• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

কবি আইনুল হক মুন্না’র একগুচ্ছ কবিতা

প্রকাশিত: ১৮:২৮, ২৬ নভেম্বর ২০২১

আপডেট: ১৮:৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২১

ফন্ট সাইজ
কবি আইনুল হক মুন্না’র একগুচ্ছ কবিতা

ভালো কি মন্দ এসবের হিসাব মেলানো শিকেয় তুলে স্বপ্রণোদিত আমজনতা
কাঁধে তুলে নেন খাটিয়া। অস্ফুটে মুখে আওড়ান ‘বড় ভালো লোক ছিলেন’।
কিছু সুরা তর্জমা করে বয়ান দেন পাড়ার বড় মসজিদের বুজুর্গ মাওলানা
ভীত সস্ত্রস্ত মানুষেরা যেনো আরো ভীত হন সাথে যোগান ওয়াজ নসিহত।

 

কোরা থাকে হিসাবের খাতা

প্রত্যুষেই মারা গেলেন পাড়ার এক মাতুব্বর সবার জানা শোনা এক চাচা
কফিনে মরির মুখ ততক্ষণ খোলাই ছিলো যতক্ষণ না রোদ শুকিয়ে যায়।
বিহানের তাতানো রোদ যখন আরো তেঁতে উঠে, কেঁদে উঠে তার কন্যা
অদূরেই পাড়ার মহিলা জড়ো হলে দেখা যায় মাতম, যেনো উথলে উঠে।

শ্রাবণের ধারা তখন অবিরাম ঢেলে দেয় জগতের তাবৎ জলরাশি
দ্বিপ্রহর গড়ালো সেই কবে, পাড়ার ক্ষুদে দিগম্বর বালকেরা এই সময়
সেরে নেয় তাদের জলকেলি, জল ছুঁই ছুঁই গাছের ডালে কত খেলা।

কি রোগ কি শোকে তার মৃত্যু অশীতিপর মাতুব্বর কখনো দেয়নি জানান
মাতমের কিছু সুর থাকে, থাকে বয়ান। এ মুহূর্তে কিছুই বোঝা গেলো না
কারোর মাতমের ভাষা স্পষ্ট ছিলো না, গাছের মগডালে বসা কাকেরও।
যে যার ভাষায় আওড়ে যায় বুলি, সবই মরির গুণকীর্তন, সবই স্তুতি-বন্দনা
যেনো ফেরেস্তা, তার ছিলো না কোন গুণাহ, মন্দ কাজ-কর্মের কোন ফিরিস্তি।

মাতুব্বর সব কিছু শোনে, কি শোনে না, জানি না। শুনবেই বা কেনো
ভালো-মন্দ কিছু শোনার সময় যে তার নেই। তার এখন তাড়া জানাজার
ভালোয় ভালোয় জানাজাটা হয়ে গেলে বেঁচে যান তিনি। এখন তো
মহাব্যস্ত গোরখোদক, মরির দৈর্ঘ্য-প্রস্থের লাগসই মাপটা জেনে নিতে।

প্রহর কেটে সন্ধ্যা গড়ালেই জাপটে ধরবে যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার এই মর্ত্যে
সসম্মানে শায়িত হবেন মাতুব্বর নিজ আঙ্গিনায় তারও অধিক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে
হয়তো ডুকরে কেঁদে উঠবে আত্মীয়-স্বজন, কিছু পশু-পাখি আর বুভুক্ষু শেয়াল।

ভালো কি মন্দ এসবের হিসাব মেলানো শিকেয় তুলে স্বপ্রণোদিত আমজনতা
কাঁধে তুলে নেন খাটিয়া। অস্ফুটে মুখে আওড়ান ‘বড় ভালো লোক ছিলেন’।
কিছু সুরা তর্জমা করে বয়ান দেন পাড়ার বড় মসজিদের বুজুর্গ মাওলানা
ভীত সস্ত্রস্ত মানুষেরা যেনো আরো ভীত হন সাথে যোগান ওয়াজ নসিহত।

এভাবেই তো সবাই হিসাবের খাতা কোরা রেখে এগিয়ে যায় অন্তিমে
অন্তিম পথ শেষে আর কোন পথ তো থাকার কথা নয় যেনো!

 


পরিত্যক্ত বাড়িটা এখন

শচীনের বাড়িটা পরিত্যক্তই রয়ে গেলো। কোন দাবীদার নেই বলে
এখানে এখন নিয়মিত সভা হয় জ্বীন-পরী আর ভুত-প্রেতাত্মাদের
পলেস্তরা খসা বাড়িটার ইট-পাঁজর কেউ ব্যবচ্ছেদ করেছে বুঝি।
‘নানুয়া দিঘী’র নিস্তরঙ্গ ঢেউয়ের দোলায় বাতাসেরা খেলে যায় রোজ
ছিঁটেফোটা তারই আভাস খুসখুসে কাশির মতো জুড়ে বসে বাড়িটায়।
হাড় জিরজিরে বাড়িটায় ক্ষয়রোগ যক্ষা ধরেছে বহু কাল আগেই।

নগরীর বাস্তুকলাবিদ, ইতিহাসবেত্তা এমনকি ঐতিহ্য রক্ষাকারীর চোখ
এখন নিমগ্ন চিত্তে কি সব খোঁজে দালানের চুন পাথরের ভাঁজে ভাঁজে
পরগাছা বটমূল গোড়াশুদ্ধ তোলে আর অস্ফুটে বিড়বিড় করে যায়।
একদিন লাবণ্যে ভরা যৌবন ছিলো বাড়িটার দেয়ালে চুনকামের আড়ালে
দেব বর্মণ কেউ বুঝলো না কতটা নোনা অশ্রু ঝরিয়েছে পরিত্যক্ত বাড়ি,
নোনা অশ্রুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে গড়ছে ছাই-ভষ্মের পাহাড়।

শহুরে নাগরিক কিছুটা বিষ্ময়-আগ্রহে আড়ি পেতে চৌহদ্দিতে রাখে চোখ
দেখে শীতের প্রারম্ভে রোদেলা দুপুরে গল্পে মশগুল এক ঝাঁক তরুণী।
অল্প-স্বল্প বয়সী উঠতি যৌবনা মাড়িতে পুরেছে তবক দেয়া পান-
শহরময় রাতের অতিথি হয়ে ঘুরে ফিরে ক্লান্ত অবশেষে বিহানে ফিরেছে তারা।

গোছানো বাড়িটার মতো এখন আর ফুল ফোটে না বাগানে, ফোটে না জলপদ্ম
নীল নীল দুঃখ কষ্ট নিয়ে অযত্নে বেড়ে ওঠা গাছে গেয়ে ওঠে অযাচিত পাখিরা
অস্বাভাবিক জেনেও স্বাভাবিক হতে চাইছে পুরোনো প্রকৃতি, লাগোয়া চরাচর
চাঁদ উঠতে চায় আলোকিত জ্যোৎস্না সহকারে জোনাকীদের মহা সমাবেশে।

এভাবেই পরিত্যক্ত থেকে ‘রাজকীয়’ বাড়িটা অঢেল জমিয়েছে সব ইতিহাস
বড় ফাঁকা লাগে, মনটাও বেশ ফাঁকা হয়ে যায় শূন্য ভিটায় ভুতুড়ে আবাস।
হালে দেখি বদলেছে এর কিছূটা আদল, সবকিছু ঠিকঠাক যেন আগের মতো
জ্যান্ত হয়েছে বেশ, রূপশ্রী সাজে গায়ে-গতরে জেল্লা ধরেছে অনেকটাই তার।
হারানো যৌবন ফিরে পেতে আর সামান্য বাকি, তবু পরিত্যক্তই থেকে যাবে
প্রজাদের মনে আফসোস বলে কিছু থাকবে না, নব বধুর সাজে সজ্জিত হয়ে
জীর্ণ বাড়িটাই আবার জানান দেবে এটা শচীনের বাড়ি- শচীন দেব বর্মণ।

 

এক দরবেশি মাজারে

তিনি সরে বসলেন আমাকে তিন বিঘত তফাত রেখে নিরাপদ দূরত্বে
রাবণের পাশ থেকে সরে সস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে তাকালেন আমার দিকে
দূরত্বে রেখেছেন ক’টা পোড়া দেয়াশলাই আর গনগনে আগুনের হল্কা।
জাহান্নামের চেয়েও এ আগুন জ্বলুনি ধরায় অধিক যন্ত্রণায়,
আবাল সূর্যটা যেনো বে-রহম গেঁথে আছে বড়শীর আধারের মতো।

কালো সাদা আর খয়েরীতে ডোরাকাটা সেয়ানা শরীরে শীতের চাদরে
আপাদমস্তক ঢেকে রেখে তিনি আয়েশে ফুঁকছিলেন বিনি পয়সার বিড়ি
অর্ধাঙ্গিনীর পায়ের কাছে সযত্নে তুলে রাখলেন গোটাকয় বাহারী পুটুলি।
নামাজের ভঙ্গিতে ক্ষণকাল সিজদায় ছিলেন তিনি কেবলামুখী গতরাত
সহগামী যাত্রী তিনি, শোকের কালো পতাকার মতো আজানু লম্বিত
সোনালী রূপালী বুটিদার পাঞ্জাবীতে যেনো ঝুলে আছে হাতের তসবীহ। 
সমস্ত ইবাদত বন্দেগী পাশে রেখে খোলাসা হলেন অবশেষে-
শীর্ণ হাত খুঁজে ফেরে কিছু আমার চারিদিকে কাতর চোখে।

আমরা চলেছি রেলের বগিতে যার যার গন্তব্য সে সে জানে
কোন স্টেশনেই ভেড়ে না গাড়ি কোন স্টেশনেই নেই সিগন্যাল
একপেশে গাড়ি সিটি দিয়ে যায়, টিটিও এ যাবৎ আসেনি কেউ।
কিছু ভোগান্তি বুকে ও পকেটে পুড়ে উসখুস করছি কেবল,
সামনেই বুঝি গস্তব্য কারোর মানুষের উচ্চকিত ধ্বনি শোনা যায়
উৎসুক কেউ কেউ ঝুঁকে পড়েছে, জানালায় মাথা গলালো কেউ
সবাই যেনো নেমে পড়বে এখানেই মুখে তকবীর তকবীর।

আমার চোখ দূরে অনন্ত আকাশের নিচে নিষ্ঠাবতী মায়ের ব্যস্ততা দেখে
কোলে-কাঁখে-জরায়ুতে সন্তান তার- তিন তিনটে সচল প্রাণ।
পোড় খাওয়া মলিন চেহারা ঢেকেছে রোদ, ছায়া ছায়া অন্ধকার
বেচারী দাঁড়ায় কোন এক ইস্টিশনে দারাপরিবার সমেত
বাজুবন্ধে শোভা পায় আজমেরী তাগা, কোন এক দরবেশি মাজারে।

স্থান সংকুলান করে এবার তিনি উঠে যান বগলে থাকে অর্ধাঙ্গিনীর হাত
বিস্তর লোক নামে তার অনুসারী সকল, আমিই থেকে যাই কেবল 
তিন-সন্তানের জননীর দিকে বাতাসের স্রোতে পাঠাই চোখের ভাষা।

 

সার্বিক মৌনতার উর্ধ্বে

স্নায়ুর হিরন্ময় জ্যোৎস্নায় কখনো ঝড় যদি আসে, আসুক
অবেলায় নিশ্চয় জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরম ছড়াবে বাতাসে;
        হঠাৎ করেই যদি বজ্রপাত ঘটে, ঘটুক
ঘটুক আগমন স্বর্গের দ্যুতিমান অশরীরী দূতের
হাতের পাঞ্জায় ভাঙ্গুক আপনার মুখের চাবি দেয়া সব তালা।

তড়িৎ কখনো হৃদষিজ হলে প্রেম তারুণ্যে যৌবনে
কৈশোরের আপাত সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে হলে ভোর
        শালিক-দোয়েল পাতিকাকের দেশে
যদি হতে হয় সম্মুখীন লিচুর বাগানের মালির পুনরায়
কিম্বা পুরো সৃষ্টিটা তরমুজের মতো গড়াগড়ি খেলে সবুজ প্রান্তরে
আকাশ যদি পাতাল হতো, আর পাতাল হতো আকাশ
        তখন আপনার মৌনতা ভাঙতো কি সন্ন্যাসী?

প্রেমিক প্রেমিকাকে কবিতার আলিঙ্গনে জাপটে
শারদীয় আঙ্গিনায় ইতস্তত ফুলহাতে দুয়ারে ধর্ণা দেয়া
প্রমিলা দেবীর মতো কোন ষোড়শী আপনার অজান্তে
        যদি হাতে হাত রাখে ইচ্ছেকৃত হৃদয়ে-
ধর্মান্ধতা ভুলে চির সজীবতায় আবার সেই ইচ্ছেগুলোতে
যৌবনের বীজ কি খেলা করবে, নীল বাসনায়?

বস্তুত অস্তিত্বের পাঁজরে যদি কেউ তুমুল মারে লাথি
পুনর্বার বাঙ্গালিত্বের আপাদমস্তক হয় বন্দুকের টার্গেট;
যেমন করেছে পাক-হানাদার ভ‚তপূর্বে ইংরেজ বেনিয়ারা।
চকিতে আবার যদি কেউ দুঃসাহসিকতায় ছোঁড়ে কাদা
সেয়ানে সেয়ানে একত্রিত আপনার কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশে-
যদি কখনো মহাশৃঙ্গার ওঠে ললিত শোনাতে মৃত্যুর আবাহন
তখন যদি ছুঁড়ি উত্তপ্ত গ্রেনেড প্রভুর নামে হে সন্ন্যাসী
আপনার সার্বিক নিস্তব্ধ নিষ্ক্রিয় মৌন মূককে কেন্দ্র করে
            যে হাত থেমে আছে সে হাতে
তখনও কি উঠবে না কোনো কাগজে বিমূর্ত হয়ে
        এক একটি সাবলীল বিদ্রোহী ভাষা?

 

নিঃশ্বাসে ভয় বড় কষ্ট

ক্রমান্বয়ে যুদ্ধের সাথে সন্ধিগত সম্পর্ক খুঁজতে খুঁজতে লাশ হয়ে যায় মানুষ-
যবনিকার মতো পতিত হয় উজ্জ্বল নক্ষত্র তারকারাজী বৃষ্টিতে যেমন বজ্রপাত
সমুদ্রের এক রকম গর্জন আছে উত্তাল তরঙ্গে অসংখ্য বাঁক
দৈবাৎ কখনো যেন উঠে আসে উদ্ভাসিত দানব সঙ্গীতের সিম্ফনিতে।

চাঁদ আনে চাঁদের জ্যোৎস্নায় নাব্যতা, আনে সফেদ কুয়াশার স্রোতধারা
গাছ-বিচালি-শ্যাওলা তরুলতা এখন বেড়ে উঠে পই পই আমার সমান
কখনো মাঝ আকাশে বাঁকা চাঁদ হেসে লুটোপুটি খায়
অ্যাকুরিয়ামে এখন বাড়ন্ত বয়স মাছেদের আমার সমান।

বেলে হাঁসের কাদামাখা ধূপছায়া রঙ পালকের পলকায়
চিকচিকে ধূসর বালু চমকায় রূপালী মাছের আঁশটের মতো
সরল-বক্র-যৌগিক রেখার আঁকিবুকি ঠাসা বুননিতে
            আমার শৈশব ছিল আ-কৈশোর ঘেরা
সামান্য কিছু পাপড়ির নির্যাস সুগন্ধি ফুলের- হাতের কোমল পেলবতা
ছিল যৎসামান্য শাসকের শাসন চোখের মায়াবী কোটরে গাঁথা
সে সব গেছে ঝড়ের তোড়ে নদী থেকে সাগর ও নদীতে।

আমার হৃদপিণ্ডে বাম অলিন্দের পাশাপাশি চেপে বসে
            জগতের জগদ্দল পাথর সব
শেকড় গজায় আমুল বিদ্ধ হয় আমার বুকের চতুর্বেদিতে
            নিঃশ্বাসে ভয় বড় কষ্ট এখন।

চেনাজানা সব কিছুই ছেড়ে যেতে ইচ্ছে আনকোরা ফানুসের মতো
তাবৎ বিশ্বে এখন ছড়ানো ছিটানো হতাশা অলিন্দের ঘুটঘুটে অন্ধকার যেমন
চোখ মেলতেই জাপটে ধরে এক দঙ্গল উল্লম্ব আত্মার প্রেতাত্মা
সবকিছুই চেনাজানা তবু অজ্ঞাত ভয় সঙ্গী হয় নির্নিমেষ নির্লিপ্ত শয্যায়।

সামনেই বিস্তর উষর পথ, পথে পথে নির্জনতার সঙ্গী-সাথী
চেনা জানা মানুষের মতো আমার ছায়াও এখন নির্বাসিত
এখন অন্ধকার ভীষণ অন্ধকার সাগর সাঁতরে পৌঁছাবো অনেক দূর
অনেক অতীতে, অতীতের গভীরে অতলান্ত সাগর ঘেঁষা কোনো কূল কিনারায়।

বিভি/এসডি

মন্তব্য করুন: