জলাবদ্ধতা প্রকল্পের অগ্রগতি ভাল, ফলাফল নয়
৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরেও যেকারণে ডুবছে চট্টগ্রাম
সংগৃহীত ছবি
ব্রিটিশ সরকার প্রস্তুতকৃত সি এস ম্যাপ অনুসারে চট্টগ্রাম মহানগরীতে খাল
ছিল ১০৪টি। এখন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষ-সিডিএ বলছে ৫৭টি। এই ৫৭ খাল
থেকে এখন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে ৩৬ খাল নিয়ে। আর বাকী
২১টি খালের অস্তিত্ব কোথায় ? যারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন তাদের এসব
খাল খুঁজে বের করার কথা। এখন সিডিএ বলছে, ২১টি খাল চট্টগ্রাম সিটি
কর্পোরেশন-সিসিসি’র অধীন। এই ধরনের কোন প্রকল্প সিসিসি'র অধীনে
নেই। এসব খাল চিহ্নিত করাও নেই। এগুলো নগরবাসী ধীরে ধীরে গিলে ফেলেছে।
জলাবদ্ধতা প্রকল্পের প্রথম থেকে সামালোচনা করেন নগর পরিকল্পনা বিদরা।
কারণ এটি ছিল অসম্পুর্ণ এবং কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ। ত্রুটিমুক্ত করার জন্য
প্রথমে উদ্যেগ ছিল। কিছুটা কাজও করেছিল। পরে তা থেকে সরে আসা হয়। এখন কাজ
যেটুকু এগুচ্ছে সেটি অগ্রগতি ভিত্তিক। কিন্তু ফলাফল ভিত্তিক নয়। অর্থাৎ
প্রগ্রেস ওরিয়েন্টেড, রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড নয়। বিশাল কাজ হয়েছে কিন্তু
ফলোদয় হয়নি। যেমন: সুইচ গেট, যেগুলো শুরু করা হয়েছে সেগুলোর গেট লাগানো
হয়নি। গেট না লাগানোর কারণে পানি প্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। আবার একইভাবে
খালগুলো কাটা হচ্ছে, রেটেইনিং ওয়াল করা হচ্ছে। রেটেইনিং ওয়ালতো আর পানি
ঠেকায় না। খালে মাটি রয়ে যাচ্ছে। পানি চলাচল বন্ধ হচ্ছে। রেটেইনিং ওয়াল
অগ্রগতি কিন্তু খালে মাটির কারণে পানি ধীরে সরছে। পাহাড় কাটার বালি মাটি
আটকানোর জন্য সিল্ক ট্যাপ করে সেটাকে কার্যকর কলার কথা । সেটাকে ইজারা
দিয়ে আটকানো বালি-মাটি ইজারদার সরিয়ে নিবে। বালি-মাটি এসে খালগুলো ভরবে
না। তাও কার্যকর নয়। সেখান থেকেও রেজাল ওরিয়েন্টড কিছু মিলছে না।
একই সময়ে যদি জোয়ার এবং বৃষ্টি সমানতালে আসে তাহলে পানি স্বাভাবিক নিয়মে
উপচাবে। সে জন্য হাইড্রোলিক পাম্প বসানোর কথা। কারণ পানি জমে থাকার মতো
খালি জায়গাও নেই। তাই একই সময়ে জোয়ার এবং বৃষ্টি সামনতালে হলে খাল, নালা-
নর্দমা, রাস্তা-ঘাট সব একাকার হয়ে যায়। পানি তখন উপচাতে থাকে। পাম্প করে
পানি বের করে দেয়ার সুযোগ তৈরী হয়নি।
সবমিলিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের
অগ্রগতি ৭০ ভাগ । কিন্তু কাজ যেটুকু এগুচ্ছে সেটি প্রগ্রেস ওরিয়েন্টেড।
রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড না। কোন কাজটি করলে আমরা উপকার পাবো, সেভাবে কাজ
এগুয়নি মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। যার ফলে প্রতি বর্ষায় বলা হচ্ছে
আগামী বর্ষায় উপকার পাবেন। তারা যেই আশ্বাস দেন জনগণ তা বিশ্বাস করে।
তাদের আশ্বাস আর জনগনের বিশ্বাস একসাথে বর্ষার পানিতে ভেসে যায়।
নিয়ম মোতাবেক জলাবদ্ধতা প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা সিসিসি’র। কিন্তু উপর
মহলে জোর তদবিরের কারণে প্রভাব খাটিয়ে তা নিয়ন্ত্রনে নেয় সিডিএ। অবশ্য
সিডিএ দাবি করছে সিসিসি সক্ষম নয় বিধায় কাজ পেয়েছে সিডিএ। তা বিশ্বাস করে
না সিসিসি। অথচ, বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা, এই প্রকল্পের জন্য
স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ি সরকার। সরকার
সমন্বয়ের কথা বলে, অথচ সমন্বয়হীন কাজ করে। প্রকল্পের জন্য যোগ্য
সিসিসি-কে কাজ না দিয়ে সরকার কাজ দিয়েছে সিডিএকে । আর একইভাবে সরকার
সংশ্লিষ্ট একটি প্রকল্প দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের
অধীন সিডিএ দুটি, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি
প্রকল্প বাস্তাবায়ন করছে। আবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অধীন সিসিসি’র
বারইপাড়া খাল । এই তিন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ সব কর্তা ব্যাক্তিরা থাকেন
ঢাকায়। ঢাকায় উপর লেভেলে সমন্বয় না হলে নীচে সমন্বয় হবে কিভাবে? তাই
নীচের লেভেলের সমন্বয় সভায় চা-নাস্তা খাওয়ার বৈঠক হয়। তাই সমন্বয় হয় না।
কোন ফলোদয়ও হয় না। এর জন্য সরকারের ভ্রান্ত নীতি দায়ী। সবাইকে এক ছাতার
নীচে এনে প্রকল্পের ত্রুটি–বিচ্যূতি খুঁজে বের করা দরকার। ত্রুটি সংশোধন
পূর্বক দ্রুততার সাথে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত। না হলে রেজাল্ট
ওরিয়েন্টেড হবে না। ঠিকাদাররা মুনাফা করবে। জনগণের কাজ যদি না হয়, তারা
বাদ দেয়ার চেষ্টা করবে।
সেবা সংস্থাগুলোর এই সমন্বয়ের অভাবে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও পরিকল্পিত
মহানগরী হিসেবে গড়ে উঠেনি চট্টগ্রাম। তাই বর্ষা এলে মহানগরীর বিভিন্ন
এলাকা তলিয়ে যায় হাঁটু থেকে কোমর পানিতে। জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হয়
নগরবাসীকে। ফি বছর নষ্ট হয় কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এই জলাবদ্ধতা নিরসনে
প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৪টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে
সিডিএ দুটি, সিসিসি একটি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন
করছে।
সিডিএ বলছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খনন ও সম্প্রসারণে সিডিএ’র নেওয়া
প্রকল্পে কাজ শেষ হয়েছে ৭৬ শতাংশের বেশি। এই প্রকল্পে ইতোমধ্যে ব্রীজ,
কালভার্ট, রোড সাইড ড্রেন ও নতুন ড্রেন নির্মানের কাজ শতভাগ শেষ। ৫টি
রেগুলেটরের নির্মানকাজও শেষ। তবে কিছু খালের পাশে প্রতিরক্ষা
দেওয়াল, সিল্ট ট্র্যাপ, খালপাড়ের রাস্তা নির্মানে কিছুটা পিছিয়ে আছে
তাঁরা।
করোনা মহামারী, ভূমি অধিগ্রহন জটিলতা ও অন্যান্য বেশকিছু সংস্থার
সাথে সমন্বয় করতে সময় লেগেছে। তাই নানা প্রতিবন্ধকতায় প্রকল্প শেষ করতে
আরও দুইবছর লাগবে বলেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা। সিডিএর এই প্রকল্পের
বর্তমান প্রাক্কলন ব্যয় ৫ হাজার ৬শ’ ১৬ কোটি টাকা ।
জলাবদ্ধতা নিরসনে এক হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে
জানান প্রকল্প কর্মকর্তা। একই সাথে সিটি করপোরেশনের ব্যয় প্রায় ১ হাজার
৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু বিপুল অর্থ ব্যয়ের সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী ।
পরিকল্পিত নগরী করার জন্য সিডিএ’র একটি মাস্টারপ্ল্যান ছিল। সেই
মাস্টারপ্ল্যানের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৮ সালে। ওই মাস্টারপ্ল্যানের ১০
ভাগও বাস্তবায়ন হয়নি। যে কারণে অপরিকল্পিত নগরায়ন হচ্ছে। দিন দিন খাল ও
ড্রেন’র পরিধি ছোট হয়ে আসছে। কোথাও নাগরিকরা তা আস্ত গিলে খেয়েছে। খাল ও
ড্রেনের জায়গা দখল করে ছোটবড় শত শত স্থাপনা গড়ে তুলেছে দখলদাররা। এদের
উচ্ছেদ করে শাস্তির আওতায় আনা দরকার। প্রভাবশালীদের ভালভাবে চেপে ধরা
দরকার। তাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চাপের কারণে অনেক সময় আইন অচল হয়।
আবার প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সিডিএ- সিসিসি দ্বন্ধ প্রকট। জলাবদ্ধতার
দায় নিতে চান না কেউই। নানা চড়াই উৎরাইয়ের পর আপাতত দুই পক্ষ বাকযুদ্ধে
বিরতি দিয়েছেন। তবে সিসিসি বলছে, চট্টগ্রামে নালা ৯৭২ কিলোমিটার এবং
প্রকল্প যেহেতু সিডিএ বাস্তবায়ন করছে, তাই নালা পরিষ্কারের দায়িত্বও
তাদের। আবার সিডি্এ বলছে, নগরে নালা ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার এবং শুধু নতুন
নালা পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব তাদের, পুরোনোগুলো নয়। সবশেষে বলা যায়,
জলাবদ্ধতা যেনো ললাট লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে নগরবাসীর জন্য। এই অভিশাপ থেকে
মুক্তি চান নগরবাসী। আশা করি দায়িত্বশীলরা তা উপলব্ধি করবেন।
লেখখ: চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন: