• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

চাঁদে জমি কিনছেন, কী বলছে আন্তর্জাতিক আইন? (ভিডিও)

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ৯ অক্টোবর ২০২১

আপডেট: ১৮:৪৪, ১০ অক্টোবর ২০২১

ফন্ট সাইজ

ঘটনার সূত্রপাত চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে। মঙ্গলগ্রহে জমি কিনলেন ‘বাংলাদেশি প্রকৌশলী/মঙ্গলগ্রহে জমি কেনার দাবি বাংলাদেশি প্রকৌশলীর’ ইত্যাদি শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। বিষয়টি খুব একটা আলোচিত না হলেও, অতি সম্প্রতি সাতক্ষীরার দুই যুবক এই আলোচনার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন।

সপ্তাহ না পেরুতেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিরোনাম- চাঁদে জমি কিনলেন সাতক্ষীরার দুই তরুণ/ চাঁদে জমি কিনলেন বাংলাদেশি দুই তরুণ ইত্যাদি। এস এম শাহিন আলম এবং শেখ শাকিল হোসেন নামে সাতক্ষীরার দুই যুবক দাবি করেন, মার্কিন নাগরিক ডেনিস হোপের ‘লুনার অ্যাম্বাসি’ থেকে মাত্র ৫৫ ডলার দিয়ে তাঁরা চাঁদে এক একর জায়গা কিনেছেন। পেয়েছেন দলিল ও প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণ। 

সিলেটের সুজন, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার অখিল রায়, অনুপমা হলাদার এবং নাট্যকার-পরিচালক হিমু আকরাম-এর নামও একের পর এক যুক্ত হতে থাকে চাঁদে জমি কেনার কাতারে। খুলনার এমডি অসীম বিবাহবার্ষিকীতে স্ত্রীকে চাঁদের জমি উপহার দিয়ে চাঁদে জমি কেনার ধারাবাহিক আলোচনার পারদ আরেকটু ঊর্ধ্বমুখী করেন।

২৯ সেপ্টেম্বর ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন ‘চাঁদে ১০ একর জমি কিনেছি, ছবিও আছে, দাবি করলেন বাংলাদেশের দম্পতি’ শিরোনামে ফলাও করে সংবাদ প্রচার করে। এই প্রতিবেদনে, বাংলাদেশের এমডি অসীম এবং তাঁর স্ত্রী টুম্পা, সাতক্ষীরার এস এম শাহিন আলম এবং শেখ শাকিল হোসেন-এর চাঁদে জমি কেনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।  প্রতিবেদনে চাঁদে জমি কেনার পদ্ধতি, মূল্য বা সত্যিই চাঁদে জমি কেনা আইনসিদ্ধ কি না এসব বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।

গুগল-এ অনুসন্ধান করে চাঁদে জমি কেনা সংক্রান্ত কয়েকটি কোম্পানির নাম পাওয়া গেলো। লুনার অ্যাম্বাসি, লুনার রেজিস্ট্রি লুনার ল্যান্ড.কম, লুনার ল্যান্ড ওনার, মুন রেজিস্টার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিশ্বব্যাপী মূলতঃ এসব সাইট ব্যবহার করে চাঁদের জমি বিক্রি করা হয়।

২১ জানুয়ারি ২০২১ এ প্রকাশিত বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ১৯৬৭ সালের ২৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মহাকাশ আইনের ভিত্তিতে ‘Outer Space Treaty’ নামে একটি চুক্তি সম্পাদন করে, যেখানে ১১১টি দেশ স্বাক্ষর করে। এই আইন অনুযায়ী, পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে, চাঁদ এবং অন্য বস্তুকে আন্তর্জাতিক একক অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির প্রদেশ ‘Province of all mankind’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলো কোনো দেশ দখল বা নিজের একক সম্পত্তি হিসেবে দাবি করতে পারবে না। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি মালিকানার প্রসঙ্গটি সেখানে অনুল্লিখিত ছিলো। মূলতঃ এটাকে পুঁজি করেই পুঁজিপতি, লুনার অ্যাম্বাসি’র প্রতিষ্ঠাতা ডেনিস হোপ প্রায় ষাট লাখ মানুষের কাছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ জমি বিক্রি করেছেন। 

১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ নতুন সমঝোতা প্রস্তাব আনে, যা ‘মুন অ্যাগ্রিমেন্ট’ নামে পরিচিত। সেখানে বলা হয়, ‘পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ এবং এর প্রাকৃতিক সম্পদের সাধারণ উত্তরাধিকার সমগ্র মানবজাতি’ এবং কারো দ্বারা সম্পদের অপব্যবহার হলে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তা প্রতিহত করা হবে। তবে এই পর্যন্ত মাত্র ১৮টি দেশ এর অনুমোদন দিয়েছে। 
  
২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ‘কমার্শিয়াল স্পেস লঞ্চ কমপিটিটিভনেস অ্যাক্ট’ পাস করে। এই আইন স্পষ্টত শুধু মার্কিন নাগরিকদের মহাকাশ সম্পদের মালিকানা নেওয়ার অনুমতি দেয়। অর্থাৎ, পানি ও অন্য খনিজ সম্পদের বাণিজ্যিক অনুসন্ধান এবং সম্পদ ব্যবহার বৈধ করে।

এসব আইন থেকে দু’টি প্রশ্ন জাগে। এক, ১৯৬৭ সালের আইনে যেহেতু প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি চাঁদে জমি বিক্রি করতে পারবে না, এমন কথার উল্লেখ নেই, সেহেতু ডেনিস হোপ চাঁদের জমি বিক্রি করতে পারেন। দুই, ডেনিস হোপ একা কেন, পৃথিবীর যে কোনো ব্যক্তিই চাঁদ বা অন্য গ্রহের জমি বিক্রি করতে পারেন। তিনি একা নতুন কোন্ আইনে মঙ্গল বা চাঁদের জায়গা নিজের মনে করে বিক্রি করছেন?

১৯৬৭ সালের আইনে যদিও কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির উল্লেখ নেই, তবু ডেনিস হোপ মঙ্গল বা চাঁদের মালিকানা দাবি করতে পারেন না। সেই আইনে চাঁদ এবং অন্য বস্তুকে আন্তর্জাতিক একক অর্থাৎ, সমগ্র মানবজাতির প্রদেশ ‘Province of all mankind’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মানে চাঁদ সমগ্র পৃথিবীবাসীর সম্পদ, কারো একার নয়।

যদি তাই হয়, তাহলে ডেনিস হোপ কীভাবে একা বিক্রি করছেন? চতুর ডেনিস হোপ, আইনি জটিলতা এড়াতে ২০০৪ সালে নিজেই ছায়াপথ-সম্বন্ধীয় সরকার (Galactic Government) প্রতিষ্ঠা করেন। যার রয়েছে নিজস্ব সংবিধান, সভা ও মুদ্রা। স্বনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হোপ-এর দাবি, এ সরকারের জাতিসংঘের আইন মানা বাধ্যতামূলক নয়, কারণ এটি তার সদস্য নয়। মূলতঃ এই দাবিতেই হোপ মঙ্গল বা চাঁদের জমি চতুরতার সংগে বিক্রি করছেন। 

এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন, মহাকাশের এমন বস্তুর ভূমি বিক্রয়ে অসমর্থন প্রকাশ করে বলেছে, এ ধরনের কার্যক্রম অলীক এবং এতে কোনো কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি নেই। 

‘গ্লোবাল স্পেস ল সেন্টারের’ পরিচালক ড. মার্ক সুন্দহল বলেন, আন্তর্জাতিক আইন মহাকাশে ব্যক্তিগত ভূমির মালিকানার অনুমতি দেয় না।

আইন এবং তথ্য বলছে, মঙ্গল বা চাঁদের জমি বিক্রির বৈধতা কারো নেই। তাহলে কোম্পানিগুলো কিসের ভিত্তিতে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে? এসব বিষয় জানতে কোম্পানিগুলোর সংগে যোগাযোগ করে বাংলাভিশন ডিজিটাল।

বলা হয়ে থাকে, চাঁদে জমি বিক্রির ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ডেনিস হোপ-এর লুনার অ্যাম্বাসি। সেই কোম্পানিকে পাঠানো হলো সাতক্ষীরার শাহিন এবং শাকিল-এর জমি কেনার কাগজপত্র। 

কোম্পানিটি সাফ জানালো, কাগজপত্র সঠিক নয়, তারা জমি কিনেছেন লুনার রেজিস্ট্রি থেকে। লুনার রেজিস্ট্রি জমি বিক্রির সঠিক কোম্পানি নয়। তারা কপিক্যাট। লুনার অ্যাম্বাসি’র দাবি তারা একমাত্র বৈধ কোম্পানি। 
 
উল্লেখ্য, লুনার অ্যাম্বাসি’র ওয়েবসাইট ভিজিট করে দেখা যায়, তারা লুনার রেজিস্ট্রি, লুনার ল্যান্ড.কম, লুনার ল্যান্ড ওনার, মুন রেজিস্টার ইত্যাদি কোম্পানিকে কপিক্যাট বলে উল্লেখ করে এসব প্রতারক কোম্পানি থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
 
এবার নজর দেওয়া যাক, লুনার রেজিস্ট্রি কোম্পানির দিকে। সাতক্ষীরার শাহিন ও শাকিল-এর কাগজপত্রকে সঠিক বলে জানায় কোম্পানিটি। তবে, চোখ ছানাবড়া হওয়ার মতো অবস্থা হলো তখন, যখন কোম্পানিটি জানালো, শুধু সেপ্টেম্বরেই বাংলাদেশের ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা থেকে নাকি বিশ্বব্যাপী অর্ডারের পনের শতাংশ অর্ডার করা হয়েছে।

এই কোম্পানিটিও চাঁদের জমি বিক্রির ক্ষেত্রে নিজেদেরই একমাত্র বৈধ কোম্পানি বলে দাবি করছে। প্রশ্নোত্তরের একপর্যায়ে কোম্পানিটি বাংলাভিশন ডিজিটালের প্রতিবেদকের পরিচয় নিশ্চিত হতে খোঁজ নিতে শুরু করে। 

এ বিষয়ে আর্ন্তজাতিক মানের ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান ‘ফ্যাক্ট ওয়াচ’ বলছে, ‘আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, বাকি বহিঃজাগতিক আবাসন প্রকল্পের ওয়েবসাইটগুলো অভিন্ন অথবা সহজ ভাষায়, প্রতারণা-চক্র। প্রকৃতপক্ষে, এই পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে, চাঁদ এবং অন্য গ্রহের আইনত মালিক নয়। ডেনিস হোপসহ অনেকেই এমন আইনি ছাইপাশ দেখিয়ে মহাকাশের কিছু অংশে ভূমির মালিকানা দাবি করে। সন্দেহ নেই, এসব দাবির কোনোটিরই বৈধ অবস্থান এমনকি আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি নেই। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ চুক্তির কল্যাণে মহাকাশে বিভিন্ন বস্তুর সার্বভৌমত্ব সংরক্ষিত করা হয়েছে, ফলে কোনো রাষ্ট্রের আদালত এমন দাবিকে বৈধতা দিতে পারে না।’

তাহলে শেষ কথা কী দাঁড়ালো? জাতিসংঘের ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ চুক্তি অনুযায়ী, চাঁদে কেউ জমি কিনতে পারে না। তবে কিছু দেশের নাগরিক আইন বা চুক্তির ফাঁকফোকর বের করে চাঁদ এবং অন্য গ্রহ–উপগ্রহে জমি বিক্রির নাম করে পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। যারা কিনছেন, তাঁরা আসলে জমি কিনছেন নাকি প্যাকেটভর্তি বাতাস কিনছেন, সিদ্ধান্ত আপনার?

বিভি/এসআই/এসডি

মন্তব্য করুন: