দা দা ও আ গা মি `জা গ র ণ`

সিরাজুল আলম খান ও ফরহাদ মজহার
সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ধাঁচে তৈরি। তাঁকে বাক্সে পোরা যায় না। তাঁকে বোঝা অতো সহজ নয়। তাঁর বড় হয়ে ওঠার ইতিহাস অনেকের চেয়ে ভিন্ন। অনেকের অবাক লাগতে পারে, কিন্তু ছেলেবেলা থেকে যাঁকে তিনি আদর্শ মেনেছেন তিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। ফলে তাঁর সময়ের প্রচলিত বাম চিন্তা কিম্বা 'জাতিবাদী' চিন্তার সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের মিল সামান্যই। তাঁকে বুঝতে হলে সুভাষ চন্দ্র বসুকে বোঝা দরকার। সেটা বোঝার সহজ উপায় হচ্ছে সুভাষ বসুর নীতি: ইংরেজ ঔপনবেশিক শাসন থেকে মুক্তি গান্ধী-জিন্নাহ-নেহেরু প্রমুখের'নেগোশিয়েশানস' বা দরকষাকষি দিয়ে হয় না, হবে না। দর কষাকষিতে পাওয়া স্বাধীনতা শেষাবধি ঔপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিকতার অধিক কিছু হতে পারে না।
ঔপনিবেশিক আইন, ক্ষমতার রূপ, শাসন ও প্রশাসনিক কাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক রূপান্তরের পথই বিপ্লবী পথ। এই মোটা দাগের সত্য সুভাষের কাছ থেকে সিরাজুল আলম খান কিশোর বয়সেই বুঝেছিলেন। তবে ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীতে পার্থক্য ছিল। যে কারণে বিপ্লবী বামপন্থার গড়ে তোলা শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলনকে সিরাজুল আলম খান অতি অনায়াসেই সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পথে আনতে পেরেছিলেন। শ্রেণী চেতনার বিকাশ তিনি অস্বীকার করতেন না, কিন্তু জাতীয় মনোগাঠনিক চেতনার বিকাশ ছাড়া শ্রেণী চেতনার বিকাশকে তিনি বিমূর্ত ও কেতাবি ধারা মনে করতেন।
তরুণ সিরাজুল আলম খান শুধু তাঁর জীবনের গন্তব্য নির্ধারণ করে ক্ষান্ত থাকে নি। তাঁর রাজনীতি শুরু থকেই নিজের সম্প্রসারিত পরিবার থেকেই শুরু হয়েছিল। আমরা ভাইবোনেরা নানা ভাবে তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। আমার মামাতো ভাই খসরু গড়ে উঠেছিল তাঁর ঘনিষ্ট সহচর ও দুঃসাহসী যোদ্ধা হিশাবে। নানা কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সৈয়দ কামরুল আলম খানের (খসরু) অবদান যথাযথ স্বীকৃত হয় নি বলেই আমি মনে করি।
সুভাষ বোসের প্রভাবে সিরাজুল আলম খানও বুঝেছিলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কাছে থেকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য কোন কিছু আদায় করে নেওয়া আপোষে দেনদরবার করে হবে না। এটা বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান তিনি কৈশোর থেকে তারুণ্যে উত্তীর্ণ হবার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের ছাত্র হিশাবে অতি সহজেই বুঝেছিলেন। সে কারণে তরুণ বয়স থেকেই সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে দ্বিধা করেন নি। পেশাদার বিপ্লবী হিশাবে নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত এই সময়েই তিনি নিয়ে ছিলেন। অন্যদিকে বিপ্লবী বাম পন্থার প্রতি দুর্বলতা থাকলেও গণবিচ্ছিন্ন সামরিক লাইন সতর্ক ভাবে পরিহার করেছেন। তাঁর পথ ছিল সশস্ত্র গণ অভ্যূত্থানের পথ। কাজী আরেফ আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে তাঁর ভাষায় 'নিউক্লিয়াস' গঠনের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবর রহমানের ব্রিটিশ ওয়েস্টমিনিস্টার মডেলের পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা কায়েম ও নির্বাচনী রাজনীতির দাবিতে গড়ে ওঠা জাতীয় রাজনীতির অভ্যন্তরে থেকে কাজ করাকেই সঠিক রণকৌশল গণ্য করেছেন। কিন্তু কখনই তাকে আদর্শ হিশাবে গণ্য করেন নি। যে গণতন্ত্রের কথা তিনি বলতেন সেখানে জনগণ সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করতে পারে। 'প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র' নয়, তিনি 'অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র' কায়েম করতে চেয়েছেন। বলাবাহুল্য একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার বিরোধ এ কারণে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেটাই আমরা দেখতে পাই।
তাঁর তরুণ সময়ে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে বামপন্থিদের নেতৃত্বে থাকাটাই ছিল প্রধান তত্ত্ব এবং তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক বাস্তবতার দিক থেকে সঠিকও বটে। কিন্তু সেই নেতৃত্বের রূপ গণবিচ্ছিন্ন কায়দায় জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের রাজনীতির বাইরে সফল হতে পারে না, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। সেই সময় শ্রেণী সংগ্রাম বনাম জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সম্পর্ক নিয়ে বিপ্লবী বামপন্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তর্ক জারি ছিল। বামপন্থিরা বাংলাদেশে শ্রেণী দ্বন্দ্ব নাকি জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান তা নিয়ে তর্ক করছিলেন। সেই তর্ক গুরুত্বপূর্ণ। সিরাজুল আলম খান সেই তর্ক সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, কিন্তু জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে শ্রেণী দ্বন্দ্বকে প্রধান করতে চান নি। তিনি বিপ্লবী হলেও বিপ্লবী বামপন্থার দিকে গেলেন না। বরং জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বাস্তব লড়াই ও ব্যবহারিক রাজনীতির জায়গা থেকে তরুণদের লড়াই করতে শেখালেন। যে লড়াইয়ে বিপুল ভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করা যায় এবং জনগণের মনোগাঠনিক চেতনায় রূপান্তর ঘটানো সম্ভব সেই পথ নিলেন। রাজনীতি ছিল তাঁর ক্লাছে জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ও 'শিক্ষিত' করে তোলার ইস্কুল। সেই সময় সম্পর্কে তিনি লিখছেন:
"ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর অধীনস্থ দেশসমূহের স্বাধিকার বা স্বাধীনতা অর্জনের উদ্যোগ লক্ষণীয়। আলজেরিয়া, কিউবা, এঙ্গোলা, মোজাম্বিক, প্যালেস্টাইন, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, ভারতসহ বহু দেশ তাদের দখলদার প্রভুদের হটিয়ে নিজ নিজ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয় এবং আজো অনেকে যুদ্ধরত। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে দূরত্ব এবং বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের নিরবচ্ছিন্ন লড়াই সমূহের ঘটনা প্রবাহ এবং সমকালীন বিশ্বে স্বাধীনতা সংগ্রামরত বিভিন্ন জাতিসমূহ ও তাদের সংগ্রামী নেতৃবৃন্দ সচেতন বাঙালি তরুণ সমাজকে ভেতরে ভেতরে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত করে" (বাঙালির তৃতীয় জাগরণ) ।
'ভেতরে ভেতরে যে তরুণ উদ্দীপ্ত' -- সিরাজুল আলম খানের কাছে তারাই বাংলাদেশের আগামি রাজনৈতিক শক্তি। তিনি বই পড়ে রাজনীতি করলেন না, রাজনীতিতে সাফল্য দেখিয়ে বইয়ের তত্ত্বকে প্রশ্নবোধক করে তুললেন। তরুণদের উপনিবেশ বিরোধী 'জাতীয় চেতনা'-কে তিনি নতুন ইতিহাস সৃষ্টিতে কাজে লাগালেন। উদ্দীপিত তরুণদের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখালেন। বাঙালির জাগরণ বলতে তিনি ইতিহাসে নতুন এক জনগোষ্ঠির আবির্ভাব এবং বিশ্বসভায় নিজের স্বাতন্ত্র নিয়ে হাজির ও বিকশিত হওয়া বোঝাতেন। বাকিটুকু ইতিহাস
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করল। তৃতীয় জাগরণের বার্তা দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের আগামি ইতিহাস বিপ্লবী তরুণদের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন।
লেখক : কবি, লেখক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মী এবং পরিবেশবাদী
বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
মন্তব্য করুন: