• NEWS PORTAL

  • রবিবার, ১৯ মে ২০২৪

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

উপকূলীয় অঞ্চলে কালো সোনা উন্নয়ন উপাখ্যান

মো: মজনু সরকার

প্রকাশিত: ১৬:৩৭, ২৩ এপ্রিল ২০২২

আপডেট: ১৭:১০, ২৩ এপ্রিল ২০২২

ফন্ট সাইজ
উপকূলীয় অঞ্চলে কালো সোনা উন্নয়ন উপাখ্যান

'ওকি মইষাল বন্ধু রে, ছাড়িয়া যান না মোক, কাগাশিয়ার ঘরে রে', 'ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারির বন্দরে' -একসময়ের জনপ্রিয় এই গানগুলো যেমন এখন আর শোনা যায় না। তেমনি গানে বর্ণিত গ্রামবাংলার মেঠো পথে ধুলো উড়িয়ে যাওয়া মহিষ, মইষাল বন্ধু এবং মহিষের গাড়ি হাকিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেশব্যাপি এখন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না।

দ্রুত নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ এবং কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের কারণে চারণভূমি কমে যাওয়ায় দেশব্যাপি এখন আর নেই সেই মহিষ, নেই সেই মইষাল বন্ধু, নেই সেই হৈ হৈ রৈ রৈ হাকের ডাক এবং মহিষের গলায় ঝোলানো ঘন্টার টুং টাং শব্দ। অথচ আবহকাল ধরে গ্রামীণ জীবনে এই মহিষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে এসেছে এবং এখনও রাখার সুযোগও রয়েছে। বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই দেশে মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে। আর এই পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে আবহকাল ধরে গ্রামীণ জীবিকা নির্বাহের বড় অংশীর দায়িত্বে থাকা প্রাণিসম্পদ।

দেশের প্রাণিজ আমিষের ৫৭.৭২% আসা এই অংশী পুষ্টি নিরাপত্তার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জাতীয় রপ্তানি আয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও বিশেষ অবদান রাখছে। ডিএলএস ২০২০-এর তথ্যানুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জাতীয় আয়ের শতকরা প্রায় ১.৪৩ ভাগ এসেছে এই অংশী থেকে, যা টাকার অংকে ৪৬,৬৭৩ কোটি টাকা। এমনকি জাতীয় রপ্তানি আয়ের প্রায় শতকরা ২.৪৯ ভাগ অথাৎ ১.০১ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার সমপরিমান টাকা এসেছে অংশী থেকে উৎপাদিত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানী থেকে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ চামড়াজাত পণ্য হতে ২০২৪.১০ কোটি, মাংস ও মাংসজাত উপজাত হতে ৯.৮৮ কোটি, প্রক্রিয়াজাত তরল দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য হতে ১৫.৯৭ কোটি এবং প্রাণিজাত উপজাত হতে ১২৬.৮১ কোটিসহ সর্বমোট ২১৭৬.৭৭ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। দেশের মোট জনসংখ্যার ২০% মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এবং ৫০% মানুষ পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের জন্য এই অংশীর সাথে সম্পৃক্ত। এই অংশীর মধ্যে কালো সোনা (মহিষ) অন্যতম। দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রপ্তানি আয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান রয়েছে এই কালো সোনার।

চিরাচরিত নিয়মে বাথানে মহিষ পালন

দুধে ভরপুর থালায় হাতের কবজি পর্যন্ত ডুবানো বাঙালী আজ দুধের সংকটে ভুগছে। এফএও- এর সুপারিশ অনুযায়ী একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের প্রতিদিন ন্যূনতম ২৫০মিলি দুধ ও ১২০ গ্রাম মাংস খাওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে দেশজ উৎপাদিত দুধ ও মাংস জাতীয় চাহিদার শতকরা ৭০.২৫ এবং ১০৪.১৫ ভাগ সরবরাহ করছে। দেশ এখন মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও দুধ উৎপাদনে এখনো প্রায় ২৯.৭৫% ঘাটতি রয়েছে। মোট দুধ উৎপাদনের মাত্র ৩-৪% আসে মহিষ পালন সেক্টর থেকে। দেশে চলমান এই সাদা বিপ্লবে কালো সোনার অবদান রাখার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। মাংস উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও ভোগের দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ফুড অর্গাইজেশনের মতে, মানবদেহের সুস্থতার জন্য প্রতি বছর মাথাপিছু কমপক্ষে ৪৮ কেজি মাংস খাওয়ার প্রয়োজন, যেখানে বর্তমানে দেশে মানুষ গড়ে ৪-৪.৫ কেজি মাংস খাচ্ছে। এছাড়া বর্তমানে বছরে  প্রায় ১০-১২হাজার টন গোমাংস এবং ১২ হাজার মেট্রিক টন মহিষের মাংস আমদানী হচ্ছে। এই ঘাটতি পোষাতে দারুণ সহায়ক হতে পারে মহিষ। দেশব্যাপি মহিষের পূর্বপুরুষদের বিচরণ থাকলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ এবং কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের কারণে অনাবাদী জমি কমে যাওয়ায় চারণভূমির অভাব দেখা দেয়। একদিকে চারণভূমির অভাবে দেশব্যাপি মহিষ বিচরণ কমতে থাকে, অন্যদিকে উপকূলীয় চরাঞ্চলসহ পদ্মা, যমুনা, বক্ষ্রপুত্র নদীর অববাহিকা ও দেশের বিভিন্ন হাওরাঞ্চলে চারণভূমির আধিক্যসহ অন্যান্য তুলনামূলক সুবিধা থাকায় এসব অঞ্চলে মহিষ পালন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবেই কয়েক পুরুষ ধরে মহিষ এসব অঞ্চলে থিতু হয়ে যায়। ফলে আন্ত:প্রজনন, উচ্চ মৃত্যু ও রোগাক্রান্তের হার, খাদ্য সংকট, চারণভূমির অভাব, অপুষ্টি, বাসস্থানের অভাব, উপকরণ ও সেবার অভাব, সেবাপ্রদানকারী জনবলের অভাব, উন্নত ব্যবস্থাপনা অনুশীলনে অনীহা, জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব, প্রযুক্তির অভাব, দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জাতীয় পর্যায়ে মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্যের এক্সপোজারের অভাব এবং সরকারি-বেসরকারী পৃষ্টিপোষকতার অভাবে তাদের উৎপাদনশীলতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

এতে মহিষ দেশে বিদ্যমান দুধের ঘাটতি ও মাংস উৎপাদনে আশানুরুপ অবদান রাখতে পারেনি, অথচ পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে মোট দুধ ও মাংস উৎপাদনের যথাক্রমে ৫০% এবং ৩০% আসে মহিষ থেকে। বর্তমানে দেশজ দুধ (মোট দুধ উৎপাদন ১০৬.৮লক্ষ মেট্রিক টন) ও মাংস উৎপাদনে (মোট মাংস উৎপাদন ৭৬.৭৪ লক্ষ মেট্রিক টন) মহিষের অবদান যথাক্রমে মাত্র ০.৩৩% (৩৫,৯৮৩মেট্রিক টন) এবং ০.০৯% (মোট মহিষের মাংস উৎপাদন ৬৯৬৬ মেট্রিক টন), যা আসে দেশে বিদ্যমান প্রায় ১৫ লক্ষ মহিষ থেকে (তথ্যের উৎস: এফএও ২০১৯)।

মুররাহ জাতের ষাড় মহিষ

এদিকে উপকূলীয় চরাঞ্চলে থিতু হয়ে যাওয়া মহিষ উপখাতে কয়েক দর্শকে বিদ্যমান সমস্যা হ্রাসকরণের মাধ্যমে তাদের উৎপাদনশীলতাবৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৬-১৭ সাল থেকে দেশের মহিষঘণ উপকূলীয় ৩টি জেলায় আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ) এবং অর্থায়নে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর যৌথ অর্থায়নে PACE প্রকল্পের আওতায় উন্নত পদ্ধতিতে মহিষ পালনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের আয় বৃদ্ধিকরণ শিরোনামে ভ্যালু চেইন উন্নয়ন কর্মকান্ড গ্রহণ করা হয়। উপ-প্রকল্পগুলো জিজেইউএস, দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা এবং এসডিআই নামক পিকেএসএফ-এর ৩টি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে পটুয়াখালীর বাউফল থেকে শুরু করে ভোলার সবগুলো উপজেলা, নোয়াখালীর হাতিয়া ও নিঝুমদ্বীপ এবং চট্টগ্রামের সন্দীপ ও উড়িরচরে প্রায় ১৮,০০০ মহিষ পালনকারীর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। ক্রমহ্রাসমান মহিষের উৎপাদশীলতা ফিরিয়ে আনায়নের লক্ষ্যে প্রকল্প হতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে প্রকল্প

এলাকায় গুনগতমানের বিভিন্ন উপকরণ (যেমন- উন্নত মুররাহ জাতের প্রজননক্ষম ষাড় মহিষ, একই জাতের মহিষের সীমেন, ভ্যাকসিন, ঔষধ, দানাদার খাদ্য, উচ্চফলনশীল নেপিয়ার ঘাস ইত্যাদি) সহজলভ্য করা হয়েছে। উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে শতাধিক স্থানীয় প্রাণিসম্পদ সেবা প্রদানকারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং এসব দক্ষ সার্ভিস প্রোভাইডারদের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ বিষয়ক বিভিন্ন সেবা (যেমন-চিকিৎসা সেবা, কৃত্রিম প্রজনন সেবা, ভ্যাকসিন সেবা, কৃমিনাশক, ঔষধ ইত্যাদি) বাণিজ্যিকভাবে খামারীদের দোরগোড়ে পৌচ্ছে দেয়া হয়েছে। মহিষের আন্ত:প্রজনন হ্রাসের মাধ্যমে জাত উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায় সবগুলো চরে উন্নতজাতের মুররাহ মহিষের ষাড় প্রদান (৬৫টি) এবং একই জাতের মহিষের সীমেন দিয়ে তিন শতাধিক মহিষকে প্রজনন করা হয়েছে।

মহিষের আধুনিক কিল্লা

বন্যার সময় মহিষকে রক্ষার জন্য ৮টি কিল্লা স্থাপন করা হয়েছে। এসকল কমকান্ডের সাথে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান, উন্নত প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা (যেমন- উন্নত মুররাহজাতের ষাড় মহিষ ও একই জাতের মহিষের সীমেন দিয়ে সময়মত প্রজনন করানো, নিয়মিত টিকা প্রদান, কৃমিনাশক খাওয়ানো, নিয়মিত দানাদার খাদ্য প্রদান, বন্যার সময় মহিষকে কিল্লায় রাখা, দুধালো গাভী মহিষ, গর্ভবতী গাভী মহিষ ও বাছুরের বিশেষ যত্ন নেয়া, অসুস্থ হলে সময়মত চিকিৎসা প্রদান ইত্যাদি) সম্প্রসারণ এবং বিভিন্ন প্রযুক্তি (যেমন- কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি, পারিবারিকভাবে দুধালো মহিষ পালন, মহিষ ফ্যাটেনিং, সাইলেজ ও ইউএমএস খাদ্য প্রযুক্তি ইত্যাদি) ও উপকরণ (যেমন- মহিষের কিল্লা স্থাপন, কাফ স্টাটার ফিড, নেপিয়ার পাকচং ঘাস, দানাদার খাদ্য ইত্যাদি) প্রর্দশনী এবং ফলাফল প্রর্দশনীর মাধ্যমে প্রকল্পের প্রায় সকল খামারীদের বর্ণিত উন্নত ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি এবং উপকরণ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি শিক্ষিত করা হয়েছে, যা মহিষের জাত উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও মৃত্যুহার হ্রাসে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।

খামারীদের শিক্ষিতকরণের পাশাপাশি তাদের মাধ্যমে উৎপাদিত দুধ ও মাংসল মহিষ বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে শতাধিক দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং এ সকল পণ্য উৎপাদনকারীদের পণ্যের কাচামাল সরবরাহকারী খামারী এবং পণ্যের ক্রেতাদের (স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের ক্রেতা) সংযোগ স্থাপনে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া পিকেএসএফ-এর SEP নামক অপর একটি প্রকল্পের আওতায় ভোলা অঞ্চলে চরাঞ্চলে কিল্লা নির্মান, মহিষের ব্রিডিং ফাম স্থাপন এবং মহিষের দগ্ধজাত পণ্যের ব্র্যান্ডিং নিয়ে একটি কমকান্ড বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে। যা স্থানীয় নিরাপদ দুগ্ধজাত পণ্য ও মাংসল মহিষ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া খামারীসহ ভ্যালু চেইনের সাথে জড়িত উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনানুযায়ী আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির লক্ষ্যে স্থানীয় বিভিন্ন আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযোগ স্থাপনে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে, যা উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে সহজে প্রয়োজনানুযায়ী আর্থিক সেবা প্রাপ্তিতে ভূমিকা রেখেছে।

উন্নত ব্যবস্থাপনায় বাথানে মহিষ পালন

প্রকল্প আওতায় গুণগতমানের উপকরণ ও সেবা সরবরাহ বৃদ্ধি, উন্নত মুররাহজাতের মহিষ দিয়ে প্রাকৃতিক প্রজনন ও একই জাতের মহিষের সীমেন দিয়ে কৃত্রিম প্রজনন সেবা, কারিগরি, প্রযুক্তি এবং পরামর্শ সেবার সম্প্রসারণের ফলে গাভী মহিষ প্রতি দুধের উৎপাদন গড়ে ৬৮.৫৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য যে, হাবিব ও তার দল কর্তৃক ২০২১ প্রকাশিত এক গবেষণায় পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভোলা অঞ্চলে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নানাবিধ উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে মহিষের দুধ উৎপাদন ২০১৬-১৭ সময়কালের তুলনায় ২০২০-২১ সময়কালে প্রায় ৬৬.৬৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে, প্রকল্পের আওতায় দুধ উৎপাদন বিষয়ক প্রাপ্ত তথ্যটি হাবিব ও তাঁর দল কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া মহিষ ফ্যাটেনিং প্রযুক্তি সম্প্রসারণের ফলে মহিষের গড় ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বর্তমানে খামারীরা গড়ে ৪ মাসের মধ্যে পারিবারিকভাবে ষাড় মহিষ ফ্যাটেনিং করে বাথানে পালিত মহিষের তুলনায় মহিষ প্রতি গড়ে ৪০ কেজির বেশি ওজন পেয়েছে । অন্যদিকে মুররাহ জাতের ষাড় দিয়ে প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদিত বাচ্চার জন্ম ওজন গড়ে ২০.২ কেজি এবং একই জাতের মহিষের সিমেন দিয়ে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদিত বাচ্চার জন্ম ওজন গড়ে ২২.০ কেজি হয়েছে। সাধারণত বাথানে দেশি মহিষের ষাড় দিয়ে প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদন বাচ্চার গড় ওজন ১৬.৫ কেজি হয়ে থাকে।

মুররাহজাতের ষাড় মহিষ দিয়ে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদিত বাচ্চার জন্ম ওজন স্বাভাবিকভাবে বাথানে জন্ম নেয়ার বাচ্চার জন্ম ওজনের তুলনায় যথাক্রমে ২২.৪২% ও ৩৩.৩৩% বেশি হয়েছে। মহিষের মৃত্যুহার গড়ে ১৪.৫% থেকে ৩.১৫% এ এবং রোগাক্রান্তের হার ৯০.০% থেকে হ্রাস পেয়ে ২০.৯০% এ নেমে এসেছে। প্রকল্প এলাকায় দুধের মূল্য ৫৩.২২% এবং কেজি প্রতি মাংসের ২১.১১% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্থানীয় বাজারগুলোতে নিয়মিত বিরতিতে মহিষ জবাই হচ্ছে। সার্বিকভাবে প্রকল্প গ্রহণের ফলে প্রকল্পের সদস্যদের মহিষ পালন থেকে প্রাপ্ত গড় আয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া প্রকল্প গ্রহণের ফলে খামারীদের বিভিন্ন আচরণগত যেমন-খামারীরা দেশী মহিষের পরিবর্তে মুররাহজাতের ষাঁড় মহিষ প্রজনন করানো, নিজস্ব উদ্যোগে মহিষকে নিয়মিত ভ্যাকসিনেশন প্রদান, নিয়মিত কৃমিনাশক খাওয়ানো, মহিষ ফ্যাটেনিং, পারিবারিক পর্যায়ে দুধালো মহিষ পালন, ইউএমএস ও সাইলেজ খাদ্য প্রযুক্তি ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে পরিবর্তন হয়েছে।

মহিষের ব্রিডিং ফার্ম

উন্নত মুররাহজাতের ষাড় মহিষ এবং একই মহিষের সীমেন দিয়ে প্রজননের মাধ্যমে মহিষের জাত উন্নয়নের জন্য প্রকল্প হতে চাহিদা ও যোগান উভয় ক্ষেত্রেই কর্মকান্ড গ্রহণ করা হয়েছে। এ সকল ষাড় মহিষ এবং মহিষের সীমেন দিয়ে প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদিত বাচ্চার জন্ম ওজন ও শারীরিক বৃদ্ধি বাথানে পালিত দেশি মহিষের বাচ্চার তুলনা বেশি হওয়ায় স্থানীয়ভাবে এ জাতীয় ষাড় মহিষ এবং মহিষের সীমেনের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এ চাহিদার বিপরীতে স্থানীয়সহ দেশে যোগান না থাকায় খামারীদের প্রয়োজনীয় সংখ্যকে উন্নত মুররাহজাতের ষাড় মহিষ এবং মহিষের সীমেন সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। প্রকল্প এলাকায় মহিষের ব্রিডিং ফার্ম স্থাপনের মাধ্যমে মুররাহজাতের ষাড় মহিষ ও মহিষের সীমেন উৎপাদন ও যোগান দেয়া সম্ভব। এ প্রকল্পের শিক্ষণের উপর ভিত্তি করে পিকেএসএফ ইতিমধ্যে অপর একটি প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় জিজেউইএস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভোলাতে মহিষের ব্রিডিং ফাম স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে, যা হবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র মহিষের ব্রিডিং ফার্ম। এছাড়া দেশে বর্তমানে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্র্যাক, লালতীর নামক কিছু বেসরকারি বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মুররাহ জাতের মহিষের সীমেন উৎপাদন করছে। পাশাপাশি সরকারিভাবে মহিষ প্রকল্প-২ এর আওতায় কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন এবং দুগ্ধ খামার এবং বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষনা ইন্সটিটিউট এর আওতায় বর্তমানে মুররাহ মহিষের সীমেন উৎপাদন করা হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে এসকল সীমেনের প্রাপ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমেও সীমেনের যোগান দেয়া সম্ভব।

মহিষের দুধের ঘি

মহিষের জাত উন্নয়নের পাশাপাশি বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে ভোলাতে দুধ ও মাংসল মহিষ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এসেক্টরে এসকল কাঁচামাল হতে বহুমুখী দুগ্ধজাত পণ্য (ঘি, পনির, চিজ ইত্যাদি) ও মাংসজাত পণ্য (ফ্রেশ ও ফ্রোজেন মিট ইত্যাদি) উৎপাদন এবং তা যথাযথ উপায়ে দেশব্যাপি বাজারজাতকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে এবং সুযোগ তৈরী হয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য পিকেএসএফ ইতোমধ্যে RMTP প্রকল্পের আওতায় উপকূলীয় ভোলা জেলায় অবস্থিত জিজেইউএস ও এফডিএ নামক দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উপকূলীয় ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী অঞ্চলে বৃহৎ পরিসরে স্থানীয় ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরির মাধ্যমে নিরাপদ গুণগতমানের সুস্বাদু মহিষের ফ্রেশ ও ফ্রোজেন মাংস উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বিভিন্ন ভ্যালু চেইন কমকান্ড গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। একই সঙ্গে উক্ত প্রকল্পের আওতায় মহিষের দুধের তৈরি নিরাপদ বিভিন্ন উচ্চমুল্যের দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণেও বিভিন্ন কর্মকান্ড গ্রহণ করা হবে। পিকেএসএফ-এর এ সকল কর্মকান্ডের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর গবেষণা ইন্সটিটিউট যৌথভাবে চলমান দেশব্যাপী পরিচালিত মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প-২ আওতায় ভারত থেকে উন্নত মুররাহ জাতের ষাড় মহিষ এনে তার সাথে দেশি মহিষের ক্রসব্রিডিং, সিলেকটিভ ব্রিডিং এবং ইন্টার সি মেটিং এর মাধ্যমে দেশি মহিষের জাত উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। একই সাথে একই জাতের মহিষের সীমেন উৎপাদন ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে।

মহিষের ফ্রেশ মাংস

মহিষের স্বর্গ হিসাবে পরিচিত উপকূলীয় ভোলা, পটুয়াখালী ও বরিশাল অঞ্চলে মহিষ কেন্দ্রিক সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়নাধীন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজনন কৌশল ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ, উন্নত ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, মার্কেট লিংকেজ সৃষ্টি, বহুমুখি দুগ্ধ ও মাংসজাত পণ্য উৎপাদন ও সম্প্রসারণ ইত্যাদি কর্মকান্ডে সফল বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে একদিকে মহিষের উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে কর্মসংস্থান। বাড়তি আয়ের মুখ দেখবে উপকূলীয় প্রান্তিক উদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে দেশে বৃদ্ধি পাবে পুষ্টির যোগান।

লেখক: উপ-ব্যবস্থাপক, পিকেএসএফ।

বিভি/এফআই

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2