ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে বেসিস নির্বাচন
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)। বাংলাদেশের সফটওয়্যার অ্যান্ড আইটি শিল্পের জাতীয় বাণিজ্য সংস্থা। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা দেশে গতিশীল সফটওয়্যার ও আইটি পরিষেবা শিল্প এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের সংগে একযোগে কাজ করে চলেছে।
সম্প্রতি বেসিস-এর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। তফসিল অনুযায়ী, ১১ ডিসেম্বর নমিনেশন প্রত্যাহার এবং ২৬ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন ধার্য করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন ঘিরে শুরু হয়েছে নানান বিতর্ক। সময়মতো নির্বাচন না করা, ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তিতে গড়িমসি, কাগজপত্র হালনাগাদে কম সময় প্রদানসহ নানান বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বেসিস-এর অনেক সদস্য।
বেসিস সদস্য মো. আমিন উল্লাহ (ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এলিয়েন টেকনোলজি লি.) গত ৫ ডিসেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিটিও (ডিরেক্টর অব ট্রেড অর্গানাইজেশন) শাখায় একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে জানা যায়, বেসিস-এর বর্তমান মেয়াদোত্তীর্ণ নির্বাহী কমিটি তাদের মেয়াদ ২০১৮ থেকে ২০১৯-এর ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার পরও বিধি লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় বহাল আছে। অর্থাৎ দু’বছর মেয়াদের কমিটি চার বছর ধরে ক্ষমতায়। আমিন উল্লাহ’র মতে, এটি সংগঠনের আর্টিকেল ধারা- ১৪.৮, ১৪.৯,১৪.১০, ১৪.১১-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, যথাসময়ে নির্বাচন না দিয়ে তড়িঘড়ি করে মাত্র ৭০/৮০ জন সদস্যের উপস্থিতিতে একই দিনে এজিএম এবং ইজিএম করে আর্টিকেল সংশোধন করা হয়েছে। ১৭০০’র বেশি সদস্যের সংগঠনে মাত্র ৭০/৮০ সদস্য নিয়ে সঙ্ঘবিধির মতো স্পর্শকাতর ইস্যু পরিবর্তন সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই সম্পর্কে বাণিজ্য সংগঠন অধ্যাদেশ-১৯৬১-তেও স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
মো. আমিন উল্লাহ চিঠিতে লেখেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ইসি কমিটি ডিটিওতে বারবার চিঠি দিয়ে করোনা’র অজুহাতে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করেছে। গত ০৬ এপ্রিলের এক চিঠিতে ডিটিও (ডিরেক্টর অব ট্রেড অর্গানাইজেশন) সব বাণিজ্য সংগঠনের নির্বাচন স্থগিতের আদেশ দেয়। আমি এই চিঠি চ্যালেঞ্জ করে এডহক কমিটির অধীনে নির্বাচনের জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করি। হাইকোর্ট ডিভিশন গত ০৪ মে “নির্বাচন স্থগিত করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না” মর্মে দুই সপ্তাহের জন্য রুলনিশি জারি করেন। কিন্তু সেই রুলের জবাব দেয়নি মেয়াদোত্তীর্ণ ইসি কমিটি। এরপর হাইকোর্ট গত ১১ আগস্ট চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ রায় দেন। এতে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের রায় দিয়ে মামলাটি নিষ্পত্তি করেন। তবু মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ না করে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনে হাইকোর্টের রায় স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করে। অ্যাপিলেট ডিভিশনের চেম্বার জজ আরো দু’মাস সময় বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রায় প্রদান করেন। তা সত্ত্বেও অহেতুক সময়ক্ষেপণ করে অ্যাপিলেট ডিভিশনের রায় ঘোষণার ১৮ দিন পর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে, যাতে অনেক সদস্য ভোটার হতে না পারেন।
