• NEWS PORTAL

  • বুধবার, ১৫ মে ২০২৪

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

কন্যা হওয়ার অপরাধে মুখে বিষ ঢেলে দিয়েছিলো পিতা, সেই মেয়ে পুলিশ

পরিতোষ চৌধুরী আদিত্য, রাজশাহী

প্রকাশিত: ১৬:৩৮, ১১ এপ্রিল ২০২২

আপডেট: ১৬:১১, ২৭ এপ্রিল ২০২২

ফন্ট সাইজ
কন্যা হওয়ার অপরাধে মুখে বিষ ঢেলে দিয়েছিলো পিতা, সেই মেয়ে পুলিশ

রাজশাহী বাঘায় কন্যা সন্তান হওয়ার অপরাধে ৯ মাসের শিশু লিজার মুখে বিষ ঢেলে হত্যার চেষ্টা করেছিলো তাঁর পাষন্ড পিতা রিফাজ। সেই নিষ্পাপ মেয়েটি বড় হয়ে কঠোর পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে জয় করেছে সোনার হরিণের মতো মূল্যবান পুলিশের চাকরি। পাশাপাশি পড়ছেন রাষ্ট্র বিজ্ঞান নিয়ে অর্নাস। তাকে নিয়ে এখন গর্ববোধ করছেন পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী। 

জীবন যুদ্ধে সংগ্রামী এই মেয়েটি বাবার শাস্তি নয়, বাবা যেন তাকে নিয়ে গর্ব করেন এটাই তাঁর প্রত্যাশা। এদিকে রাজশাহী পুলিশ সুপার জানালেন সরকারের নতুন এই চাকরি প্রদ্ধতিতে অনেক অস্বচ্ছল পরিবারের মেধাবীদের চাকরির সুযোগ হয়েছে। 

রাজশাহী বাঘা উপজেলা নারায়নপুর গ্রামের বুলবুলি বেগমের ১৬/১৭ বছরেই বিয়ে হয় একই উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামের দিনমজুর রিফাজের সাথে। বিয়ের পর থেকেই শান্তি ছিল না তাদের সংসারে। বিয়ের দুই বছরের মাথায় বুলবুল বেগমের কোল আলো করে পৃথিবীতে আসে তাদের কন্যা সন্তান লিজা। আর এতেই সংসার বলতে যেটুকু ছিলো তাও লন্ডভন্ড হয়ে যায়। প্রথম সন্তান কন্যা হওয়ায় কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি তাঁর পিতা। লিজার বয়স যখন ৯ মাস, তখন পাষণ্ড পিতা রিফাজ নিষ্পাপ শিশুর মুখে বিষ ঢেলে দেয় হত্যার উদ্দেশে। দূর থেকে বিষয়টি আচ করতে পেরে তার মা দ্রুত স্থানীয় হাসপাতাল বাঘা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখানে মেয়েকে সুস্থ করে চলে যান তার বোনের বাড়ি, লিজার খালার বাসায়। সেখানেই লিজার দারিদ্রতার সাথে লড়াই সংগ্রাম করে বেড়ে উঠা। 

আরও পড়ুন:

সেখানেই মামা খালাদের কাছে থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেকে প্রস্তত করতে থাকেন প্রতিষ্ঠিত করার জেদ নিয়ে। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বাঘা শাহাদৌলা ডিগ্রী কলেজে অনার্সে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয় চলতি শিক্ষাবর্ষে। গত মাসে পুলিশে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন। এরপর বাকী ধাপগুলো নিজের যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে জয় করে নেন লিজা। 

লিজা খাতুন জানিয়েছেন, তার এই পথ খুব একটা সহজ ছিলো না। তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেন বাবা নেই, মা খালা ও মামার সহযোগিতায় তাকে মানুষ করছেন। অনেকেই বলতো বাবা নেই, সেই কারণে তার মা তাঁকে মানুষ করতে পারবে না। বাবা সঙ্গে না থাকায় খালা ও মামারা তাঁকে স্কুল কলেজে পড়ান। অনার্সেও ভর্তি করে দেন। শিক্ষকরাও অনেক সাহায্য করেছেন। প্রাইভেট পড়িয়ে অনেক শিক্ষক টাকা নেননি। 

লিজা আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, একটু বড় হওয়ার পর শুনেছে তার বাবার নিষ্ঠুরতার কথা। বাবাকে এখনো তার দেখা হয়নি। তার বয়স যখন ১০ মাস তখনই কাজের সন্ধানে ঢাকায় যাওয়ার নাম করে তাদের ছেড়ে চলে যান, আর ফিরে আসেননি। এমন কি তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করেননি। 

লিজা জানান, ছোট বেলা থেকেই তার জেদ ছিলো ভালো কিছু করার। এসএসসি পাশ করার পর নিজের আলাদা একটি পরিচয় করার সেই জেদ তার মনের মধ্যে চেপে বসে। প্রতিটি সন্তানের কর্তব্য মা বাবাকে দেখার। আমার মাকে দেখতে হবে। সেই থেকেই কঠোর পরিশ্রমী মনোভাব তৈরী করেছিলো। লিজা জানায়, তার সংগ্রামী জীবনে অনেক কিছুই চেষ্টা করেছে। কিন্তু খুব একটা সফল হয়নি। এরপর এবছর পুলিশের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে ১৫০ টাকা খরচ করে আবেদন করেন। এরপর উচ্চতা, শরীর চর্চা, লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভাসহ সাতটি ধাপ পার করে তার মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে। এরপর পুলিশের চুড়ান্তভাবে মানোনিত হওয়ার পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। 

আরও পড়ুন:

লিজা জানান, তার এই চাকরির জন্য কারো সুপারিশ, তদ্বির করা লাগেনি। আবেদনের খরচ ছাড়া আর একটি টাকা কোথাও দিতে হয়নি। তিনি বলেন এজন্য রাজশাহী পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন স্যার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। এতো সুন্দর পদ্ধতিতে কোনো ব্যক্তির সুপারশ ছাড়াই পুলিশের চাকরি হবে আগে ভাবিনি। 

এক প্রশ্নের জবাবে লিজা জানান, বাবার কৃতকর্মের জন্য তাকে শাস্তি দিতে চান না, বাবা যে মেয়েকে হত্যা করতে চেয়েছিলো সেই মেয়ের জন্য যেন এখন গর্ববোধ করেন। লিজা বলেন, পুলিশের চাকরি করে তার মতো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান।  

লিজার মা বুলবুলি বেগম তার কষ্টের কথা বলেতে গিয়ে জানান, ২০ বছর আগে তার বিয়ে হয়। দিনমজুর স্বামীর কাজ তেমন ছিলো না। বিয়ের পর স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। মেয়ে সন্তান হওয়ার পর নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। লিজার বয়স যখন ৯মাস তখন তার চোখের সামনেই মেয়ের মুখ বিষ ঢেলে দিতে দেখন স্বামীকে। এসময় দ্রুত স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেওয়ার পর ডাক্তার পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে জানান বিষ মুখের মধ্যেই ছিলো। 
পাকস্থলিতে যায়নি। গেলে তার সন্তানকে হয়তো বাঁচানো যেতো না। এই ঘটনার পর তার বোনের বাসায় চলে যান। এরপর নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং আর কখনো এই ধরনের কাজ করবে না প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়িতে আসার কিছু দিন পর ঢাকায় চাকরি করতে যাওয়ার নাম করে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। তিনি ও তাঁর ভাইবোন মিলে অনেক কষ্ট করে মেয়েকে মানুষ করেছেন। এখন পুলিশে চাকরি হওয়ায় তিনি অনেক খুশি। এজন্য রাজশাহী পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।   

রাজশাহী পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বিপিএম (বার) বলছেন, লিজা অনেক মেধাবী। সে ১০ হাজার প্রার্থীর মধ্যে একজন ছিলো। নক আউট সিস্টেমে একেরপর এক পরীক্ষার ৭টি ধার পার করে আজ পুলিশের চাকরি পেয়েছে। 

তিনি বলেন, পুলিশের চাকরির অনিয়ম ও তদবির ও সুপারিশ বন্ধ এবং সরকারের নতুন চাকরি প্রদ্ধতির কারণে বহু অস্বচ্ছল পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীরা পুলিশের চাকরি পাচ্ছে। এবছর রাজশাহী জেলায় যে ৭২ জন চাকরি পেয়েছে। এদের বড় একটি অংশ অস্বচ্ছল পরিবার থেকে আসা। আশাকরি আগামীতে এই সব সদ্য নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্যরা দেশ ও জাতীর মুখ উজ্জল করবে। পুলিশের নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। 

বিভি/এএন

মন্তব্য করুন: