‘পরিচয় নির্বিশেষে সকলের নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে’

গণসংহতি আন্দোলনের উদ্যোগে ‘বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন একসাথে চলতে হবে’ ও ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে হবে সংবিধান সংস্কার পরিষদের নির্বাচন’; এই দুই দাবিতে এবং ‘বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ, অধিকার ও মর্যাদার বাংলাদেশ, জনগণের বাংলাদেশ’- এই ডাককে সামনে রেখে জুলাই গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত। শুক্রবার (১ আগস্ট) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উক্ত সমাবেশ উদ্বোধন করেন গণঅভ্যুত্থানে শহীদ শাকিলের মা। এ সময় এক মিনিট নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হয়।
সমাবেশের গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি সভাপতির বক্তব্যে বলেন, বিগত ফ্যাসিবাসী আমলে বেঁচে থেকেও মরে যাওয়ার অবস্থা ছিল। আবু সাঈদ তা মেনে নেননি। জীবন দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। বিগত আওয়ামী সরকার দেশকে লুটপাট করে, ব্যাংক ফাঁকা করে দেশকে ফোকলা করে দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ৭১ সালের শহীদের ঋণ এখনো পূরণ হয় নাই। আমরা শপথ নিচ্ছি, ৭১ থেকে ২৪ এর শহীদের আমরা ধারণ করবো। এই শহীদদের ঋণ শোধে আমাদের ঐক্য দরকার নয়তো, আমরা আবার ব্যর্থ হবো। জনগণের ঐক্য প্রমাণ করেছে, ঐক্য থাকলে ফ্যাসিবাদ যেমন পালিয়েছে, তেমনি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থাকেও কবর দিতে পারবো।
তিনি আরও বলেন, যেকোন অভ্যুত্থান নতুন মানুষের জন্ম দেয়। আমরা আশাবাদী, কিন্তু আমরা দেখছি পুরোনো বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে। শহীদের পরিবারের আর্তনাদ এখনও চলছে। শহীদ আহত পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া সরকার কাজ ছিলো, কেন তারা ব্যর্থ হলেন তার জবাব সরকারকে দিতে হবে। এত বড় রাষ্ট্রযন্ত্র শহীদের তালিকা দিতে পারেন না, মর্যাদা দিতে পারেন না। ৫ আগস্টের মধ্যে আমরা জবাব চাই।
তিনি বলেন, ফ্যাসিবাসী রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল মানুষের টাকা লুট করা, ভাগ বাটোয়ারা করা, দুর্নীতি করা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে একক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। লুটপাট দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারল নতুন বন্দোবস্ত হবে না। আমাদের মধ্যে নারী, ধর্ম, জাতি ইস্যুতে বিভাজন করা হচ্ছে। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ সবাই সকলের পরিচয়ের বাইরে আমরা সবাই দেশের নাগরিক। সবার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই ৭১ থেকে ২৪ এর শহীদের প্রতি দায় পূরণ হবে। গণসংহতি আন্দোলন রাজপথ থেকে উঠে এসে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে এবং তারা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে গিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।
গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল বলেন, গণতান্ত্রিক রুপান্তরের যে লড়াই সেটা আমরা বহুবছর ধরে বলে এসেছি। আমরা জন্মলগ্ন থেকেই বলছি যে, আমরা বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি করি। ২০১৭ সালে গণসংহতির প্রধান সমন্বয়কারী জননেতা জোনায়েদ সাকী বলেছিলেন নতুন রাজনৈতিক চুক্তি, বন্দোবস্ত ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। আমরা বলেছি জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের বাইরে আমাদের আর কোন স্বার্থ নাই।
তিনি আরও বলেন, জনগণের কী দরকার, বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি কীভাবে সম্ভব তা নিয়ে কাজ করেছে, চিন্তা করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ যা চর্চা হয় তার পেছনে গণসংহতি আন্দোলন দীর্ঘদিন কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতেও জারি থাকবে।
তিনি বলেন, আমরা এমন একটা বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চাই যেখানে অধিকার আদায়ের জন্য প্রাণ দিতে হবে না, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে হবে। শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানি করতে না চাইলে এই বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হবে। এটাই হবে জুলাইয়ের সনদ, জুলাইয়ের ঘোষণা এবং তা জনগণকে সাথে নিয়ে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে করতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য ও বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, গণঅভ্যুত্থানে শ্রমিক শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বেশি জীবন দিয়েছেন এবং প্রতারিত হয়েছেন। গণঅভ্যুত্থানের অর্জনকে সফল করতে শ্রমিক, নারী, কৃষকসহ মেহনতি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আমরা দেখছি ১ দফার ঘোষক বা মাস্টামাইন্ড ইত্যাদি ইস্যুতে তর্ক বিতর্ক হচ্ছে, দেশকে বিভাজিত করা হচ্ছে। কিন্তু, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কিংবা দেশের মানুষের অধিকার নিয়ে আলোচনা হয় না। গণসংহতি আন্দোলনসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী নানানভাবে ভূমিকা রেখেছে। তাই, ক্রেডিট নিয়ে কাড়াকাড়ি না করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখার আহবান জানাচ্ছি।
গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ বলেন, সরকার আহতদের যথাযথ ব্যবস্থা করতে পারেন নাই। অথচ, গণসংহতির তাসলিমা আখতার ১১২৫ জন আহতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিপর্যয় মোকাবেলা করেছেন। এই সরকার সেই অভিজ্ঞতাকে গ্রহন করেন নাই। একজন রাজনৈতিক কর্মী, একজন সংগঠক সেটা পারলে সরকার কেন পারলো না? কারণ রাজনৈতিক অঙ্গিকার, দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে বলেই সেটা তাসলিমা আখতার পেরেছেন। সরকার সেই দায়বদ্ধতা গ্রহণ করে নাই, তাই সরকার সেটা পারেন না।
তিনি বলেন, অমুক-তমুককে দেখা যায় বিদেশ থেকে এসে দায়িত্ব নিয়েছেন, অমুক জুলাই ফাউন্ডেশনের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু, আমরা কোনো কাজ দেখি না। অথচ, চট্টগ্রামের কলি কায়েয নিরবে ২৫০+ আহত, শহীদ পরিবার নিয়ে কাজ করেছে। সরকার শহীদ এবং আহতদের মর্যাদা দিতে পারে নাই।
তিনি পুলিশের সংস্কার করার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, পুলিশ সেক্টরকে দুর্নীতিমুক্ত করতে, ঘুষমুক্ত করতে তো সংবিধান সংস্কারের সম্পর্ক নাই, তাহলে সেগুলো কেনো করা হচ্ছে না। সরকারকে কিছু বললেই তারা বলছেন নির্বাচিত সরকার বলবেন।
তিনি বলেন, এই সরকারও তথ্য গোপন করে। বিদেশ ভ্রমণ করতে কত খরচ হচ্ছে, বিদেশি কনসালটেন্টদের কত টাকায় নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে সে তথ্য আমরা পাচ্ছি না। অন্তর্বর্তী সরকারের যে দায়িত্ব পালন করার কথা সে দায়িত্বে তারা অবহেলা করছে, জনগণের আশা আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই সরকার স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে পারতো। দুনিয়ার সবচেয়ে কম বরাদ্দ হয় বাংলাদেশে। সরকার একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতো। সরকার সে কাজে ব্যর্থ।
তিনি বলেন, ২৪-এ মানুষ’ ৭১ এর মতো আবারও নেমে এসেছে। মানুষের মুক্তি ঘটে নাই। ভবিষ্যতে আবারও এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে।
রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য হাসান মারুফ রুমী বলেন, এই সরকার দেশের মানুষকে বুঝে উঠতে পারে নাই। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মজুর, মেহনতি মানুষ এই সরকারকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু, তারা দেশের মানুষকে হতাশ করেছে।
রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য, কৃষক নেতা দেওয়ান আব্দুর রশিদ নীলু বলেন, এই সরকারের কাজ বিচার, সংস্কার, নির্বাচন আয়োজন করা। এই সরকারও আন্দোলন ব্যতীত কিছু করতে চাইছে না। সে কোন ন্যায্য দাবি আদায় করতে গেলে লড়াই করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, এই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আমাদের জীবনের বন্দোবস্ত। আমাদের পুরোনো লুটেরা বন্দোবস্ত ফেলে দিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
নারী সংহতির সভাপ্রধান শ্যামলী শীল বলেন, নারী শিক্ষার্থীরা বিশেষ ভূমিকা পালন না করলে এই অভ্যুত্থান হতো না। শুধু নারী শিক্ষার্থী নয়, মায়েরা তার ছেলে-মেয়েদেরকে উৎসাহিত করেছে। আজকে ৩২ জুলাই, আজকে প্রমাণ হয়ে গেছে রাজনীতি আপনাদেরই জীবন নির্ধারণ করে। তাই আপনাদের সঠিক রাজনীতি করতে হবে। আমি রাজনীতিকে ঘৃণা করি। কিন্তু, ছেলে-মেয়েরা আজকে রাজনীতিমুখী হয়েছে। রাজনীতি করার ক্ষেত্রে আমরা কোন রাজনীতি করবো সেটা ঠিক করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের পেছনে ফেলে আমাদের সঠিক রাজনীতি করতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তরিকুল সুজন বলেন, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আকাশ থেকে আসবে না। নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠায় দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের দেশের স্টিয়ারিংয়ে বসাতে হবে। আমরা শহীদদের পরিবার, আহতদের নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খাকে বাস্তবায়ন করবো।
প্রবাসী সংহতির সমন্বয়ক সায়মা খাতুন বলেন, আত্মত্যাগের, বলিদানের যে শোক, কষ্ট তা আমরা উদযাপন করতে পারিনি। এই সংগ্রামকে একটি নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বন্দোবস্তে রূপ দিতে হবে। প্রবাসীরাও এই লড়াইয়ে যুক্ত রয়েছেন। তারা এই সংগ্রাম জারি রাখবেন।
বাংলাদেশ যুব ফেডারেশনের সম্পাদক জাহিদ সুজন বলেন, দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে উৎপাদন ব্যবস্থায় যুক্ত করতে হবে। গণসংহতির এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
ছাত্র ফেডারেশন কেন্দ্রীয় সভাপতি মশিউর রহমান খান রিচার্ড বলেন, হাসিনার আমলে ঘুষ ছাড়া চাকুরির নিশ্চয়তা ছিলো না। উন্নয়নের নামে এই দেশের তরুণদের ভবিষ্যত ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। সেইসব শোষণের জবাবে জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু, এই সরকার তরুণদের সাথে বেঈমানি করেছে। ১ বছর হয়েছে এখনো আহতদের তালিকা করে নাই।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য মনির উদ্দিন পাপ্পু, কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য বাচ্চু ভূইয়া, দীপক রায়, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান, আলিফ দেওয়ান, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অঞ্জন দাস, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আল আমিন শেখ, নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি ফারহানা মানিক, টাঙ্গাইল জেলা সভাপতি ফাতেমা রহমান বিথি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশনের আহবায়ক আরমানুল হক, জুলাই আন্দোলনে আহত জামাল হোসেন, জুলাই আন্দোলনে আহত মো. লিটন, আব্দুর রহমান, আমিনুল ইসলামসহ আন্দোলনে আহত, নিহত ও অভ্যুত্থানের সংগঠকবৃন্দ।
বিভি/পিএইচ
মন্তব্য করুন: