• NEWS PORTAL

  • মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

একটা সাঈদকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই

প্রকাশিত: ১৭:১২, ৫ আগস্ট ২০২৪

আপডেট: ১৭:০৩, ১৬ আগস্ট ২০২৪

ফন্ট সাইজ
একটা সাঈদকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই

কাল্পনিক ঘটনা দিয়ে হয় গল্প, সত্যি ঘটনায় ইতিহাস। গল্প মুহূর্তে মুহূর্তে নানান দিকে মোড় নেয়। অথচ কোটি বছর পার করেও ইতিহাস বদলায় না, তা সূর্যের মতো অবিচল। ২০২৪ সালের ইতিহাসে ‘আবু সাঈদ’ তেমন এক সূর্য, যাকে মনে রাখতে হবে কোটি বছর। কারণ, সাঈদ কোনো গল্প নয়, ইতিহাস।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৬ জুলাই রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় গেটে গুলিতে গুরুতর আহত হন সাঈদ। পরে হাসপাতালে প্রাণ হারান। গোটা পৃথিবী সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে। সেদিন একমাত্র সাঈদকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে বেশ ক’জন পুলিশ । বুলেটে ঝাঝড়া হয়েছে সাঈদের বুক। তবুও পিছপা হননি তিনি। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসেও দেখিয়েছেন অসীম সাহস, বীরত্ব। ইতিহাস বলে, এমন সাহসকে পুঁজি করেই দেশ স্বাধীন হয়েছে।

সেই ৫২’ থেকে শুরু করে ৬৯, ৭১, ৮৭, ৯০ সালের ইতিহাস বাংলার মানুষ জানেন। এই দীর্ঘ পরিক্রমায় অনেক বীরের নাম সোনালী-রূপালি হরফে লেখা রয়েছে। রফিক-সালাম-জব্বার, আসাদ, সাত শ্রেষ্ঠবীর, নূর হোসেন, ডাক্তার মিলন কিংবা শিক্ষক শামসুজ্জোহা; কাউকেই ভোলেনি ইতিহাস। সবাইকে সংরক্ষণ করেছে উপযুক্ত সম্মান দিয়ে। প্রতিটি সংগ্রামে শক্তি জুগিয়েছে তাদের সাহসীকতার সেই অতীত ইতিহাস। ন্যায্যতার দাবি আদায়ে পিছপা হয়নি সকলের স্বার্থে যুদ্ধ করা সেইসব যোদ্ধা। আর তাই প্রয়াত সাহসী নায়কের তালিকায় যুক্ত হয়েছে আবু সাঈদের নাম। হয়তো কোনো একদিন তার নামেও রাস্তা, মোড়, মমি কিংবা কোনো সৌধ তৈরি হবে।

ইতিহাস রচনার দায় কাউকে নিতে হয় না। সাঈদের মৃত্যুর পেছনে কারা জড়িত তা দেখেছে গোটা জাতি, সমগ্র পৃথিবী। এরপরও শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে। হয়তো পক্ষ নেয়া মানুষগুলো সাময়িকভাবে এতে লাভবান হবে। কিন্তু একুশ শতকের এই আমলে সে ভিডিও মুছে ফেলার সুযোগ নেই। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, কিংবা যুগ যুগ ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখলেও সে ভিডিও দূরে রাখার সুযোগ নেই। হয়তো কোনো একদিন সে ভিডিও প্রজেক্টরের বিরাট পর্দায় চালানো হবে, দেখানো হবে সাঈদের বীরত্ব, অসীম সাহসিকতার সেই দৃশ্য।

মৃত্যুর একবেলা আগেও সাঈদকে হয়তো গুটিকয়েক মানুষ চিনতেন। কিন্তু, নিহতের ঘটনার পর কোটি মানুষের মুখে সাঈদের নাম উচ্চারিত হয়েছে, তার বীরত্ব দেখেছে শত কোটি চোখ। সব তথ্য মুছে ফেলা গেলেও মানুষের মগজ থেকে তা দূর করার সুযোগ নেই। বিশেষ শব্দ ব্যবহার করে যাদের গালি দেওয়া হলো, তাদের বাবার রোজগারের ট্যাক্স থেকেই গালিওয়ালাদের বেতন হয়। তারা ভুলে যায় প্রভুর নাম। ক্ষমতায় অন্ধ হয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের গরমে গুলি চালাতে দ্বিধা বোধ করে না প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা। তাদের কে দিয়েছে এমন ক্ষমতা তা প্রকাশ্য তো হয়-ই নি, উল্টো দোষ চাপানো হয়েছে নির্দোষদের ঘারে। মামলার এজাহার পড়ে ঘৃণা বেড়েছে বিবেকের প্রতি। মানুষ কত নিচে নামলে দিনের আলোকে রাত আর রাতকে দিন বলে চালিয়ে নেয়। ক্ষমতার দাপটের কাছে অন্ধ হয়ে যায় রাঘববোয়ালদের বিবেক। তখন, হলফ করেই বোঝা যায়; কে দুর্নীতিবাজ আর কে স্বচ্ছ।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রসমাজ রাস্তায় নেমেছে অনেক আগে। একটা ব্যাপার নিঃসন্দেহে সবাই জানেন, আর যাই হোক না কোন দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি তারা করবে না। অন্যদিকে, তৃতীয় পক্ষকে দোষারোপ করেন দ্বিতীয় পক্ষ, ক্ষমতাধারীরা। একজনের দোষ আরেকজনের ওপর চাপায়।

গুলি, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, হেলমেট বাহিনী, দাঙ্গা লেলিয়ে দিয়ে কারফিউ জারি, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় সাজোয়া যানসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নামানো হয়েছে। রাজধানীসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন। তা প্রতিহত করতেই রাস্তায় নামানো হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অথচ শিক্ষার্থী কিংবা জনতা; সকলকেই আন্দোলনের অধিকার দিয়েছে বাংলাদেশ সংবিধান। 

প্রথম ধাপে সরকার সংশ্লিষ্টরা আদালতের দরজা দেখিয়ে সবাইকে অপেক্ষা করতে বলেন। পরবর্তীকালে আন্দোলনের উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে তারাই আবার রায়ের দিন এগিয়ে আনার চেষ্টা করেন। এরপর রায় ঘোষণার মাধ্যমে ৯৩ শতাংশ সবার জন্য বণ্টন করা হয়। কিন্তু তার আগেই যা ঘটার ঘটে যায়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে অদৃশ্য কোনো পক্ষ। লাশের সারিতে ভারি হয়ে ওঠে বাংলার বাতাস। এক পর্যায়ে অভিভাবক, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পীসমাজ শিক্ষার্থীদের পক্ষে রাস্তায় নামেন। আন্দোলন আরও বেশি দানা বাঁধে।

গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রীয় পক্ষের তথ্যে অমিল থাকলেও ধারণা করাই যায় মৃতের সংখ্যা অনেক। এ তালিকায় শিশু, দিনমজুর, শিক্ষার্থী, শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সাংবাদিকও রয়েছেন। তবে, সব মৃত্যু ছাপিয়ে গেছে সাঈদের আত্মাহুতি। কত কষ্ট করে বাবা-মা সাঈদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় পাঠিয়েছে তা কেবল তারাই জানেন। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে দিন পার করছিল সে পরিবার। অথচ, শত বুলেটের আঘাতে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে সে স্বপ্ন। দগদগে ক্ষত নিয়ে দিন পার করছেন সন্তানহারা মাতা-পিতা, স্বজনেরা। এ তালিকায় আরও শত শত বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বজনেরা রয়েছেন। তারা যুগে যুগে মনে রাখবেন ২৪ সালের জুলাইয়ের ঘটনা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, শক্তিশালী গণমাধ্যম এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্মার্টফোনের কল্যাণে কোনো কিছুই আর লুকিয়ে থাকছে না। সাঈদকে যখন গুলি করা হয় তখন টেলিভিশন চ্যানেল তা সরাসরি সম্প্রচার করেছে। অথচ এরপরও সে দায় নেয়নি রাষ্ট্রযন্ত্র, দোষ চাপিয়েছে আন্দোলনকারীদের ওপর; যাদের কারও হাতে কোনো ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। দেশের বোদ্ধা এবং গুণীজন যারা রয়েছেন তারাই মামলাকারী এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কোন যুক্তি এবং কিসের ভিত্তিতে কার ওপর সাঈদ হত্যার দোষ চাপানো হলো সে প্রশ্ন আজ অমূলক।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরব হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও। ছবি-ভিডিও প্রকাশ করে নিয়মিত সংবাদ প্রচার করেছে বাঘা বাঘা খ্যাতিমান গণমাধ্যমগুলো। সেখানে তো হাত দিতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেন বিভৎস ভিডিও প্রকাশ না পায় সেজন্য বন্ধ করা হয়েছে। এমনকি যে সকল ভিডিও ছড়িয়েছে তারও প্রত্যক্ষ জবাব চাওয়া হয়েছে সামাজিক মাধ্যমের কর্ণধারদের কাছে। কেন সেসব ভিডিও সরানো হয়নি বা হবে না স্বশরীরে তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। যে মাধ্যম দিয়ে গোটা পৃথিবী সংযুক্ত সেখানে শুধু বাংলাদেশে তা বন্ধ রেখে কি ভিডিও প্রকাশ আটকে রাখা সম্ভব? কোনোভাবেই না। এ কথা কি ক্ষমতাসীনরা ভুলে গেছেন? মৃত্যুর জন্য নামমাত্র আক্ষেপ করে অবকাঠামোর ক্ষতি নিয়ে কিসের এতো মাতামাতি। উন্নয়ন জরুরি সাধারণের, অবকাঠামোর নয়। সবাই মৌলিক অধিকারের নিরাপত্তা চায়। বৈষম্য নয়, চায় সমতা।

আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীদের নামে মামলা হয়েছে। রাজধানীতে চিরুনি অভিযান চালিয়ে যাকে সন্দেহ হয়েছে তাকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। নাবালকের রিমান্ড মঞ্জুর করে পূণরায় তা বাতিল করা হয়েছে, পাঠানো হয়েছে সংশোধনাগারে। একতরফাভাবে দোষারোপ করা হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের। বিরোধী, সন্ত্রাসী দলের নাম করে ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা জীবনেও কোনদিন আন্দোলন-মিছিলে যাননি। এরপর কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডেকে নিয়ে উপর্যুপরি হেফাজতে রাখা হয়েছে, জোর করে আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, আধুনিক এই যুগে কেউ আর বোকা সেজে বসে নেই। যে আন্দোলনের সকল নির্দেশনা আসে রাজপথ থেকে সেই আন্দোলন শৃঙ্খলা বাহিনীর ঘরে বসে কি আর বন্ধ করা যায়? উল্টো বিষয়টি যত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা আগুনে ঘি ঢালার মতো হচ্ছে। 

একটা বড় বিষয় লক্ষণীয়। সেটা হচ্ছে ক্ষমতার দাপট। একদিকে রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেদের মনে করছে তারাই সর্বেসর্বা। অন্যদিকে, আইনসভার মান্যজনেরা ভাবছেন তারাই দেশের কাণ্ডারি। গণতান্তিক দেশে আমলারা জনগণের সেবায় নিয়োজিত, রাজনীতিবিদগণ জনগণের প্রতিনিধি। অর্থাৎ, দুই পক্ষই এখানে জনগণের সেবক, জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত। প্রয়াত আব্রাহাম লিংকনও তেমনই বলে গেছেন। কিন্তু, আমাদের রাজনীতিবিদ-আমলাদের শিক্ষা-শিষ্ঠাচার কোথায়? তারা কি ভুলে গেছে করণীয়, তাদের চাকরির উদ্দেশ্য? যার টাকায় কেনা হয়েছে অস্ত্র, গুলি; তাদের সন্তানদের লক্ষ্য করে চালানো হচ্ছে রাবার বুলেট, টিয়ারশেল। এ দৃশ্য জাতি কিভাবে মেনে নেবে? 

মানতে হবে, দেশে উন্নয়ন হয়েছে বহু। কিন্তু, প্রকৃত উন্নয়ন কোথায়? উন্নয়নের এক সংজ্ঞা থেকে জানা যায়, ‘জীবন-মান এবং প্রকৃতির যথাযথ উন্নতিই প্রকৃত উন্নয়ন।’কিন্তু, আমাদের উন্নয়ন কোথায়? বাজার ব্যবস্থার বেহালদশা, শিক্ষাব্যবস্থায় ধোয়াশা, চিকিৎসা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ, বিপুল সম্পদ লুট, অর্থ পাচার ও লোপাট, বৈরি আবহাওয়া, জলবায়ু। এর সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের বিচার নিয়ে কেন তোড়জোড় দেখা যায় না। এখনো যারা অভিযুক্ত কেন তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনের বিধানে তদন্ত এবং বিচার হয় না। সাধারণ মানুষ তো অবকাঠামো পেটে দেয় না, ভোগও করে না ব্যবহার করে। কিন্তু, কল্যাণরাষ্ট্রের জন্য যা মঙ্গলকর তা  নিয়ে তো উচ্চবাচ্য দেখা যায় না। 

এক সংস্কার আন্দোলনের নামে যতগুলো প্রাণ ঝরে গেছে এর দায় নেওয়ার কেউ নেই। তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাজ কী? তারা কেন দায়ভার নেবে না? কার বন্দুকের নলা থেকে গুলি বেড়িয়েছে সে তথ্য কেন লুকিয়ে আছে বা প্রকাশ করা হয়নি?
পরিষ্কারভাবেই একটি কথা বলা যায়, হাজার প্রশ্ন করলে একটির উত্তরও যথাযথভাবে আসবে না। একটা সাঈদ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে সে আর ফিরে আসবে না। যে মায়ের কোল খালি হয়েছে তাও আর পূর্ণ হবে না। অন্যায়কারীর দাপটে বসুধা ভারাকান্ত হলে আজ অথবা কাল এর খেসারত দিতেই হবে, না হলে আন্দোলনের গতি বাড়বে।

ব্যক্তিপর্যায়ে যে যত শক্তিশালীই হোক না কেন দশজনের কাছে তা কোনভাবে সমকক্ষ হতে পারে না। তবে, রাজপথে সকল পক্ষের যে গণদাবি তা বিবেচনায় নিতেই হবে প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধি, সেবক এবং কর্মচারীদের। কারণ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষই সকল ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। প্রয়াত হলেও একটা সাঈদকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই বিবেকবান মানুষের।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)

বিভি/পিএইচ

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2