এসব বিষয়ে বেসিস-এর অনেক সদস্যের মধ্যেও চাপা ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। বেসিস সদস্য জুবায়ের কবির (সিইও অ্যান্ড ডিরেক্টর, ৮৮ ইনোভেশন ইঞ্জিনিয়ারিং লি.) বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, নির্বাচনের জন্য আমরা চার বছর ধরে অপেক্ষা করছিলাম। বর্তমান কমিটি নির্বাচন নিয়ে আদালতের নির্দেশনার বিষয়টি অনেক সদস্যের কাছে গোপন করেছে। এছাড়া আদালতের নির্দেশনার ১৮ দিন পর তফসিল ঘোষণা করে এবং মেম্বারশিপ হালনাগাদ করতে মাত্র তিন-চার দিন সময় বেঁধে দেয়, যার মধ্যে সরকারি ছুটি দু’দিন। ফলে অনেক সদস্যই কাগজপত্র হালনাগাদ করতে না পারায় তাঁদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ডিটিও লেটার প্রসংগে তিনি বলেন, কোভিডের কারণে বেসিসের নির্বাচন দু’বছর পেছানো হলো, অথচ এই সময়ে এফবিসিসিআই এবং বিজিএমইএ নির্বাচন কীভাবে হলো? তিনি নির্বাচন নিয়ে বর্তমান কমিটির সদিচ্ছার ঘাটতির প্রশ্নও তোলেন।
বেসিস সদস্য মো. হাবিব উল্লাহ তুহিন (ব্যবস্থাপনা পরিচালক, নাইস পাওয়ার অ্যান্ড আইটি সল্যুশন) বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, আমি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছিলাম। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কিছু কারণে আমার মনে হয়েছে, এটি সাজানো নির্বাচন। তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছি। তিনি বলেন, বেসিস সদস্যরা সবসময়ই একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন চান। কিন্তু ঘোষিত নির্বাচন শিডিউলে একজন সদস্যের পক্ষে বার্ষিক চাঁদা, ইনকাম ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র এতো কম সময়ে হালনাগাদ করে সদস্যপদ আপডেট করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এসব কারণেই এবারের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সদস্যরা ক্ষুব্ধ বলে জানান তিনি।
উল্লিখিত অভিযোগসমূহের সত্যতা মেলে বেসিস মেম্বারস প্ল্যাটফর্মে। এই প্ল্যাটফর্মে বেসিসের সব সদস্য যুক্ত আছেন। এখানেই অনেক সদস্য নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁদের ক্ষোভ ঝেড়েছেন। মইন উদ্দিন নামে একজন লিখেছেন, “আর ভোটার হতে পারলাম না। করোনাকালে ঠিকমতো সদস্য ফি পরিশোধ করলাম, ট্যাক্স রিটার্ণ ডকুমেন্টস জমা দিলাম, কিন্তু নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমি চিটাগং সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে শিফট করায় ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে কিছুটা জটিলতা হয়েছে। এজন্য আপীল করলাম। কিন্তু আপীল বাতিল করা হলো। আমার প্রশ্ন, ইলেকশন কমিশন কী কারণে আমার আপীল বাতিল করলো? গত ৫ বছরে বেসিস থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা নিইনি। সদস্য ফি-ই দিয়েছি ৫০,০০০ টাকা। অথচ কমিশন আমাকে ভোটার করলো না।”
মো. কামরুল হাসান ভূঁইয়া নামে একজন লেখেন, “বর্তমান কমিটির প্রত্যেককে শ্রদ্ধার চোখে দেখি, কিন্তু একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, সব যোগ্যতা থাকার পরও অনেকে সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ভোটার হতে পারে নাই, এ ব্যাপারে কি কোনো করণীয় ছিলো না?
রুপম রাজ্জাক নামে এক সদস্য লেখেন, “এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বেসিস মেম্বারশিপ নবায়ন করেছি। কিন্তু ভোটার হতে আবার কাগজপত্র দিতে হবে জেনে খুব বিরক্ত হয়েছি, নতুন করে ভোটার হতে আগ্রহবোধ করিনি। পৃথিবীতে বেসিস-ই মনে হয় একমাত্র সংগঠন, যার মেম্বারশিপ অ্যাক্টিভ রাখতে এবং ভোটার হতে আলাদা আলাদা যোগ্যতা লাগে। এটা খুবই হতাশজনক। এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ আইটি প্রতিষ্ঠানগুলো বেসিস-এর মেম্বার হতে বা মেম্বারশিপ টিকিয়ে রাখতে আগ্রহ হারাবে। আশা করি, আগামীতে নতুন নেতৃত্ব বিষয়গুলোতে নজর দেবে।
মো. শাহজালাল লেখেন, “বেসিসের আর্টিকেলে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, নির্বাচন ঘোষণার পর বিদ্যমান ইসি কমিটির কোনো কার্যক্রম থাকে না। তারপরও ৬ বছরের সবচেয়ে অসফল প্রেসিডেন্ট আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড-২০২১-এর ইভেন্টের দাওয়াত দেন কীভাবে?”
জানা গেছে, ৩১ ডিসেম্বর-২০২১-এর মধ্যে বেসিসের নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষের ওপর ১৩ ডিসেম্বর ফুল বেঞ্চ শুনানী হবে। সেদিন নির্বাচনের বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্তও আসতে পারে। এই নিয়ে বর্তমান কমিটির ভাবনা না থাকলেও, দুশ্চিন্তায় রয়েছেন নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্রত্যাশীরা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বাংলাভিশন ডিজিটাল-এর সংগে কথা বলেন বেসিস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আলমাস কবির। তিনি বলেন, কোভিড পরিস্থিতি এবং ডিটিও’র (ডিরেক্টর অব ট্রেড অর্গানাইজেশন) চিঠির কারণে সময়মতো নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। ৩১ অক্টোবর আমরা যে কোর্ট অর্ডার পেয়েছিলাম, সেই সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব না হওয়ায় কোর্টে স্টে-অর্ডারের জন্য আবেদন করা হয়েছিলো। কোর্ট পরে দু’মাস সময় বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের নির্দেশনা প্রদান করেন। আমরা কোর্টের আদেশ অনুযায়ী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছি এবং যথাসময়ে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তা সম্পন্ন করা হবে।
নির্বাচন যথাসময় আয়োজন না করার জবাবে তিনি বলেন, আর্ন্তজাতিক ক্যাটাগরির মেম্বারশিপ নিয়ে চালডালের করা একটি মামলায় সংবিধানে কিছু পরিরর্তন আনা দরকার ছিলো। এজন্য এজিএম করে তা ডিটিওতে পাঠানো, সেখান থেকে আরজেএসসি, আরজেএসসি থেকে আবার ডিটিওতে গিয়ে ফাইনাল হয়েছিলো। পুরো প্রক্রিয়াটি অনেক সময়সাপেক্ষ ছিলো।
রিটকারী মো. আমিন উল্লাহ প্রসংগে তিনি বলেন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে মর্মে তিনিই কোর্টের আদেশ নিয়ে এলেন, আবার তিনিই নির্বাচনের জন্য সময় বাড়াতে কোর্টে আবেদন করলেন। এটা দ্বিচারিতা।
আলমাস কবির বলেন, নির্বাচনের তারিখ পেছালে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। বরং সময় বাড়ানো হলে সবারই সুবিধা। বিশেষ করে ক্যাম্পেইনের জন্য। আগে আমাদের ভোটার সংখ্যা ছিলো ১১০০’র মতো, এখন প্রায় ১৮০০। সুতরাং ক্যাম্পেইনে অনেক সময় লাগবে। তিনি বলেন, আমরাও চাই সময় বাড়ানো হোক।
আলমাস বলেন, ডিটিও থেকে টাইম লিমিট উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি চাইলেই আরো একবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারতাম। আমি সেটা করছি না। কারণ আমি চাই না, কেউ ভাবুক, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনে আমাদের পুরো বোর্ড থেকে মাত্র দু’জন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। আমাদের বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা দোষারোপ করা হচ্ছে। আমরা চাই, দেশের আইটি এবং সফটওয়্যার শিল্পের বাজার আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে দ্রুত প্রসারিত হোক।
১৩ ডিসেম্বরের শুনানীতে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশের অপেক্ষায় এখন সবাই।
বিভি/এসআই/এসডি
মন্তব্য করুন: