• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫

প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি: আশার আলো, শঙ্কার ছায়া

মো. ওবায়দুল্লাহ, ঢাকা কলেজ 

প্রকাশিত: ১৭:৫১, ২ অক্টোবর ২০২৫

আপডেট: ১৮:৫৭, ২ অক্টোবর ২০২৫

ফন্ট সাইজ
প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি: আশার আলো, শঙ্কার ছায়া

রাজধানীর  সরকারি সাত কলেজর সমন্বয়ে গঠিত প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে হাইব্রিড মডেলে সাতটি ক্যাম্পাসকে চারটি স্কুলে ভাগ করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এই খসড়া ঘিরে কলেজগুলোতে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক ও বিভাজন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা—এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে হারিয়ে যাবে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, সংকুচিত হবে ভর্তি সুযোগ, বিপন্ন হবে নারী শিক্ষা ও চাকরির নিরাপত্তা। অন্যদিকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা আশঙ্কা করছেন, বিশ্ববিদ্যালয় হলে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে যাবে। 

রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন নানা সমস্যায় ভুগলেও সম্প্রতি তাদের মাঝে নতুন করে আশার আলো জেগেছে। প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি গঠনের উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের মনে উচ্চশিক্ষার নতুন দিগন্তের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষার্থীরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কালীন সময়ে প্রশাসনিক জটিলতার কারণে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তে হতো। তবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে সেশনজট নিরসন, নিয়মিত পরীক্ষা ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ তৈরি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা, আধুনিক পাঠক্রম, গবেষণার সুযোগ এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা সুবিধা পাওয়া সম্ভব হবে।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর  ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশ করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয় সাতটি কলেজকে চারটি স্কুলে বিভক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এর মধ্যে স্কুল অব সায়েন্সের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ। স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিসের জন্য কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহওয়ার্দী কলেজের ক্যাম্পাস নির্ধারণ করা হয়েছে। স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিসের জন্য সরকারি বাংলা কলেজ এবং স্কুল অব বিজনেসের জন্য সরকারি তিতুমীর কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী প্রথম চারটি সেমিস্টার নন মেজর কোর্সে অধ্যয়ন করবে। প্রথম চার সেমিস্টার সাধারণ বিষয়, পরের চারটি সেমিস্টার ডিসিপ্লিনভিত্তিক। বিশ্ববিদ্যালয় চলবে বিকেল ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত।

খসড়া অনুযায়ী, কলেজগুলোর উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের পাঠদান সকালে এবং নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চলবে দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। 

উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা বলছেন, অধ্যাদেশে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ নেই কারা ক্লাস নেবে এবং কীভাবে পরিচালিত হবে। তারা প্রস্তাব করেছে সকালে ইন্টারমিডিয়েট এবং দুপুর থেকে অনার্স ক্লাস চালু থাকবে।

এই কাঠামোর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সাত কলেজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক মাহফিল আরা বেগম বলেন, “টাইম শেয়ারিং ও হাইব্রিড মডেল কার্যকর নয়। আমাদের শিক্ষকরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, পরীক্ষা, খাতা দেখা ও প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। এই অবস্থায় আলাদা আলাদা শিক্ষার্থীকে পড়ানো সম্ভব নয়।”

অধ্যাদেশের খসড়া প্রসঙ্গে খসড়া কমিটির সদস্য তানজিমুদ্দিন খান বলেন,  “আমাদের দায়িত্ব ছিল খসড়া (ড্রাফট) তৈরি করা। আমরা সেই খসড়া প্রস্তুত করেছি, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্পূর্ণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ।এই কলেজগুলো মূলত ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। অনার্স খোলা হয়েছিল, সেটি নিয়েই স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্ন উঠেছে। তবে খসড়ায় স্পষ্ট বলা আছে— ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষা বোর্ডের অধীনেই চলবে, আগে যেভাবে চলছিল সেভাবেই চলবে।আমাদের টার্মস অফ রেফারেন্স ছিল শুধু প্রস্তাব তৈরি করা। প্রায় ২৩-২৪টি কনসালটেশন মিটিং হয়েছে, দীর্ঘ আলোচনার পর খসড়াটা তৈরি হয়েছে। এখন কোন পরিবর্তন আনা হবে সেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার।শিক্ষকদের যোগ্যতা বা নিয়োগ প্রসঙ্গ খসড়ায় নেই। এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে, আমাদের এখতিয়ারে পড়ে না।আমাদের কাজ শেষ। এখন অভিমত আসবে, মন্ত্রণালয় চাইলে পরিবর্তন আনবে। এখানেই আমাদের ভূমিকা শেষ।”

ভর্তি সংকোচন
খসড়া অনুযায়ী, প্রতি বিভাগে সর্বোচ্চ ৪০ জন ভর্তি সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে যেখানে কোনো কোনো কলেজে একটি বিভাগে ২০০–২৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হতো, সেখানে এক লাফে এই সীমাবদ্ধতা হাজারো শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার বাইরে ঠেলে দেবে। 

ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী কাজী হাফসা মেহেজাবিন বলেন, “সিট সংকোচনের কারণে দূরদূরান্তের ছাত্রীদের সুযোগ আরও সীমিত হবে। ধাপে ধাপে আসন কমানো সম্ভব হলেও একসাথে সংকোচন ন্যায্য হবে না।”

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় ভর্তি-সুযোগ নিয়ে উদ্বেগ নতুন নয়। বর্তমানে ১২ লাখ শিক্ষার্থী কলেজ পর্যায়ে ভর্তি হলেও অনার্সে সুযোগ পায় তার প্রায় অর্ধেক। সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির এই সীমাবদ্ধতা সেই সংকট আরও বাড়াবে।

অপরদিকে,  বদরুন্নেসা কলেজের ইমু তরফদার  মনে করেন, “খসড়া অধ্যাদেশ নারী শিক্ষার সুযোগ সীমিত করবে না, বরং মানোন্নয়ন ঘটাবে। এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন গুটিকেয়ক ব্যাক্তির কথায় তো অন্য কিছু হতে পারে না। 

এছাড়াও খসড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ টি অনুষদ থাকলেও বাদ পড়েছে ধর্মীয় বিষয়গুলো : ইসলামিক স্টাডিস, ইসলামের ইতিহাস সহ অন্যান্য সাবজেক্ট।শিক্ষার্থীরা বলছেন, আমাদেরকে ধর্ম থেকে সরিয়ে রাখতেই ধর্মীয় বিষয় বাদ দেওয়া হয়েছে। 

শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ মুজিবুর রহমানের মতে, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, আবার নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর—প্রত্যেক ধাপে নীতি ও দর্শনের অভাবেই সংকট তৈরি হয়েছে। সাত কলেজ মিলে এক বিশ্ববিদ্যালয় করার চেয়ে প্রতিটি কলেজের নিজস্ব ঐতিহ্য বজায় রেখে ধাপে ধাপে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা বেশি যৌক্তিক।”

আশঙ্কায় উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা 
বিশ্ববিদ্যালয় হলে ইতিহাস ঐতিহ্য হারাবে বলে মনে করছেন উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের এক শিক্ষার্থী জানান, আমরা চাই ঢাকা কলেজের নাম এবং ঐতিহ্য রক্ষা হোক। ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ঐতিহ্য বজায় রাখা, যাতে ভবিষ্যত শিক্ষার্থীরাও নিজেদের ঢাকা কলেজের অংশ মনে করতে পারে। কলেজের শতবর্ষের ইতিহাস হারালে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা এবং আত্মপরিচয় প্রভাবিত হতে পারে।  

এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে  আন্দোলন করা  বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা জানি না পুরো বিষয়টি কিভাবে বাস্তবায়িত হবে। আমাদের শিক্ষকরা, যেমন তাজুল ইসলাম স্যার (প্রাণিবিজ্ঞান  ডিপার্টমেন্ট), জাকারিয়া স্যার (ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট) আমাদের জানিয়েছেন যে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়  অন্তর্ভুক্ত করলে ইন্টারমিডিয়েট উঠিয়ে দিবে তাই আন্দোলন করেছি। আমাদের আন্দোলন এই ইস্যুতে কেন্দ্রভূত, যাতে কলেজের ঐতিহ্য বিলুপ্ত না হয়।”

সংকটে শিক্ষা ক্যাডার
সাত কলেজে আছেন প্রায় ১৪০০ বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থেকেই কাজ করতে চান। কিন্তু নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোতে শিক্ষক হতে হলে গবেষণা ও উচ্চতর ডিগ্রি বাধ্যতামূলক।

শিক্ষা ক্যাডারেরা চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে উল্লেখ করে মাহফিল আরা বেগম বলেন “সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হলে প্রায় দেড় হাজার শিক্ষা ক্যাডারের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ হবে, কিন্তু যোগ্যতার মানদণ্ড কি এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী নই, তবে চাই শক্তিশালী কমিটি গঠন হোক, জনমত যাচাই করা হোক এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার দিয়েই পরিচালিত হোক।”

হতাশ বর্তমান শিক্ষার্থীরা, খসড়া অনুযায়ী ২০২৩–২৪ ও ২০২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্ত  সাপেক্ষে সনদ পাবেন, অন্যদিকে বাকি শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। এতে শিক্ষাবর্ষভিত্তিক বিভাজন।

ঢাকা কলেজের ২০২১-২২ সেশনে শিক্ষার্থী  রবিউল বলেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রেখে দেওয়ার খসড়া প্রস্তাবনার সমালোচনা করে বলেন, যে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা, পরিচয় সংকটে এবং সেশনজটের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে রাজপথে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেছেন, সেই চলমান সেশনগুলোকেই (২০২০-২১ থেকে ২০২৪-২৫) এই খসড়া অধ্যাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রেখে দেয়া হয়েছে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগামী ২ অক্টোবরের মধ্যে প্রকাশিত খসড়ার ওপর অংশীজনরা মতামত দিতে পারবেন বলে।

কর্মচারীদের আশঙ্কা
১৫ বছর ধরে ইডেন  কলেজে কর্মরত মাজহারুল ইসলাম বলেন, “আমরা জানি না নতুন কাঠামোতে চাকরি টিকবে কিনা। নিয়ম যদি কঠিন হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তিনি বলেন, কর্মচারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা সীমিত—প্রধানত প্রাইমারি বা এইট পাস। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষিত কর্মচারী নিয়োগ করা হলে তাদের চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়বে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তবর্তী প্রশাসক অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, মন্ত্রনালয় কতৃক  বাজেট দিল কর্মচারীদের চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ সম্ভব। 

উল্লেখ্য, সাত কলেজ  জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর এই কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। তবে অধিভুক্তির পর নানা ভোগান্তির কারণে  বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে আসেন। আট বছরের মধ্যে ক্ষুদ্র সমস্যাগুলো বড় রূপ নেয়, এবং গত জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয়, সাত কলেজকে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা করা হবে। তবে গত ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে আসে সাত কলেজ।

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2