এবং মানুষের প্রতি তার দরদের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বেই।

তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির টানাপড়েনে কোন দিকে যাবে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ তা নিয়ে যখন অনেকের মনেই সংশয় ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে তার রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে, তিনি সমাজতন্ত্রের পক্ষে, তিনি বিশ্ব শান্তির পক্ষে। ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ ছিল বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতি। কিন্তু যারা যুদ্ধবাজ, যারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পছন্দ করে, তাদের ব্যাপারে কোনো নমনীয়তা ছিল না বঙ্গবন্ধুর।

শান্তি আন্দোলনের প্রতি শেখ মুজিব আগ্রহী ছিলেন বরাবরই। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন কারাগারে। মুক্তি পান ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। ওই বছরই অক্টোবরে চীনে অনুষ্ঠিত হয় ‘পিস কনফারেন্স অফ দ্য এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওনস’। বঙ্গবন্ধু ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন আরও কয়েকজনের সঙ্গে। ৩৭টি দেশ থেকে আগত শান্তি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে তার কথা বলা বা মতবিনিময়ের সুযোগ হয়েছিল। তার সফর অভিজ্ঞতার কথা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন।

১৯৫৬ সালের ৫-৯ এপ্রিল স্টকহোমে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘বিশ্ব শান্তি আমার জীবনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাঁদের সঙ্গে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’
বঙ্গবন্ধুর সরকারের দৃঢ় অবস্থান ছিল কোনো সামরিক জোটে যোগ না দেয়া। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল। তাই সামরিক জোটগুলোর বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি।’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কতিপয় ফরাসি, জার্মান, অস্ট্রিয়, হাঙ্গেরিয় ও ইংরেজ নাগরিক বারব্যুস, রোলার্ট, হার্গিজ, নিকোলাই– এর নেতৃত্বে ‘ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ কারাইট’ নামে একটি যুদ্ধবিরোধী সংঘ গঠন করেন। ১৫ দফা সম্বলিত তাঁদের প্রকাশিত একটি ইশতেহারে জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস প্রমুখ স্বাক্ষর করেছিলেন। যুদ্ধের বিরোধিতার কারণে জার্মানিতে আলবার্ট আইনস্টাইনকে নানাভাবে অপদস্ত হতে হয়েছিল। বিশ দশকে ইউরোপে ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থানপর্বে ১৯২৭ সালে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবিরোধী লীগ গঠিত হয়। ত্রিশ দশকের মধ্যভাগে ফ্যাসিস্ট হিটলার–মুসোলিনি–ফ্রাঙ্কোর যুদ্ধোন্মত্ততার প্রেক্ষিতে প্যারিস, মাদ্রিদ ও ব্রাসেলস– এ বিশ্বশান্তি ও সভ্যতা রক্ষায় বেশ কয়েকটি বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তির সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। জার্মান পদানত ফ্রান্সে শত নিপীড়ন–নির্যাতনসহ জীবন ঝুঁকির বিনিময়ে বিশ্বশান্তি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব নোবেল বিজয়ী বিশিষ্ট পরমানু বিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডেরিক জুলিও কুরি যুদ্ধের বিরোধিতা করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’ গঠন করেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি বিশ্বশান্তি পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোয় বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্ব শান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের জন্য শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। বিশ্বের ১৪০ দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক প্রদান করেন এবং বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ সেদিন থেকেই বাঙালি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব।

অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’

উল্লেখ্য যে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শুধু কোনো একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডের নাগরিকবৃন্দের বঞ্চণার বিষয় ধারণায় ব্যতিব্যস্ত ছিলেন না। বিশ্ব ইতিহাসের নানামুখী নিপীড়ন–নির্যাতন বিষয়সমূহ তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণের স্রোতধারা প্রবাহমান ছিল। পরাধীনতার গ্লানিকে সংহার করে সমগ্র মানব মুক্তির আন্দোলন–সংগ্রামের প্রতি তাঁর অবিচল সমর্থন ছিল অবারিত। নির্ভীক–দৃঢ়চেতা অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে বঙ্গবন্ধু কখনো কোন সংশয়–দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতেন না। সত্যের কাঠিন্যে জীবন ঝুঁকির বিনিময়ে তিনি সকল অন্যায়–অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ন্যূনতম পিছপা হননি।বঙ্গবন্ধু শরীরী উপস্থিতি আমাদের সঙ্গে নেই। কিন্তু তার আদর্শ আছে।

ধারাবাহিকতায় তারই সুযোগ্য তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা আজ শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নয়; উন্নয়ন অগ্রগতির সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্বসমাদৃত। জাতি সংঘসহ এই ধরিত্রীর অনুন্নত–উন্নয়নশীল–উন্নত বিশ্বের সকল বঞ্চিত নাগরিকবৃন্দের পুরোধা প্রতিনিধি হিসেবে তিনি আজ বিশ্বজয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়াকে সমুদয় সূচকে উন্নীত করে বিশ্বে অগ্রভাগে নেতৃত্বের সুদৃঢ়তায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণে অন্ধকার–পরনির্ভরশীলতার পরাকাষ্ঠাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞায় বীরদর্পে এগিয়ে আপামর জনগণের ঐক্যবদ্ধতায় লালসবুজ পতাকার বাংলাদেশকে সর্বত্রই অপরাজিত রাখছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তির দিনে তার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: অধ্যাপক কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দিন

-নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলামিস্ট, পরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ, প্রকল্প পরিচালক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,জামালপুর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মাগুরা জেলা শাখার শিক্ষা ও মানব সম্পদ সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদ মাগুরা জেলা শাখার সদস্য সচিব।

বিভি/এমআর

মন্তব্য করুন: