• NEWS PORTAL

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

চন্দ্রনাথ পাহাড়

একদিকে সমুদ্র আর অন্য দিকে পাহাড়

মাজহারুল ইসলাম শামীম

প্রকাশিত: ১৯:০৫, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২

আপডেট: ১০:৪৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২

ফন্ট সাইজ
একদিকে সমুদ্র আর অন্য দিকে পাহাড়

সংগৃহীত ছবি

চন্দ্রনাথ পাহাড় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত সীতাকুণ্ড উপজেলার পাহাড়বিশেষ। সীতাকুণ্ড অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি। এলাকাটি শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বড় তীর্থস্থানই নয়; বরং খুব ভালো ভ্রমণের স্থান হিসেবেও স্বীকৃত। চন্দ্রনাথ পাহাড়  চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড বাজার থেকে ৪কি.মি. পূর্বে অবস্থিত একটি পাহাড় যা দর্শনার্থীদের কাছে ট্রেকিং এর জন্যে অন্যতম জনপ্রিয় একটা রুট। চন্দ্রনাথ পাহাড় এর উচ্চতা আনুমানিক ১০২০ ফুট। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার জন্যে ২টা রাস্তা আছে। ডানদিকের দিকের রাস্তা প্রায় পুরোটাই সিঁ‌ড়ি আর বামদিকের রাস্তাটি পুরোটাই পাহাড়ী পথ, কিছু ভাঙ্গা সিঁ‌ড়ি আছে। বাম দিকের পথ দিয়ে উঠা সহজ আর ডানদিকের সিঁ‌ড়ির পথ দিয়ে নামা সহজ, তবে আপনি আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী পথ ব্যবহার করতে পারবেন।

প্রায় ১ ঘণ্টা – ১.৫ ঘণ্টা ট্রেকের পর দেখা মিলবে শ্রী শ্রী বিরূপাক্ষ মন্দির এর

প্রায় ১ ঘণ্টা – ১.৫ ঘণ্টা ট্রেকের পর দেখা মিলবে শ্রী শ্রী বিরূপাক্ষ মন্দির এর। প্রতিবছর এই মন্দিরে শিবরাত্রি তথা শিবর্তুদশী তিথিতে বিশেষ পূজা হয়। এই পূজাকে কেন্দ্র করে সীতাকুণ্ডে বিশাল মেলা হয়। সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড় এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে (ইংরেজী ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাস) বড় ধরনের একটি মেলার আয়োজন করে থাকেন। যেটি শিবর্তুদর্শী মেলা নামে পরিচিত। এই মেলায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য সাধু এবং নারী-পুরুষ যোগদান করেন।

বিরূপাক্ষ মন্দির থেকে ১৫০ ফুট দূরেই রয়েছে চন্দ্রনাথ মন্দির যা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূঁড়ায় অবস্থিত। এই ১৫০ ফুট রাস্তার প্রায় ১০০ ফুটই আপনাকে উঠতে হবে খাঁড়া পাহাড় বেয়ে যেখানে নিজেকে সামলে রাখা অনেকটাই কষ্টকর। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আপনি দেখতে পাবেন একদিকে সমুদ্র আর অন্য দিকে পাহাড়ের নির্জনতা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবেন উঁচু-নিচু পাহাড়ের সবুজ গাছপালার দিকে। যে দিকে তাকাবেন শুধু সবুজ আর সবুজের সমারোহ। আপনার চোখ ভরে যাবে। মনে হবে যেনো বইয়ের পাতায় সেই লাইন টা 'সবুজ শ্যামলে ভরা এই বাংলাদেশ, যার রূপের নাইকো শেষ '। এমন এক দৃশ্য আপনাকে উপভোগ করার সুযোগ করে দিবে চন্দ্রনাথ পাহাড়। পুরো সীতাকুণ্ড উপজেলা কে যেনো এক চোখের নজরে নিয়ে আসতে পারেন এক সেকেন্ডে। এত উঁচু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে সবুজের সমারোহ আর হিমেল বাতাসের অনূভুতি উপভোগ করাটা কতটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আপনার প্রশান্তিতে জুড়িয়ে যাবে চোখ। আরো চমৎকার বিষয় হলো, সীতাকুণ্ডের পূর্বদিকে চন্দ্রনাথ পাহাড়। আর পশ্চিমদিকে সুবিশাল সমুদ্র। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের শ্রেণিভূক্ত ছোট পাহাড়গুলো ব্যাসকুণ্ড থেকে শুরু হয়েছে। পাহাড়ে যাবার পথে বেশকিছু হিন্দুধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে। চন্দ্রনাথ মন্দিরসহ আরও রয়েছে বড়বাজার পূজামণ্ডপ, ক্রমধেশ্বরী কালী মন্দির, ভোলানন্দগিরি সেবাশ্রম, কাছারীবাড়ী ইত্যাদি।  

পুরো এলাকাটি বিভিন্ন ধরনের গাছ, বনফুল, গুল্মলতায় পরিপূর্ণ। শিক্ষার্থী এবং ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত। পেয়ারা, সুপারি, আমগাছসহ বিভিন্ন ফলের বাগান দেখা যায়। কিছুসংখ্যক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস রয়েছে এখানে। ত্রিপুরাদের নিজস্ব কিছু গ্রাম রয়েছে। পাহাড়ের গভীরে জুম পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদ করা হয়। এছাড়াও, বাণিজ্যিকভাবে ফুলের বাগানের চাষ করা হয়।
চন্দ্রনাথ পাহাড়ে প্রথমদিকে তেমন কষ্ট না হলেও তিনশো ফুট থেকে আপনাকে উঠতে হবে খাঁড়া পাহাড় বেঁয়ে। কখনো বা চলতে হবে এক পাশে পাহাড়ের গা ঘেঁষে আর অন্য পাশে খাদ নিয়ে। একবার পা ফসকালেই পড়তে হবে ২৫০-৩০০ ফুট নিচে। কোনও কোনও জায়গায় পথটা এতটাই সরু যে, দুজন মানুষ একসঙ্গে উঠা-নামা করা প্রায় অসম্ভব। মাঝে মাঝে পাবেন প্রাচীনকালের তৈরি সিঁড়ি। কে কত সালে সে সিঁড়ি কেন বানিয়েছেন সাথে আছে তার নামফলকও। চারদিকে নিরব-নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে শুনতে পাবেন চেনা-অচেনা পাখির ডাক। দেখতে পাবেন ঝর্ণাও।

চন্দ্রনাথ মন্দিরের ইতিহাসঃ

‘দেশে বিদেশে নাথ তীর্থ, মঠ ও মন্দির’ গ্রন্থে প্রফুল্ল কুমার দেবনাথ লিখেছেন, চন্দ্রনাথ শৈব তীর্থ। সপ্তদশ শতাব্দীতে সীতাকুণ্ড ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার রাজা ছিলেন চন্দ্রেশ্বর নাথ। তার নামে এই পাহাড়ের নাম হয় চন্দ্রনাথ। এখানে চন্দ্রেশ্বর নাথের কুলদেবতা শিব প্রতিষ্ঠিত। তাই পাহাড়ের নামে এই মন্দিরের নাম হয় চন্দ্রনাথ শিব। তবে কৈলাস চন্দ্র সিংহের রাজমালায় বলা হয়েছে, চন্দ্রনাথের শিবমন্দির ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দ মানিক্যের প্রধান কীর্তি। এই গোবিন্দ মানিক্যও কিন্তু সপ্তদশ শতকেরই রাজা। তাহলে কি এই চন্দ্রনাথ ওই শতকেরই মন্দির, নাকি আরও প্রাচীনকালের? চন্দ্রেশ্বর নাথের নামে চন্দ্রনাথ, নাকি চন্দ্রনাথ থেকেই চন্দ্রেশ্বর নাথ?
রাজমালাতেই বলা আছে, ১৫০১ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে কালীমূর্তি নিয়ে উদয়পুরের ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করেন ত্রিপুরার রাজা ধন্য মাণিক্য। প্রাচীন ত্রিপুরাপতিদের চন্দ্রবংশজ উল্লেখ করে রাজমালাতে আরও বলা হয়েছে, চন্দ্রনাথ তাদেরই অক্ষয় কীর্তি।
আবার নবম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে বাঙ্গালা শাসনকারী চন্দ্রবংশের সঙ্গে এই চন্দ্রনাথের সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনাও প্রবল। ‘পাল-সেন যুগের বংশানুচরিত’ গ্রন্থে দীনেশচন্দ্র সরকার লিখেছেন, এই রাজবংশের শেষ রাজা গোবিন্দ চন্দ্র ছিলেন শৈব। সে সময়ের বিভিন্ন তাম্রশাসনের পাঠ বিশ্লেষণ করে ‘পূর্ববঙ্গের চন্দ্র রাজবংশ’ শীর্ষক প্রবন্ধে আহমদ হাসান দানী লিখেছেন, ‘চন্দ্রদের রাজত্বকালে বঙ্গ ও সমতটে পাল রাজারা প্রবেশ করতে সক্ষম হননি।’
এমন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজবংশের সঙ্গে চন্দ্রনাথের সম্পর্ক থাকতেই পারে। তবে জনশ্রুতি বলছে, নেপালের একজন রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ভারতবর্ষের পাঁচ কোণে পাঁচটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন। এগুলোর অন্যতম হলো এই চন্দ্রনাথ মন্দির। এই মন্দিরের চূড়ার আকৃতিটা মুঘল আমলের গম্বুজের মতো। দরজা আর খিলানও তাই। মুঘল আমলে এ পাহাড়ের অনেক মন্দির সংস্কার করা হয় বলে বলা আছে সীতাকুণ্ড উপজেলা তথ্য বাতায়নে। বর্তমান মন্দিরটি টাইলসে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

চন্দ্রনাথ পাহাড় ভ্রমণের সময় যা নিবেনঃ
ভ্রমণপিপাসু, ধৈর্য্যশীল, সব পরিবেশে মানিয়ে নিতে প্রস্তুত অনুসন্ধিৎসু মন ব্যাকপ্যাক, রেইন কাভার না থাকলে ক্যামেরা ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস বৃষ্টি থেকে বাচাতে পলিথিন। কেডস বা প্লাস্টিকের স্যান্ডেল।
আরামদায়ক সুতি বা সহজে শুকায় এমন পোষাক, কিছু শুকনো খাবার, বাদাম, খেজুর, পিনাট বার, ক্যান্ডি স্যালাইন, গ্লুকোজ আর পানির বোতল অবশ্যই নিয়ে যেতে হবে।

চন্দ্রনাথ পাহাড় কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকা থেকে এসি, ননএসি বাস ছাড়ে সায়দাবাদ বাস ষ্টেশন থেকে। আরামদায়ক এবং নির্ভর যোগ্য সার্ভিস গুলো হল এস.আলম, সৌদিয়া, গ্রীনলাইন, সিল্ক লাইন, সোহাগ, বাগদাদ এক্সপ্রেস, ইউনিক প্রভূতি। সবগুলো বাসই সীতাকুণ্ডে থামে। চট্টগ্রাম থেকে বাসগুলো মাদারবাড়ী, কদমতলী বাসষ্টেশন থেকে ছাড়ে। তা ছাড়াও অলঙ্কার থেকে কিছু ছোট গাড়ী ছাড়ে ( স্থানী ভাবে মেক্সী নামে পরিচিত) সেগুলো করেও যাওয়া যাবে।
এছাড়া ঢাকা থেকে ছেড়েঁ যাওয়া দ্রুতগামী ট্রেন “ঢাকা মেইল” সীতাকুণ্ডে থামে, এটি ঢাকা থেকে ছাড়ে রাত ১১টায় এবং সীতাকুণ্ডে পৌঁছে পরদিন সকাল ৬.৩০ থেকে ৭টায়। অন্যান্য আন্তঃ নগর ট্রেন গুলো সরাসরি চট্টগ্রামে চলে যায়। শুধুমাত্র শিবর্তুদশী মেলার সময় সীতাকুণ্ডে থামে।

সীতাকুন্ড বাজার থেকে CNG (জনপ্রতি ২০/-) নামিয়ে দিবে পাহাড় এর প্রবেশ ফটকে। এখান থেকেই ট্রেকিং এর শুরু। সাধারণত ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগবে পাহাড়ের চূড়ায় পৌছাতে। চট্টগ্রাম শহর থেকে আপনি নিজ উদ্যোগে পারিবারিক ভাবে সিএনজি অটো রিক্সাতে করে ঘুরে আসতে পারবেন ভাড়া নিবে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। আপনি যদি পাবলিক বাসে যেতে চান তবে আপনাকে নগরির অলংকার কিংবা এ কে খান মোড় থেকে বাসে উঠতে হবে ভাড়া নিবে ২০ টাকা প্রতি জন।

কোথায় থাকবেনঃ
সীতাকুন্ড কাঁচা বাজার এলাকায় এবং সীতাকুণ্ড থানা সংলগ্ন এলাকায় মোটামুটি মানের অল্পকিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে যাদের মধ্যে হোটেল কম্পোট জোন, জলসা, নিউ সৌদিয়া, সৌদিয়া, সায়মন উল্লেখযোগ্য। হোটেল কম্পোট জোন, জলসা, নিউ সৌদিয়া অপেক্ষাকৃত নতুন এবং মান ভালো। এদের রুম ভাড়া এসি ডাবল বেড – ১০০০ টাকা এবং নন এসি ৫০০-৭০০ টাকার মধ্যে।
শেষে একটি বিষয় আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার অধিকার সবার আছে। সুন্দর, স্বচ্ছ পরিবেশ রক্ষাতে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।


লেখক : শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ
 

মন্তব্য করুন: