• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫

কলকাতায় দুটি টিপু সুলতান শাহী মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

জ্যোতির্ময় দত্ত, কোলকাতা

প্রকাশিত: ১৩:২৯, ৬ জুলাই ২০২৩

ফন্ট সাইজ
কলকাতায় দুটি টিপু সুলতান শাহী মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

ধর্মতলা টিপু সুলতান মসজিদ

৩০০ বছরের পুরোনো কোলকাতা শহরে একই নামে দুটি বিখ্যাত মসজিদ আছে। আসল নাম "টিপু সুলতান শাহী মসজিদ"। আমজনতা কিন্তু দুটিকেই "টিপু সুলতান মসজিদ" নামেই জানে। শুধুমাত্র বাদ পড়েছে ‘শাহী’ শব্দটি।        

  টিপু সুলতান

প্রথমটি, কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় (ESPLANED) এবং দ্বিতীয়টি প্রিন্স আনোয়ার শা রোড ও দেশপ্রান শাসমল রোডের সংযোগস্থলের কোনে, যা টালিগঞ্জ নামে বহুল পরিচিত। ধর্মতলা অঞ্চলের মসজিদটি ধর্মের কারণে তৈরী হলেও, দ্বিতীয়টি শুধুমাত্র উপাসনার উদ্দেশ্যে তৈরী হয়েছিল না, এর সাথে একটি মিউজিয়াম তৈরীর পরিকল্পনাও ছিলো সেই আমলে।

ঐতিহাসিক এই দুটি মসজিদের নথি পাওয়া দু:সাধ্য এমনকী মসজিদের পরিচালনা যারা করছেন তাঁদের কাছেও এ বিষয় সঠিক কোন তথ্য নেই বললেই চলে। যারা ইমাম আছেন তাঁদের কাছেও এর ঐতিহাসিক তথ্য প্রায় অধরা। 

 মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সন্ধান করতে গিয়ে জানা যায় টিপু সুলতানের পরিবারের অনেকেই এখনও জীবিত। কেউ থাকেন বিরাট অট্টালিকায় অথবা কেউ  অন্য কোথাও। সে কথা থাক, আজ আমরা মসজিদ সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল হবার চেষ্টা করি ।


 প্রিন্স গোলাম শাহ ওয়াকফ ট্রাস্টি থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে সম্পূর্ণ ইতিহাস উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কিছু নথি এখনও থাকলেও তা ওলোটপালোট করার ইচ্ছাও নেই কারোরই।

টিপু সুলতানের ১১তম ও সর্ব কনিষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ প্রিন্স গোলাম শাহ দ্বারা নির্মিত প্রথম মসজিদটি কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে। ১৮৩২ সালে ধর্মতলায় জমি কিনে এই অপরূপ সৌন্দর্যশালী মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, তাঁর বাবা টিপু সুলতানের স্মরণে। যা সম্পন্ন হয় ১৮৪২ সালে। ১৬টি গম্বুজ ও ৪টি মিনার দ্বারা মসজিদটি নির্মিত। মসজিদের ভিতরে একসাথে পনেরোশো মানুষের নামাজ পড়তে পারে। ঈদের সময় মসজিদটিকে কেন্দ্র করে চারপাশে প্রায় পনেরো হাজারের মত মানুষ নামাজ আদায় করে থাকেন । এটি কলকাতার সৌন্দর্যশালী স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি বড় নিদর্শন। মসজিদটি দেশী বিদেশী পর্যটকদের কাছেও একটি আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু।

১৯৮০-র দশকে মাটির তলা দিয়ে মেট্রোরেল নির্মানের কাজ শুরু হবার পর এই  টিপু সুলতান মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেটি মেরামত করবার জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। পরবর্তীতে, টিপু সুলতান শাহী মসজিদ সুরক্ষা ও কল্যাণ কমিটি এবং মেট্রো রেল যৌথ প্রচেষ্টায় মসজিদটি পুনরুদ্ধার হয়। ২০০৪ সালে সুনামি ঝড়ের সময়ে মসজিদটি আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৎকালীন ভারতবর্ষের  প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মসজিদ কমিটিকে ২১হাজার ৫০০ ডলার দান করেন।এর ফলে আসল মসজিদটির স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক অবলুপ্তি ঘটেছে অনেকটাই।

টিপু সুলতান মাইসোরের নবাব থাকা সত্বেও তাঁর ছোট ছেলে মাইসোরের থেকে দূরে তাঁর বাবার স্মরণে কলকাতায় কেনো এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, এর পিছনেও রয়েছে একটি ইতিহাস। মাইসোর যার অতীতে নাম ছিলো মহীশুর। বতর্মানে অঞ্চলটি দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে অবস্থিত।
 ওয়াদিয়ার রাজবংশের রাজত্বকালে ১৭৫০-এর দিকে সুলতান হায়দার আলীর জ্যেষ্ঠ পুত্র মহীশুরের নবাব হন, টিপু সুলতান। পুরো নাম সইয়দ ওয়াল শহরীফ সুলতান ফতেহ আলী সাহাব টিপু।

টিপু সুলতানের রাজত্বকাল ছিলো ১০ইশে নভেম্বর ১৭৫০ থেকে ৪ই মে ১৭৯৯ পর্যন্ত । একদিকে তিনি যেমন সুলতান ছিলেন, অন্যদিকে ছিলেন বড় পণ্ডিত ও কবি। মাইসোরের রাজধানী শ্রীরঙ্গপট্টনম ব্রিটিশ শাসক বাহিনীর দ্বারা  দখলিকৃত হয়।  টিপু সুলতানের মৃত্যুর ছ’বছর পর তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক ১৮০৬ সালে টিপুর পরিবারকে স্থানান্তরিত করে কলকাতায়। কারণ হিসাবে জানা যায় , একদিকে রাষ্ট্র থেকে ছত্রভঙ্গ করা এবং তাঁদের নজরিকৃত করা। এইভাবেই ধীরে ধীরে তাঁরা হয়ে ওঠেন কলকাতাবাসী।

টিপু সুলতানের পুত্র গোলাম মোহাম্মদ যখন কলকাতায় আসেন তখন তিনি ছিলেন ছোট্ট শিশু। তিনিও ছিলেন তাঁর পিতার মতই বিভিন্ন গুণাবলী সম্পন্ন। তিনিও বিভিন্ন সামাজ কল্যান কাজের সাথে জড়িত ছিলেন।

টালিগঞ্জের টিপু সুলতান মসজিদ

টালিগঞ্জের দ্বিতীয়টি মসজিদ নির্মানের পাশাপাশি একটি মিউজিয়াম তৈরী করার পরিকল্পনাও করেন গোলাম মোহাম্মদ। পাঁচ বিঘা (১শো’কাটা) জমির পশ্চিম পাশে এই মসজিদটি অবস্থিত। যেখানে ধর্ম কাজের পাশাপাশি কলকাতার মানুষ তার পিতার ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে তার জন্যেই মিউজিয়াম তৈরীর ভাবনা এসেছিলো তার মাথায় । তিনি মিউজিয়ামটির নাম দেন 'মহীশূরের টাইগার'। তার কারন টিপু সুলতান ‘টাইগার অফ মহীশূর’নামেও পরিচিত ছিলেন । 

ঠিক হয়েছিল জাদুঘরটি টিপু সুলতান মসজিদের সামনে স্থাপন করা হবে না। এটা করা হবে কিছুটা দুরে। যেখানে থাকবে সুলতানের ব্যক্তিগত বস্তু এবং সামরিক অস্ত্র ও কামান
 একসময় যে কামানে লোহার গোলা ব্যবহার করে শত্রুদের আঘাত হেনে ছিলেন তিনি । পাচটি বৃহৎ গম্বুজ, চারটি বড়ো মিনার ও ১৬টি ছোটো মিনার দ্বারা মসজিদটি নির্মিত এই মসজিদটি। ঈদের সময় মসজিদটিকে কেন্দ্র করে প্রায় ১০ হাজার মানুষ একসাথে নামাজ আদায় করেন।

কিন্তু বর্তমানে টালিগঞ্জের এই মসজিদটির পরিবর্তন ভীষণভাবে লক্ষ্যনীয়। কোনো এক অভুত কারণে বছরের পর তালাবটি জলশুন্য। মিউজিয়ামের কিছুই খুজে পাওয়া যায় না।কথিত আছে এখানে সুলতানের বংশধরের ১৩ জন আত্মীয় কবরে শায়িত। সময়ের সাথে সাথে কবরের চাকচিক্য বাড়লেও একজনেরও নাম খোদাই করা নেই তাতে।  গোপন ক্যামেরা দিয়ে সর্বক্ষন নজরদারী চললেও হেলায় পড়ে রয়েছে কামানের অংশ বিশেষ। কামানগুলি আজ বাতিস্তম্ভ বা কোথাও লম্বা করে মাটিতে পুতে রাখা হয়েছে। জানা যায় এই কামানের মধ্যে লোহার গোলা ঢুকিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার লর্ড ওয়েলেসলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন টিপু সুলতান।

বর্তমানে মসজিদটিকে সুসসজ্জিত করে ধর্মের কাজ নিয়ম অনুযায়ী হতে থাকলেও ইতিহাস কিন্তু অজ্ঞাত কারণেই অধরাই হয়ে থাকবে ধুলো পড়া বইয়ের মতোই । ঐতিহাসিক গুরুত্ব যত ক্ষয় হতে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তত অস্বচ্ছ হবে।

 কলকাতায় দুটি টিপু সুলতান শাহী মসজিদই ইতিহাসের পাতায় একটি বড়ো নিদর্শন কিন্তু তা এখন শুধুমাত্র নামেই বিদ্যমান হয়ে থাকবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2