• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

আব্বু নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর রাস্তায় সঁপে দিয়েছিলেন: হারিছ চৌধুরীর মেয়ে

প্রকাশিত: ১২:২২, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২

আপডেট: ১৫:০৪, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২

ফন্ট সাইজ
আব্বু নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর রাস্তায় সঁপে দিয়েছিলেন: হারিছ চৌধুরীর মেয়ে

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব মরহুম হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামীরা তানজিন চৌধুরী যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের লিগ্যাল ডিপার্টমেন্টের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন।

হারিস চৌধুরীর জীবনটাই ছিল রহস্যময়। দ্রুত উত্থান আর তার চেয়েও দ্রুততম সময়ে পতনের গল্প, তবে সবচেয়ে রহস্যময় ছিল তার অন্তর্ধান। ২০০৭ সালে হঠাৎ একদিন আত্মগোপনে চলে যান তিনি। পরে প্রায় ১৪ বছর কোনো খোঁজ নেই। তার মৃত্যুর খবরেও যেন তাই রহস্য।

হারিস চৌধুরী ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ব্যারিস্টার সামীরা তানজিন দেশে এলে সংবাদমাধ্যমকে জানান হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর সময় এবং হারিছ চৌধুরীর বিষয়ে।

এখানে সেটি তুলে ধরা হলো:

প্রশ্ন: আপনার আব্বু যে ১৪ বছর নিখোঁজ ছিলেন। কোথায় ছিলেন তা কি আপনি জানতেন? তিনি কি দেশের বাইরে কোথাও ছিলেন?

ব্যারিস্টার সামীরা তানজিন চৌধুরী: আব্বু সত্যিই দেশকে ভালোবাসতেন। তিনি একজন দেশপ্রেমী ছিলেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি দেশ ছেড়ে যেতে চাননি। আমি তাকে দেশ ছাড়ার জন্য বোঝাতে চেষ্টা করে মেসেজ পাঠিয়েছি। আমি জানতাম আব্বু হয়তোবা দেশে কোথাও আছেন। তবে আব্বু কোথায় আছেন তিনি অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না।

তিনি এই দেশকে তার পরিবারের আগে বেছে নিয়েছিলেন। এটা অনেক বড় বলিদান। পনেরটা বছর ধরে যে যুদ্ধ তিনি করেছেন। আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখা, সন্তানদের সঙ্গ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখা তা আসলে পুরোটা দেশের জন্য। এবং নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর রাস্তায় সঁপে দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন: তিনি কি লুকিয়ে ছিলেন?

তানজিন: তিনি তো কোনো ছদ্মবেশে চলতেন না। একেবারে ওভাবেই রাস্তা দিয়ে হাঁটা দিতেন। যে নামটার (পাসপোর্টের) কথা এসেছে সেটা তো কেবল দাফতরিক কাজে। তিনি সেটা ব্যবহারই করেননি। ব্যবহার করে তিনি কিছু করেছেন। সেটার তো কোনো প্রমাণ আমি পাইনি। তিনি তো একেবারে খোলাখুলি চলাফেরা করতেন। তিনি কখনও লুকিয়ে থাকেননি। দেশেই ছিলেন, সবার মাঝখানে ছিলেন। হেঁটে বেড়াতেন রাস্তাঘাটে। নিজে বাজার করতেন।

প্রশ্ন: একজন ইমামের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল…

তানজিন: ইমাম বলতে ওই বিল্ডিংটার ইমাম। ইমামের সঙ্গে আব্বার খুব খাতির ছিল। যখন তিনি ছুটিতে চলে যেতেন তখন আব্বু ইমামতি করতেন। সবাই খুব ভালোবাসতো।

তিনি যেখানেই যান হারিস চৌধুরী বা মাহমুদুর রহমান কোনো ব্যাপার না। তিনি একজন উজ্জ্বল মানুষ এবং তাকে সবাই চিনতো। নামটা ব্যাপার ছিল না-মানুষটাকেই তো দেখা যাচ্ছে।

আব্বুর ফ্ল্যাটে মতি আঙ্কেল তদন্তে এসেছেন-আমি তো ওখানে গেলাম প্রথমবারের মতো। ফ্ল্যাটের কলটা ঠিক করা লাগলো। মিস্ত্রি এলেন। এসে শুনলেন যে আব্বু নেই, ওখানে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলেন-এমন অবস্থা। ওখানে তিনি চ্যারিটি করতেন, ওদের খোঁজ নিতে হেঁটে হেঁটে, আশেপাশের বস্তিতে ঘুরে ঘুরে।

ওখানে আমি কিছুদিন ছিলাম। কারণ, আমার আসলে যাওয়ার জায়গা ছিল না। আমি কোথায় যাবো, কী করবো জানতাম না। তাছাড়া আব্বুর যত স্মৃতি ওই বাসাতে ছিল। আব্বুর স্মৃতি আঁকড়ে ওখানে কিছুদিন ছিলাম আমি। আমার হাজব্যান্ড এসে আমাকে নিয়ে যান।

ওখানে আব্বুর জায়নামাজ, আব্বুর তসবিহ, আব্বুর বিছানা, আব্বুর বিছানার চাঁদর, আব্বুর গন্ধ, আব্বুর আতর।

প্রশ্ন: আপনার বাবার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল মৃত্যুর আগে?

তানজিন: আব্বু যখন আমাকে আসতে বললেন, অক্সিজেন মাস্ক পরা, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, আমাকে বললেন ‘চলে আসো।’ আমি বললাম, ‘আব্বু, তুমি আমাকে বলছো?’ সেই প্রথম কথা হলো। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতেন না। তিনি আমাকে বিপদে ফেলতে চাইতেন না। কারণ, সময় খারাপ ছিল। তিনি যখন খুব অসুস্থ তখন তিনি বললেন, ‘চলে আসো।’ এই ডাকের জন্য বসে ছিলাম আমি।

আব্বুর ডায়েরিগুলো আমি খুঁজেছি, এখনও পাইনি। একটা লেখা মতি আঙ্কেলকে পাঠিয়েছি, তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। এছাড়া আব্বুর বালিশের নিচে অনেকগুলো ছবি পেয়েছি। আমার দাদা-দাদির ছবি, আম্মুর ছবি, আমার ছবি, আমার ভাইয়ের ছবি, তার যে ভাই মারা গেছেন তার ছবি। আর দাদার লেখা চিঠিগুলো। এগুলো বিছানায় বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমাতেন।

গুরুজনেরা যেসব চিন্তাভাবনা করছেন সেগুলো আমি নিয়েছি। ভাবছিলাম যে আব্বুর নামে একটা ফাউন্ডেশন, এখন সেটা রেজিস্টার করার কাজ চলছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, আব্বুর যত সামাজিক কর্মকাণ্ড ছিল সেগুলোকে গুছানো, চালিয়ে যাওয়া। সেগুলোকে একটা সিস্টেমের আওতায় আনা। সেই চেষ্টায় আছি। আব্বুর নাম সেগুলোর মাধ্যমে বেঁচে থাকবে।

সেগুলোর কথা আব্বু আমাকে বলে গেছেন। বিশেষ করে এতিমখানাটা তার খুব আদরের ছিল। আমাকে বলতেন, ‘এতিমখানাটার দায়িত্ব তোমার। আমি থাকি আর না থাকি আমার এতিমগুলোকে তুমি দেখবা।’

আমি প্লেনে ওঠার আগেই আব্বুকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। আব্বুর সঙ্গে ফোনে আমার কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। কিন্তু তার অবস্থা হঠাৎ করে খুব খারাপ হয়ে যায়। যেহেতু তার অবস্থা ভঙ্গুর ছিল। তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছিল। তার আগে ক্যান্সার ছিল। পুরোপুরি সুস্থ হয়েছিলেন। তার উচ্চ রক্তচাপ ছিল। আমাদের চিন্তার মধ্যেই ছিল না যে তিনি এতটা অসুস্থ হতে পারেন। কারণ, তিনি বেশ স্ট্রং ছিলেন। তিনি হাঁটাহাঁটি করতেন, বাসায় ট্রেডমিলে ওয়াক করতেন। এভারকেয়ারের চিকিৎসকরা বলেছিলেন, তাকে লাইফ সাপোর্টে না নিলে তিনি বাঁচবেন না। এভারকেয়ার কর্তৃপক্ষ আমার অনুমতি নেওয়ার জন্য কল করেছিল।

প্রশ্ন: এর আগে আপনার সঙ্গে আপনার আব্বুর ১৪ বছরে কখনও কথা হয়নি?

তানজিন: এর আগে আব্বুর সঙ্গে আমার কোনো কথা হতো না। কারণ, তিনি আমাকে কোনো অসুবিধায় ফেলতে চাইতেন না। কথা বলতেন আমার ভাইয়ের সঙ্গে সেদিনই আমাকে কল করে প্রথমবারের মতো বললেন, ‘তুমি চলে আসো’।

প্রশ্ন: আপনার বাবার অসুস্থতার সময় কারা পাশে ছিল?

তানজিন: বাবার পাশে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা কেউ কেউ ছিল যারা সাহস করে এগিয়ে এসেছিলেন।

৩ তারিখ মাগরিবের পর আব্বু মারা যান। ৪ তারিখ আসরের পর তার দাফন হয়। আমরা দেরি করিনি। সারা রাত পুরো পরিবার চেষ্টা করেছে তাকে এখানে আনার জন্য।

আমি তো অন্য কাউকে চিনি না। আমি তো কেবল আমার পরিবারকে চিনি। আমার ফুপু, চাচা কেউ দেশে ছিলেন না। পরিস্থিতিটা ভয়ংকর ছিল। সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেউ ছিল না। এমনটি হবে কেউ ভাবতেও পারেনি। আব্বুর মতো একটা বড় মাপের মানুষ, যিনি ১৫ বছর ধরে কোথাও নেই তার ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা তো কেউ রাজনীতিবিদও না, এসব প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অবস্থা মানসিকভাবেও যে থাকবে-তাও ছিল না। আমরা তবু প্রাণপনে চেষ্টা করেছি। রাজনৈতিকভাবে যাদের হাত ছিল, যারা হয়তো সহযোগিতা করতে পারতেন এমন কেউ নেই যে তাদের নক করা হয়নি।

প্রশ্ন: তিনি আত্মগোপনে ছিলেন কেন? তিনি কি কোনো চাপে ছিলেন?

তানজিন: আমার তো সেটাই ধারণা, হয়তো বা তিনি কোনো রকমের চাপে ছিলেন। আসলে তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমার যেটা মনে হয়েছে আমি বলেছি। হয়তো বা পরিস্থিতির চাপে বা একই কারণে যেটা মতি আঙ্কেল লিখেছেন, ওই সময়ের বাস্তবতাটা খুব কঠিন ছিল। আমার মতো যারা পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে তারাই বাস্তবতাটা বুঝতে পারবে।

প্রশ্ন: এত বড় আয়োজন করছেন…

তানজিন: এটা তো আসলে আয়োজন নয়, এটা দোয়া। যখন মানুষের উৎসাহ দেখলাম, আস্তে আস্তে আয়োজনটা বড় হয়ে গেল। অনুষ্ঠানটা আমার বাবার মানুষেরাই তৈরি করেছিল। তার মানুষ। তার কানাইঘাট-জুড়িগঞ্জের মানুষ।

পরিবারের পক্ষ থেকে একটা দোয়ার আয়োজন করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু আমরা যা করি নিরবে করি। এটার প্রচার স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে গেছে। বিশেষ করে এটা বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। অনেক জায়গায় এসেছে ধুম্রজাল, ধোঁয়াসা, যা মেয়ে হিসেবে আমার কাছে দুঃখজনক। ভেবেছি যে এবার মৃত্যুবার্ষিকীটা হলে ওটাতে সবাইকে আমন্ত্রণ করে যদি কারো ধুম্রজাল, ধোঁয়াসা থেকে থাকে সেটার উত্তর দিয়ে দেবো। আমার চাচা, আমার ফুপি আাছেন তারা দিয়ে দেবেন। তারা ফ্যামিলির পক্ষ থেকে কথা বলার একটা সুযোগ পাবেন।

এলাকার মানুষের দাবি এটা। আমরা এলাকায় আসার পর থেকে দেখছি। আমার চাচা, ফুপুরা দাবিটা ফেস করছেন। আমার দুজন চাচা, একজন ফুপু এখনও বেঁচে আছেন। আমার ফুপু এই উপলক্ষে ইরান থেকে এসেছেন।

প্রশ্ন: তার কি শেষ কোনো ইচ্ছা ছিল?

তানজিন: সম্ভব হলে আমি অবশ্যই চাইবো আব্বু তার বাবা, আমার দাদুর পাশে শায়িত হোক। তার অন্তিম ইচ্ছা ছিল-কানাইঘাটে তার দাফন হবে।

আব্বু শেষের দিকে খুব মিস করতেন দাদা-দাদিকে। সবচেয়ে বেশি মিস করতেন তাদের। তারপর আমার ছেলেকে।

আব্বুর নামটা যেন সবাই মনে রাখে। যাকে সবাই খুব ভালোবাসতেন। যিনি গরিবের পাশে ছিলেন, অনাথদের পাশে ছিলেন, এলাকার শিক্ষা উন্নয়নের জন্য কাজ করে গেছেন। করে যাবেন। আব্বু আছেন, থাকবেন-যতদিন আমি আছি, যতদিন তার উত্তরসূরিরা আছেন, আব্বু থাকবেন।

আব্বুকে সবাই যেরকম ভালোবাসা দিয়েছেন সেজন্য সবাইকে ধন্যবাদ। আব্বুর চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশনটা যেন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি সেজন্য আমার পাশে যেন সবাই থাকেন এবং আব্বুর জন্য সবার কাছে দোয়াপ্রার্থী আমি। আব্বুর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করবেন।

বিভি/এনএ

মন্তব্য করুন: