ভারত চাঁদে আমরা ফাঁদে

একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের উদ্দীপ্ত করতে 'চন্দ্র বিজয়' খুব কার্যকরী একটা টেকনিক। কিন্তু, চন্দ্র জয়ের কিচ্ছা ঝাপসা করে দেয়া হচ্ছে অতিকথনে। তথ্য আংশিক প্রকাশ, আংশিক আড়ালের একটা বাতিকও রয়েছে। চাঁদে মানুষ পা রেখেছে আরো ৫৪ বছর আগে। চাঁদে যাওয়ার টেকনোলজি এখন ম্যাচিউর্ড স্টেইটে। এতে গোপনীয়তার কিছু নেই। বিশ্বের মাত্র চারটি দেশ থেকে চন্দ্রযান চাঁদের বুকে অবতরণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ান, চীনের পর সর্বশেষ যুক্ত হলো ভারত। চাঁদে যাওয়া যত না টেকনিক্যাল তার থেকে অনেক বেশি ডিপ্লোমেটিক ও পলিটিক্যাল ইস্যু। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ানের মধ্যে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে যে স্পেইস রেইস শুরু হয় তার পেছনে বড় একটা ফ্যাক্টর ছিল ক্যাপিটালিজম এবং সোশ্যালিজমের মধ্যে প্রতিযোগিতা।
ভারতের জন্য 'চন্দ্র বিজয়' অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন, সামর্থ্যের পরিচয়। চীন চাঁদ জয় করেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের চাঁদ জয় না করলে চলে না। ভারত রাষ্ট্রের কালেক্টিভ সাইকি শক্তিশালী করতে এই চন্দ্র বিজয়ের প্রয়োজন ছিল। তাই বলে এ নিয়ে ট্রল করা বেমানান। আবার কিছু কথা আটকিয়ে রাখাও যায় না। কথার পিঠে কথা চলে আসে। একদিকে ভারত চন্দ্রযান পাঠায়, আরেক দিকে গালমন্দ শুনতে হয় আমাদের সামাদ সাহেবকে। সামাদ সাহেব মানে আমাদের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার ডিজি। পড়াশোনায় তিনি কৃষিবিদ। ভারতের চন্দ্রজয়ের ঘটনা না ঘটলে আরো অনেককিছুর মতো তাও অনেকের অজানাই থেকে যেতো। কাকে, কোথায় নিয়োগ দিতে হবে, সেই জ্ঞান সিস্টেমের কর্তাদের না থাকলে এ রকম হতেই থাকবে।
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর এক হাজার বিজ্ঞানী যারা চাঁদে চন্দ্রযান- ৩ নামের একটি মিশনকে আজ সাফল্যমণ্ডিত করে ভারতকে পৃথিবীর এক অসীম উচ্চতায় নিয়েছেন। এই মিশনের সংশ্লিষ্ট ৫৪ জন নারী বিজ্ঞানীও ছিলেন। গোটা মিশনটির পরিচালনা প্রধান একজন নারী বিজ্ঞানী শ্রীমতী ঋতু কারিধাল। ২০১৯ সালেই ভারত চন্দ্রযান -২ চাঁদে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু চন্দ্র পৃষ্ঠের মাত্র দু'শত মিটারের ভেতর গিয়ে শুধুমাত্র সফট ওয়ারের সামান্য ত্রুটির জন্য রোভারটি সফট ল্যাণ্ডিং করতে পারেনি, এজন্য যন্ত্রটি বিধ্বস্ত হয়। তখন ভারত বিরোধীরা এই নিয়ে যথেষ্ট ঠাট্টা তামাশা করেছিলেন। তারা বলেছিল বামুনের আবার চাঁদে যাবার শখ। কিন্তু মাত্র চার বছরের মধ্যেই তারা চন্দ্র পৃষ্ঠে চন্দ্রযান-৩ এর সফল সফট ল্যান্ডিঙয়ের সাফল্য দেখালো।
'চন্দ্রযান-৩ এই সাফল্য সমস্ত মানবজাতির সাফল্য, মানবতার সাফল্য' দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিকস সম্মেলন থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদি এই বার্তাটি পৃথিবীর মানূষকে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মহাকাশ গবেষণার নীতি নির্ধারণকারী নির্বাহী প্রধান তিনি, আর এজন্যই ২০০৭ সালে এই সংস্থা থেকে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর পুরস্কার প্রাপ্ত নারী বিজ্ঞানী ঋতু কারিধালকেই মিশনের দায়িত্ব দিয়ে তিনি ভারতীয় নারীর মুল্যায়ন করেছেন। ভারতের আগেও যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন চাঁদে গেলেও চতুর্থ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের এই সফল মিশন নানা কারনে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। প্রথমত কক্ষপথ থেকে কেন্দ্রাতিক বল বা সুইং প্রযুক্তি ব্যবহারে পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে অজস্র ঘুর্ণনের মাধ্যমে পরিক্রমন করতে করতে দীর্ঘ এক মাস সাত দিনে তারা চাঁদে পৌঁছে গেছে। এতে মাত্র ৬১৫ কোটি টাকা লেগেছে। এত সস্তায় এর আগে কেউই চন্দ্র পৃষ্ঠে যেতে পারেনি। আর এজন্যই নাসা'র প্রশাসনিক প্রধান বিল নেলসন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন ভারতের কাছ থেকে এ বিষয়ে আমাদের শিখতে হবে। দ্বিতীয়ত আজ পর্যন্ত চন্দ্রের দক্ষিণ মেরুতে কেউই ল্যাণ্ডিং করেনি, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে আছে ফ্রোজেন ওয়াটার। এখন যদি চন্দ্রযান-৩ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় এই জল প্রানীর জীবন ধারনে ব্যবহার করা সম্ভব তখন ভবিষ্যতে চাঁদে মানুষ ও অন্যান্য প্রানীকুলের বসবাস বা ভ্রমণের একটি পথ পরিষ্কার হয়ে গেল।
বিরোধীরা ভারতের এই সাফল্যে হিংসায় জ্বলতে পারেন। বলতে পারেন, নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক আধিপত্য দেখানো ছাড়া এতে মানুষের কি লাভ ? লাভের অনেক কিছু আছে। এই গবেষণায় মানব কল্যাণ হবে, ভবিষ্যতে মানুষের বিকল্প বাস্তুসংস্থানের পথ উন্মুক্ত হবে, চাঁদের মুল্যবান খনিজ তেল গ্যাস আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে, চাঁদে বেস স্টেশন স্থাপন করে অল্প খরচে দেশের নিরাপত্তার বিধান হবে, পর্যটনের পথ হবে। ভারতেও ধর্মান্ধতা আছে, তারা কোলকাতা, উত্তর প্রদেশ আজ চন্দ্রযানকে ভগবান জ্ঞানে পূজা করেছে, চন্দ্রযান পাঠানোর আগে চন্দ্রযানের গায়ে জয় শ্রীরাম লিখে পুজা দিয়েছে, তারা কিন্তু এটাও জানেন ভগবান রামের শক্তি নাই চাঁদে চন্দ্রযান পাঠানোর, কেবলমাত্র বিজ্ঞানীদের পক্ষেই তা করা সম্ভব। অর্থাৎ ইসরায়েলের ধর্মপ্রান ইহুদীদের মত তারাও প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রার্থনায় সিনেগগে মন্দির মসজিদে যান তবে ধর্ম ও বিজ্ঞান এক সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেন না। আমরা মিশিয়ে ফেলছি, আমাদের মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে। প্রকৌশল বা মেডিকেলে কৃতিত্বের সাথে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তাররা কূটনীতিক বা পুলিশের চাকরিতে ঢুকলে সেখানে উল্টাপাল্টা হওয়া স্বাভাবিক। কৃষিবিভাগের লোকের মহাকাশে অভিযানে এরই ফরমেট।
বিশাল-বিশাল অংকের দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, লুটতরাজ, ক্ষমতার চৌহদ্দিতে ঢুকে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দাপটে অঘোষিত রাজত্ব কায়েমের পিলে চমকানো সংবাদের সিরিয়ালই আমাদের বিধিলিপি। রাজার চেয়ে প্রজাদের এ সংবাদে বেশি মত্ত রেখে রাজ্য নষ্টের এমন আয়োজন হালে বেশ তেজস্মি। দুনিয়ার দেশে-দেশে যখন করোনা তাড়াতে টিকার পিছনে ছুটে চলার খবর তখন ছোট দেশ বাংলাদেশে নায়িকা, মডেল, পুলিশ, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক মিলিয়ে অবিরাম ফাউল গেম। এদের দিয়ে দিয়ে করোনাকে উধাও করে দেয়ার নোংরা ম্যানেজমেন্ট। এই সুযোগে যে যেদিকে পারছে কুকর্মে জড়াচ্ছে।
মামলা তদন্তের সুযোগ পেয়ে মাঝারি মানের পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েন নিজের বাসায় নিয়ে গেছেন নায়িকা পরীমণিকে। টানা আঠারো ঘন্টা রেখেছেন। নিজেও পরী মনির বাসায় মোজমাস্তিতে নিবিড় তদন্ত চালাতে থাকেন। ঘটনা বেশি প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় তাকে ক্লোজড করা হয়। এর বাইরে ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরের স্ত্রী হেলেনা, মডেল মৌ, পিয়াসা, নায়িকা একা নিয়েও কাণ্ডকীর্তির অন্ত নেই। প্রতিটিতেই সরকারের হাই চ্যানেলে চলা বিভিন্ন পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, রাজনৈতিক নেতাদের সংযোগের খবর। রাতের রানীদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের নাম ফাঁস করে দেয়ার আতঙ্কে ফেলে বড় অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সব খবরও গোপন থাকেনি। জ্ঞান-বিজ্ঞান, আবিস্কার, বিজয় বা সাফল্যগাঁথা সংবাদের বড় খরা আমাদের। তাজা থাকছে পরীমণি, সেফু দা, হেলেনাকাণ্ডের ফলো আপ। এর ফাঁকে দুর্নীতি-লুটপাট চালানো হচ্ছে নিঃশব্দে-আন ডিস্টার্বে। মানুষকে ব্যস্ত রাখা যাচ্ছে চটক নাটকের দর্শক বানিয়ে। আরব্য উপন্যাসের গল্পের মতো একের পর এক দরজা খুলে দিয়ে বিস্ময়ের পর বিস্ময় সাপ্লাইয়ের এ জোয়ারে আমাদের অবিরাম দেখতে হয় অস্বাভাবিক কাণ্ণকীর্তির খবর। নানান ফাঁদে আটকে রেখে আমাদের যেন চাঁদের দিকে চোখ যেতে মানা।
লেখকঃ সম্পাদক বাংলাপোষ্ট
মন্তব্য করুন: