ভোলা: নৈসর্গিক কবিতার দ্বীপ

ছবি: ভোলার তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ শিকার
বাংলার দক্ষিণে নদী, চর আর প্রকৃতির মিশেলে গঠিত এক অপরূপ সৌন্দর্যের দ্বীপ ভোলা। এ যেন প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা এক জীবন্ত ছবি। বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলা তার অপরূপ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, ঐতিহাসিক, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক বৈভবের জন্য অনন্য। চারদিকে নদীর মুক্তার মত সাদা চিকচিকে জলধারা, মেঘনার অথৈ বিস্তার আর সবুজের অসীম ছায়াতলে গড়ে ওঠা এই দ্বীপ জেলা, যান্ত্রিক জীবনের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে প্রকৃতিপ্রমী এবং ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এক নিঃশব্দ রাজ্য।
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কথাটির প্রচলনে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া প্রায় সবাই চিনলেও ভোলাকে আগলে রেখেছে যে তেঁতুলিয়া নদী সেটা অনেকেরই অজানা। কথিত আছে তেঁতুলিয়া নদীর ইলিশ বিশ্বের সবচেয়ে সুস্বাদু ইলিশ। ভোলার সৌন্দর্য যেন এই তেঁতুলিয়া আর মেঘনার স্রোতধারায় মিলে থাকা কবিতার মত। তেঁতুলিয়া আর মেঘলার মিলিত সুরধ্বনি এই দ্বীপকে দিয়েছে অনাবিল প্রশান্তি। নদীর এই সুরধ্বনি আর তার তীরে বিস্তৃত চরগুলো প্রকৃতির আপন লীলাভূমি। বর্ষার জলভরা নদী কিংবা শীতের হিমেল সকালে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সূর্যের হাসি দেখা এক নির্মল সুখের অনুভূতি। এখানে জল আর স্থলের মিতালী পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয় অবলীলায়। তেঁতুলিয়া নদীর তীর জুড়ে বিস্তৃত চরের মাটিতে শালিক, মাছরাঙা আর বক পাখির অবাধ বিচরণ প্রকৃতি প্রেমীদের দেয় এমন স্বর্গীয় অনুভূতি দেয় যা মনের গভীরে অনুরণন তোলে।
চারদিকে নদী দিয়ে ঘেরা এই দ্বীপে ঢাকা থেকে যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে আরামদায়ক এবং উপভোগ্য মাধ্যম হল লঞ্চ। শুধু এই লঞ্চভ্রমণও হতে পারে যেকোন প্রকৃতিপ্রেমী বা ভ্রমণপিপাসুর জন্য এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়। প্রতিদিন নদী তার নতুন নতুন রূপ মেলে ধরে প্রকৃতিতে। বর্ষার ভরা নদীর উত্তাল ঢেউ, বা শীতের শান্ত নদী, দিনে যতদূর চোখ যায় শুধু থৈথৈ পানি, রাতের নদীতে শত শত লঞ্চের আলো আর রাতের আঁধারের সাথে চলা আলো-আঁধারি খেলা, পূর্ণিমায় মোহনীয় রূপালী চকচকে নদী, প্রতিটি ঋতুতে প্রতিটি সময়ে আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতায় সবই আপনাকে আলোড়িত করবে।
ঢাকা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন সময়ে ভোলার উদ্দেশে বিভিন্ন লঞ্চ ছেড়ে যায়। এরমধ্যে আছে দোয়েল, এমডি ভোলা, ক্রিস্টাল, সম্পদ, শ্রীনগর ৭ এম ভি গাজী সালাউদ্দিন ইত্যাদি। এগুলো ঢাকা থেকে দুপুর ৩টায় ছেড়ে সন্ধ্যা ৭টা ৩০ থেকে ৮টার মধ্যে ভোলা ইলিশা ঘাটে পৌঁছায়। ইলিশা ঘাট থেকে সকাল ৮টায় ছেড়ে দুপুর ১টা-২টার মধ্যে ঢাকা পৌঁছায়।আবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮.৩০ টা পর্যন্তও উভয়দিক থেকেই লঞ্চ পাওয়া যায় যা গন্তব্যে পৌঁছায় সকাল ৫ টা থেকে ৬টার মধ্যে।
ভোলায় দেখার যা কিছু:
ভোলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক এবং প্রাকৃতিক স্থানগুলো যেন একেকটি অমর গল্প।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি জাদুঘর
ভোলার আলীনগর ইউনিয়নে অবস্থিত এই জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে ধরে। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ভোলা থেকে বাস, মাহিন্দ্র বা সিএনজিতে প্রথমে যেতে হবে দৌলতখান উপজেলা সদরে। যেখানে বাস বা মাহিন্দ্রা ভাড়া জনপ্রতি ৩০-৫০ টাকা এবং সিএনজি বা অটোরিকশা ভাড়া জনপ্রতি ৬০-১০০ টাকা। দৌলতখান সদর থেকে রিকশা বা ভ্যানে জনপ্রতি২০-৩০ টাকায় স্মৃতি জাদুঘরটিতে যেতে পারবেন।
সবুজের মাঠের বুকে ফাতেমা খানম জামে মসজিদ
ভোলা থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে বাংলাবাজারের এই মসজিদটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন একটি স্থাপনা। মসজিদের মূল গেইট থেকে মসজিদ পর্যন্ত সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত। ইসলামিক ঐতিহ্য এবং আধুনিক স্থাপত্যরীতির মিশেলে গড়া এই মসজিদটির গম্বুজ এবং মিনার যেন আকাশ ছুঁতে চায়। রকমারি পাথর, টাইলস এবং দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতি বাড়তি নজর কাড়ে। ভোলা সদর থেকে মাত্র ১৫ টাকা অটোরিকশা বাড়ায় এখানে যাওয়া যায়।
দেশের সবচেয়ে নান্দনিক স্বাধীনতা জাদুঘর
ফাতেমা খানম জামে মসজিদের সাথেই এই আধুনিক স্বাধীনতা জাদুঘরটি। এখানে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের ৮০ বছরের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া তথ্য, চিত্র ও ডিজিটাল তথ্যচিত্রের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়।
স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন মসজিদ
ভোলা জেলার উকিল পাড়ায় অবস্থিত এই মসজিদ। এটি সৌন্দর্য এবং আধ্যাত্মিকতার অপূর্ব মেলবন্ধন। এর প্রশস্ত প্রাঙ্গন এবং দৃষ্টিনন্দন নকশা প্রার্থণার পাশাপাশি মনে এনে দেয় গভীর প্রশান্তি। এখানে পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য রয়েছে আলাদা অজু খানা এবং নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা। ভোলা সদর থেকে ২৫ টাকা অটোরিকশা ভাড়ায় আপনি যেতে পারবেন এই নান্দনিক মসজিদে।
কালের সাক্ষী ৩০০ বছরের হায়দার আলী জমিদার বাড়ি
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো হায়দার আলী জমিদার বাড়ি। সংস্কারের অভাবে বাড়িটি জরাজীর্ণ হলেও এখনো দৃষ্টিনন্দন। বোরহানউদ্দিন বাস স্ট্যান্ড থেকে ২০ টাকা অটোরিকশা ভাড়ায় এখানে যেতে পারবেন।
বাংলার আইফেল টাওয়ার খ্যাত জ্যাকব টাওয়ার
এই ওয়াচ টাওয়ারটি ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলায় অবস্থিত। ১৭ তলা বিশিষ্ট ওয়াচ টাওয়ারটি এর স্থাপত্যশৈলীর জন্য পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষিত করে।এই টাওয়ারের ১৭ তলা থেকে বাইনোকুলারের সাহায্যে খুব স্পষ্ট ভাবে দেখা যায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল, চর কুকরি মুকরি, তারুয়া সৈকত, বঙ্গোপসাগর, নিঝুম দ্বীপ, মনপুরার চর পিয়াল। ১৭তলা থেকে চারপাশে তাকালে নিজেকে মনে হয় যেন বিস্তৃত জলরাশিতে ভাসা কোন ভেলা। ভোলা সদর থেকে ১৮০ টাকা বাস ভাড়ায় এখানে যাওয়া যায়।
চর কুকরি মুকরি
বাংলাদেশের দ্বিতীয় সুন্দরবন চর কুকরি মুকরি। ম্যানগ্রোভ বণ, হরিণের অবাধ বিচরণ আর শীতকালের পরিযায়ী পাখি বক, শঙ্খচিলের ঝাঁক আর তাদের কলকাকলি এই চরের পরিবেশকে করে তোলে জাদুর মত মায়াময়। এখানে পূর্ণিমারাতে তাবুতে রাত্রীযাপন প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে হয়ে থাকবে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা যা স্মৃতির পাতায় অনুরণন তুলবে বহুকাল। চরফ্যাশন বাস স্ট্যান্ড থেকে জনপ্রতি ৫০ টাকা বাস ও ৬০ টাকা অটোরিকশায় যেতে হবে দক্ষিণ আইচায়। সেখান থেকে ২০ টাকা দিয়ে ঘাটে, ঘাট থেকে স্পিডবোটে ১৫০ টাকা ও ট্রলারে ৮০ টাকায় চর কুকরি-মুকরি যাওয়া যায়।
তারুয়া সৈকত
হরিণ, বণ্যমহিষ, বানর, অতিথি পাখি আর লাল কাঁকড়াসহ বৈচিত্র্যময় প্রাণীর বাসভূমি তারুয়া সৈকত। চরফ্যাশনের সর্বদক্ষিণের ভূ-খণ্ড এই তারুয়া সৈকত।এই সৈকতের একপাশে বঙ্গোপসাগর অন্যপাশে বিস্তৃর্ন চারণভূমি। এখনো শহরের ছোঁয়া লাগেনি এই সৈকতে। এখানে প্রকৃতির নির্জনতা এবং মোহনীয়তা নতুন করে বাঁচার উদ্দীপনা জাগাবে। চর কুকরি মুকরি থেকে স্থনীয় যানবাহনে (ভ্যান বা মোটরসাইকেল) জনপ্রতি ৫০-১০০ টাকায় তারুয়া সৈকতে যেতে পারবেন।
ইলিশের শ্বশুড়বাড়ি ইলিশা নদীর তীর
রূপালী ইলিশের রাজধানী ইলিশা।মেঘনার বুকে তাঁজা ইলিশ ধরার দৃশ্য দেখতে ইলিশা তীরের বিকল্প মেলা ভার। জেলেদের জীবনযাপন, শতশত নৌকার সারি আর ইলিশের গন্ধ আপনার সাথে ভোলার এক অনন্য বন্ধন তৈরি করবে। ভোলা সদর থেকে অটোরিকশা বা মোটর সাইকেলে ১০০-১৫০ টাকায় এবং বাস বা মাহেন্দ্রতে জনপ্রতি ৩০-৫০ টাকায় ইলিশা নদীর তীরে যেতে পারবেন।
মনপুরা দ্বীপ
মাইলের পর মাইল ম্যানগ্রোভ বন আর বিস্তৃত জলরাশিতে ঘেরা ভোলা জেলার বিচ্ছিন্ন ভূমি মনপুরা দ্বীপ। হরিণের অভয়ারণ্য, মনপুরা ল্যান্ডিং স্টেশন, চৌধুরী প্রজেক্ট, দক্ষিণ হাওয়া সী-বীচের মত নৈসর্গিক দর্শনীয় স্থান মনপুরাকে করেছে সবার থেকে আলাদা। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার বিরল সম্ভাবনা থাকলেও সাইক্লিং এবং ক্যাম্পিং করার জন্য মনপুরা অদ্বিতীয়।
ঢাকা থেকে লঞ্চে সরাসরি মনপুরা যাওয়া যায়। ভোলা থেকেও লঞ্চে যেতে হবে। ভোলার তজুমদ্দিন ঘাট থেকে প্রতিদিন বিকেল ৩টায় মনপুরার উদ্দেশে ফেরি চলাচল করে ও মনপুরা থেকে সকাল ১০ টাকায় ভোলার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। এ ছাড়াও চরফ্যাশানের বেতুয়া ঘাট থেকে মনপুরায় ১৮০ টাকা ভাড়ায় দুটি লঞ্চ যাতায়াত করে।
ভোলায় থাকাতে পারেন যেখানে
ভোলা সদরে প্যাপিলন, ক্রিস্টাল ইন, কণর্ফুলি, এশিয়া ইন, বে আইল্যান্ডসহ বেশ ভালো হোটেল রয়েছে থাকার জন্য। যেখানে একহাজার থেকে তিনহাজর টাকায় রাত্রিযাপন করতে পারবেন। চাইলে অনলাইন অগ্রীম বুকিংও করতে পারেন।
চরফ্যাশনে খামার বাড়ি রিসোর্টসহ চরফ্যাশন ও মনপুরায় রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি হোটেল ও আবাসন ব্যবস্থা।
ভোলায় কী খাবেন
তুলাতলি পর্যটনকেন্দ্রে মেঘনার রুপালি ইলিশের বারবিকিউ এবং খিচুড়ি ছাড়া ভোলা ভ্রমণ হয়ে থাকবে অসম্পূর্ণ। এছাড়াও স্বাদ নিতে পারেন পোয়া, কোরাল, চিংড়ি, পাঙাস, বোয়ালসহ সব নদীর মাছের।এছাড়া ভোলার ২০০ বছরের ঐতিহ্য ঘুইংগার হাটের শঙ্কর দত্তের মিষ্টি, মহিষের দুধের টকদই এবং ছানাও আপনাকে তৃপ্ত করবে।
ভোলা তার অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহ্যের জন্য এক সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র। সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে এই দ্বীপ জেলা শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং আন্তর্জাতিক পর্যটকদেরও মন জয় করতে পারে। প্রকৃতি, ইতিহাস, এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মেলবন্ধনে ভোলা এক অমর পর্যটন গন্তব্য, যেখানে প্রতিটি ভ্রমণ কাহিনী হয়ে ওঠে এক কবিতা।
মন্তব্য করুন: