• NEWS PORTAL

  • সোমবার, ২০ জানুয়ারি ২০২৫

ঢাকায় সাইক্লিংয়ের সংকট: শিশুরা কী হারাচ্ছে মুক্ত আকাশ?

শতরুপা দে

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ১০ জানুয়ারি ২০২৫

ফন্ট সাইজ
ঢাকায় সাইক্লিংয়ের সংকট: শিশুরা কী হারাচ্ছে মুক্ত আকাশ?

ছবি: সংগৃহীত

ঘড়ির কাটায় তখন বিকাল চারটা। নতুন কেনা সাইকেলটা নিয়ে মায়ের সাথে রমনা পার্কে এসেছে কাব্য। খোলা প্রান্তরে কখন নতুন কেনা সাইকেলটা চড়বে তর সইছে না তার। তবে  শান্তিনগরের বাসিন্দা শাহানা ইসলামকে রমনা পার্কের গেইটের কাছে এসে থামতে হলো। নিরাপত্তা রক্ষী জানালেন পার্কে সাইকেল নিয়ে ঢোকার অনুমতি নেই। নতুন সাইকেল চালানোর সুযোগ না পেয়ে মায়ের সাথে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেল কাব্য। সন্তানের জন্য এই খুশিটুকুর ব্যবস্থা না করতে পেরে কাব্য’র মা বলেন, আমাদের বাসার আশেপাশে কোন খোলা মাঠ নেই। আমার ছেলের মত ঢাকার বেশিরভাগ বাচ্চারই খেলার মাঠ নেই, সাইকেল চালানোর জন্য জায়গা নেই। একটা শহরে বাচ্চদের জন্য ভাববে এমন কি কেউ নেই? 

কেবল শাহানা নয় ঢাকায় বেড়ে উঠছে এমন হাজারো শিশুর অভিভাবকের এই একই প্রশ্ন। কেবল শিশুরা নয় ঢাকা বড়দের জন্যও সাইকেলিং বান্ধব শহর নয়। কেবল রমনা পার্কই নয়, বোটানিক্যাল গার্ডেন, চন্দ্রিমা উদ্যানসহ বিভিন্ন বড় পার্কের গেট থেকে শিশু, তরুণ-তরুণী এবং সাধারণ মানুষকে সাইকেল নিয়ে ফেরত যেতে হয়। পার্কে সাইকেল চালানোর অনুমতি নেই। 

পার্ক কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায় সাইক্লিং পার্কে হাঁটাচলার ব্যাঘাত ঘটায়। পার্কে যারা হাটতে আসেন তাদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।  

তথ্য পযালোচনা করে দেখা যায় বিশ্বের অনেক বড় শহর যেমন নিউইয়র্ক, লন্ডন, টোকিও পার্কগুলোতে সাইক্লিংয়ের জন্য আলাদা লেন তৈরি করেছে। ফলে পার্কের অন্য দর্শনার্থীদের কোন ব্যাঘাত  না ঘটিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে সাইকেল চালানোও চলে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাইকেল চলালে ব্যায়াম হয়। এটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, এবং স্থূলতার ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশেও সাইক্লিং অতুলনীয় ভূমিকা পালন করে। বিবিসির তথ্য মতে,  এডিনবরা ও গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, সাইকেল ব্যবহারের মাধ্যমে হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি যথাক্রমে ৪৬% ও ৪৫% কমানো সম্ভব।

বিশ্বের কিছু দেশ সাইক্লিংকে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে। বিশেষ করে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে প্রায় ৩৬% যাতায়াত সাইকেলে সম্পন্ন হয়, এবং তারা এই হার ৫০% পর্যন্ত বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এমনকি তুষারপাতের সময়েও সাইকেল ব্যবহারকারীদের ৭০% সাইকেলেই যাতায়াত করেন। সাইকেল ব্যবহারের এই প্রবণতা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, শহরকে আরও বাসযোগ্য করা এবং প্রাইভেট কারের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে।এছাড়া, নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরও সাইকেল-বান্ধব অবকাঠামো ও সংস্কৃতির জন্য পরিচিত। সেখানে সাইকেল চালানো শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। 

সাইকেলে যাতায়াতের একটি পরিবেশবান্ধব মাধ্যম হলেও ঢাকায় সাইকেলের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা নেই। সরু রাস্তা, অপরিকল্পিত যানবাহন চলাচল, এবং দখল হওয়া ফুটপাত সাইক্লিস্টদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সাইকেল চালাতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হন সাইক্লিস্টরা। গত কয়েক বছরে সাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। 

২০২০ সালের আগষ্ট মাসে, রাজধানীর সংসদভবন এলাকার লেক রোডে সাইকেল চালানোর সময় গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন পর্বতারোহী রেশমা রত্না। এঘটনার পর পবাসহ দেশের অনেক সংগঠনই রাস্তায় সাইকেলের আলাদা লেনের জন্য আন্দোলন করলেও এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি।এ ব্যাপারে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে সাইক্লিস্ট শেখ ফাতিমা পাপিয়া বলেন, শহরের রাস্তায় সাইক্লিংয়ের সুযোগের অভাব এবং খোলা জায়গায় নিষেধাজ্ঞা সাইক্লিস্টদের জন্য বড় একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ফলে অনেক সাইক্লিস্টদের হতাশা বাড়ছে। তিনি আরও যোগ করেন, অথচ উন্মুক্ত উদ্যানগুলো সাইক্লিংয়ের জন্য একটি নিরাপদ বিকল্প হতে পারত। এখানে সাইক্লিং নিষিদ্ধ না করে বিশেষ নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সকালে বা বিকেলে নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টা কেবল সাইক্লিস্টদের জন্য বরাদ্দ করা যেতে পারে। এতে পথচারীদের হাঁটায় ব্যাঘাত ঘটবে না এবং সাইক্লিস্টরাও নিরাপদে চর্চা করতে পারবেন। এছাড়া, ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে সাইকেল লেন তৈরি করা উচিত, যেখানে সাইক্লিস্টরা নিরাপদে চলাচল করতে পারবেন।

সাইক্লিস্ট সাফকাত ফারুক বলেন, দেশের বিভিন্ন সাইক্লিং কমিউনিটি যেমন বিডিসাইক্লিস্টস, হেমন্ত রাইডার্স, সাউথ ঢাকা সাইক্লিস্টস, মিরপুর সাইক্লিস্টস, একুশে রাইডার্স ; ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলার যেমন চট্টগ্রামে দ্বিচক্রযান, এফএনএফ রাইডার্স, সিলেটে সিলেট সাইক্লিং কমিউনিটি, খুলনায় খুলনা সাইক্লিস্টস ইত্যাদি কমিউনিটির সাহায্যে জনসচেতনতা বাড়াতে স্কুল, কলেজ, এবং কর্মক্ষেত্রে সাইক্লিং ক্যাম্পেইন আয়োজন করা যায়। এবং পরিবেশ সুরক্ষার অংশ হিসেবে সরকারও সাইক্লিংকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন সুবিধা দিতে পারে।

ঢাকা শহর, কর্মব্যস্ত নাগরিক জীবনের প্রাণকেন্দ্র, যেখানে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মেটাতে পথে বের হয়। এমন শহরে সাইক্লিং শুধু শরীরচর্চার উপায় নয়, বরং পরিবেশবান্ধব, সময়সাশ্রয়ী এবং স্বাস্থ্যকর একটি যাতায়াত মাধ্যম। এটি নাগরিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং সবার সহযোগিতা। 

ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের মতে, সাইকেল ব্যবহারের মাধ্যমে যানজট, দূষণ ও যাতায়াত খরচ হ্রাস করা সম্ভব, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইসাইকেল ব্যবহারের প্রচলন এই লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। 

শাহানা ইসলাম বলেন, সারা শহরে আলাদা সাইকেল লেন এর বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু পার্কের নির্দিষ্ট স্থানে সাইকেল চালানোর সুযোগ তৈরি, বা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে সাইকেলে এর জন্য সুযোগ দেয়ার মত পদক্ষেপ কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলেই সম্ভব মনে করেন তিনি।

বিভি/এআই

মন্তব্য করুন: