পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য গিলে খাচ্ছে বালু খেকোরা

চরঘেঁষে বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙনে বিলীন হচ্ছে চর রঞ্জিত খাঁ
পদ্মার বুকে দাঁড়িয়েছে বাঙালির স্বপ্নের সেতু। নদীর বুকচিড়ে ছুটছে ভারীভারি যত যানবাহন। ঘুরছে দেশের উন্নয়নের চাকা।
এই সেতু নির্মাণের আগে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ওই এলাকার ওপর একাধিক প্রতিবেশগত সমীক্ষা করেছিল সরকার। সেই সমীক্ষায় উঠে আসে ওই এলাকার জল ও স্থলে বিচরণ রয়েছে ১১২ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির প্রজাপতি, ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬ প্রজাতির উভচর, ৮৯ প্রজাতির মাছ ও ২৯ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক এবং মৈামাছি-সহ অগনিত প্রজাতির কীটপতংগ ও ৩২১ প্রজাতির গাছ এবং লতা গুল্ম। সেখানে সেতু হলে এসব জীববৈচিত্র্য হারানোর পাশাপাশি ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে পদ্মা নদীসহ সেতু এলাকার প্রতিবেশে। তাই সেই সময় বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন আশপাশের প্রতিবেশ সংরক্ষণে জোরালো ব্যবস্থা নেওয়ার।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মাথায় নিয়ে সেতুর কাজ শুরু থেকে প্রতিনিয়ত ওই অঞ্চলের জীববৈচেত্র্যর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সরকার। এতে সেতু নির্মাণ শুরুর পর থেকে নানান পরিবর্তনও চোখে পড়ে তাদের। নদীর ওই অংশে কমতে দেখা যায় মাছের আনাগোনা, উচ্চ শব্দে দূরে সরে যায় পাখিসহ ওই এলাকায় বিচরণকারী অনেক বন্যপ্রাণী।
আরও পড়ুন: বন্যপ্রাণী বাঁচাতে সোহেলের খাঁচায়বন্দী প্রতিবাদ
সেই বিষয়গুলো বিবেচনা করে পদ্মা নদী ও সেতুর আশাপাশের এলাকার প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য ২০২০ সালে সেতুর আশপাশের ১১৭ দশমিক ৭২ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। যার তিনচতুর্থ অংশ পানি ও বাকিটা স্থল ভাগ। “কোর”এলাকার আয়তন ৮১.১৯ বর্গ কিলোমিটার ও “বাফার”এলাকার আয়তন নির্ধারণ করা জয় ৩৬.৩০ বর্গ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের চৌহদ্দী উত্তরে ভাগ্যকূল, বাঘড়া, মেদিনীমন্ডল, কান্দিপাড়া, মাওয়া, কুমারভোগ ও তেউতিয়া; পূর্বে লৌহজং উপজেলা সদর, পালের চর, নদী ও ঢংগীকান্দি; দক্ষিণে পালের চর, পূর্ব নাওডোবা, নাওডোবা, কাঁঠালবাড়ি, মাতবরের চর ও ঢংগীকান্দি ও পশ্চিমেবান্দরখোলা, আড়িয়াল খাঁ নদীরমুখ, খালপাড় ও নারিকেলবাড়ি পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।
স্থলভাগের বন্যপ্রাণীদের জন্য অভয়ারণ্যের মোট এলাকার চার ভাগের একভাগ অর্থাৎ শুধু সেতুর জাজিরা অংশের চর রঞ্জিত খা, শাহবাজনগর ও কারালির চর এলাকাকে স্থলভাগের বন্যপ্রাণীদের জন্য রাখা হয়। কথা রয়েছে এই চর তিনটিকে ঘিরে হবে ইকো ট্যুরিজমের ব্যবস্থাও। যার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নানান কার্যক্রমও চালিয়ে যাচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রম-এর টিম লিডার ড. শেখ মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ বাংলাভিশনকে বলেন, নদী এলাকাতো আছেই সেতু কর্তৃপক্ষ শাহবাজ নগর, রঞ্জিত খা ও চর কারালির জমিগুলো ডিমার্কেশন করে নিয়েছে। এগুলো এখন সেতু কর্তৃপক্ষের নিজস্ব জমি। এই জমিতে বনায়ন ও বন্যপ্রাণীর আবাসভূমি হিসেবে গড়ে তুলতে নানান কার্যক্রম চলমান আছে। আমরা নিয়মিত সেখানকার প্রতিবেশ পর্যবেক্ষণ করছি। বৃক্ষ রোপনের পরিকল্পনা করেছি। বন্যপ্রাণীদের আবাস উপযোগী কিছু বনায়ন হবে তাছাড়া যেহেতু ইকো ট্যুরিজমের স্থান করার পরিকল্পনা আছে তাই সৌন্দর্যবন্ধনকারী কিছু গাছও লাগানো হবে। এসব কাজ অলরেডি চলমান আছে। যেহেতু সেতুর কাজ শেষ এখন আরও দ্রুত হবে।
যদিও সরকারের এই তৎপরতার মধ্যেই অন্যদিকে চলছে ধংষযজ্ঞ। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ১৩(১), ১৩(২), ২০(২) ও ২০(৩) ধারার ক্ষমতাবলে পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। আইন অনুযায়ী, অভয়ারণ্য এলাকায় নিয়ন্ত্রিত খাকবে সব ধরনের কার্যক্রম। অথচ আইনে নিয়ন্ত্রিত এই অভয়ারণ্য এলাকায় গিয়ে চর ঘেঁষে অবাধে বালু তুলতে দেখা যায়। এই বালু তোলার কারণে ইতোমধ্যেই অভয়ারণ্যের চর শাহবাজপুর ও চর রঞ্জিত খাঁ’র বড় অংশ বিলীন হয়েছে বলেও জানান স্থানীয়রা। আমাদের ক্যামেরায়ও ধরা পড়ে চলমান ভাঙনের দৃশ্য। অপরদিকে অভয়ারণ্যের কারালির চরে গাছ কেটে নিতেও দেখা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই প্রকল্পের প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. মো. লোকমান বলেন, অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের কারণে কিছু চর অলরেডি ভেঙেছে। তবে আশপাশে কিছু চর গড়তেও দেখা যাচ্ছে। এভাবে বালু উত্তোলনের কারণে
এখানকার রেয়ার প্রজাতি রুপ টার্টল ও ব্যংক ময়না হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
আরও পড়ুন: অভিযুক্ত ভিয়েতনামী নারিকেলে অবিশ্বাস্য ফলনের খবর!
একই প্রকল্পের উদ্ভিদবীদ শেখ মিজানুর রহমান বলেন, অভয়ারণ্যকে অভয়ারণ্যের মতো আনটাচ বা নীরব রাখা জরুরি। সেটা এখনো করা যাচ্ছে না নানা কারণে। বালু উত্তোলনের কারণে কিছু এলাকা ভাঙছে তবে কিছু গড়তেও দেখা যাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলন হলে অবশ্যই ক্ষতি হবে। কিন্তু মূল সমস্যা হলো অভয়ারণ্য ঘোষণা হলেও তা বাস্তাবায়ণের কোনো কাঠামো এখনো গড়ে উঠেনি।
টিম লিডার ড. শেখ মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ বলেন, আমরা ইতোমধ্যে একাধিকবার বালু উত্তোলনের বিষয়ে লিখিতভাবে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। যতটুকু জানি এখানে কিছু ড্রেজিং সেতু কর্তৃপক্ষেরই আছে। সেটা নদী শাসনের অংশ। এর বাইরে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমেও কিছু ড্রেজার আসছে। এ বিষয়টা আমরা ইতোমধ্যে জানিয়েছি।
সংরক্ষিত এলাকায় কিভাবে বালু উত্তোলন চলছে জানতে চাইলে বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল ঢাকার বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, অভয়ারণ্য ঘোষণা হলেও এখনও অভয়ারণ্য এলাকাটি আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। ফলে সেখানকার তত্বাবধানে কোনো জনবল কাঠামোও তৈরি করা যায়নি। আমি বিষয়টা আপনার মাধ্যমে জানলাম। আমি খোঁজ নিবো, প্রয়োজনে সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো।
আরও পড়ুন: কচ্ছপের মুখে তুলে আপেল খাইয়ে দিলো শিম্পাঞ্জি (ভিডিও)
বিভি/কেএস
মন্তব্য করুন: