মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন ও বর্তমান অবস্থা

আজ ২ অক্টোবর। জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক অহিংস আন্দোলন দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আবার এই দিনেই ভারতের জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী যাঁকে আমরা মহাত্মা গান্ধী নামে চিনি তিনি জন্মগ্রহণ করেন।তিনি অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা। আমাদের জানা দরকার অহিংস আন্দোলন আসলে কি! কোনো হিংসা বা সহিংসতায় নয়,শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিয়ম মেনে জনস্বার্থে যে আন্দোলন করা হয়, সেটাই অহিংস আন্দোলন। ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজরা অর্থাৎ ব্রিটিশরা ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ গড়ে তোলে। বিভিন্ন সময়ে তারা এই উপমহাদেশে মানুষের উপর চালাতো অত্যাচার ও নির্যাতন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে হয়েছে অনেক আন্দোলন ও সংগ্রাম। ভারতীয় উপমহাদেশের তথা বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের দুঃখ দুর্দশা দূর করতে পথ বেছে নিয়ছিলেন আন্দোলন।এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হচ্ছে অসহযোগ আন্দোলন। যেখানে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে অহিংস আন্দোলন করেছেন। যাঁর প্রবক্তা ছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী। রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে অন্য রাজনৈতিক দলও সমর্থন জানিয়েছিলেন। দলটির নেতৃত্বেও তখন মহাত্মা গান্ধী। তিনি মনে করতেন সহিংস পন্থা অবলম্বন করে কখনো রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে না। অহিংসার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলনই সমাধান এনে দিতে পারবে। এনে দিয়েছিলোও তাই। যাঁর সর্বশেষ ফলাফল ১৯৪৭ সালে ইংরেজ অর্থাৎ ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
শাসক অত্যাচার করবে সেটির প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে। তবে সহিংসতায় নয়,অহিংসার মাধ্যমে। নির্যাতন সহ্য করে জনগণের ভালো-মন্দের দিকে তাকিয়ে অত্যাচারের অসারতা প্রমাণ করতে হবে। স্বৈরচারী ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে নির্যাতিতের সমগ্র আত্মার বোধকে জাগ্রত বা উথিত করাই অহিংস আন্দোলনের মুখ্য বিষয়।কিন্তু বর্তমানে আমরা কি দেখি! রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। দলাদলি, মারামারির মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের স্বার্থ হাসিল করা। অথচ হওয়ার কথা ছিলো যে, জনগণের কল্যাণে স্বেচ্ছাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলন করা। যে দলই ক্ষমতায় আসুক তার বিপরীত দলগুলো জ্বালাও পোড়াও, ধর-মার-কাট নীতি অনুসরণ করে। যার ফলে জনগণের ক্ষতি হচ্ছে বেশি। জনগণ এই সহিংসতার ভয়াবহতা থেকে রেহায় পায় না। রাস্তায় চলাচলে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে মুখোমুখি হতে হয় জনগণের যা শেষ পর্যন্ত নিরীহ মানুষেরও দিতে হয় প্রাণ।
অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস আন্দোলনের কথা বলে গেছেন। হরতাল ডাকা হয় মূলত জনগণের কল্যাণে। কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি, দুর্নীতি, অনিয়ম ও প্রবল রাষ্ট্রশক্তির কাছ থেকে নিরস্ত্র মানুষের দাবি আদায়ের জন্য। কিন্তু বর্তমান হরতালে কি দেখা যায়! ভাঙচুর, লুটপাট,অগ্নিসংযোগ করা হয়। এখানে তো জনস্বার্থের জন্যে হরতাল ডাকা হলোনা বরং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্যই এই হরতাল ডাকা হয়। যেখানে জনগণের দাবি আদায় না হয়ে ক্ষতি হয়, সেখানে আন্দোলন অকার্যকর ও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্দেশ্যই মনে হচ্ছে মুখ্য বিষয়। এখানে একপাক্ষিক রাজনৈতিক দলকেই বলছি না,যাঁরাই বিরোধী দলে থেকে এ ধরণের সহিংস আন্দোলন করে আমি তাদের কথায় বলছি।
বর্তমানে মুক্তির পথ প্রদর্শক হিসেবে থাকে গণতন্ত্র। যেখানে রয়েছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থার কথা ও জনগণের শাসনের কথা। যদি কোনো শাসক স্বেচ্ছাচারীতা ও জনগণের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্যাতন চালায়, তা প্রতিহত করতে হবে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়, গণতান্ত্রিক উপায়ে অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে। যেমনটি করেছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে। সরকার প্রদত্ত উপাধি বর্জন, সামাজিক পদ থেকে পদত্যাগসহ নানাভাবে অহিংস আন্দোলন করা যায়। অসহযোগ আন্দোলনে যেটা করেছিলো।ব্রিটিশদের দেওয়া বিভিন্ন মেডেল বা পদক বর্জন করেছিলো। অসাম্প্রদায়িক,বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের অবিস্মরণীয় নেতা মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো ব্যক্তিরাও অহিংস আন্দোলনের পক্ষ নিয়েছিলো। তাঁরাও সেই ভাবধারায় আন্দোলন করেছিলো। তাঁরা চেয়েছিলো বিশ্বহোক এক শান্তিময়।
১৯২০ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে অহিংস আন্দোলন হয়। আর ২০০৭ সালে ২ অক্টোবর জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের সম্মতিতে ‘আন্তর্জাতিক অহিংস আন্দোলন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এগুলো কি শুধু ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাকি প্রতিটি দেশ অহিংস আন্দোলনকে অনুসরণ করবে? যদি প্রতিটি রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণের জন্যে রাজনৈতিক দল কাজ করতে চায়, তাহলে অবশ্যই অহিংস আন্দোলনের পথ অনুসরণ করা উচিত। তাতে রাষ্ট্রের সম্পদের ক্ষতি হবে না, জীবনহানি ঘটবে না,অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিও থমকে যাবে না ও জনগণের জান-নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে। গান্ধীজির মতে, ‘অহিংসার অর্থ অন্যায়কারীর নিকট নতি স্বীকার নয়। অহিংসার অর্থ স্বৈরাচারী ইচ্ছাশক্তির বিরুদ্ধে নির্যাতিতের সমগ্র আত্মার বোধকে উত্থিত করা।’
তাই, অধিকার আদায় হোক সহিংসতায় না,অহিংসতার মধ্য দিয়ে।বিশ্বহোক শান্তিময়।
বিভি/রিসি
মন্তব্য করুন: