পরিবারতন্ত্রের ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই
’শেখ হাসিনা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। আমার পরিবার এবং আমি – আমাদের যথেষ্ট হয়েছে।’ এমন প্রতিক্রিয়ার একদিন পরই সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া ‘আওয়ামী লীগ কিন্তু মরে যায়নি। শেখ হাসিনা মরে যাননি, আমরা কোথাও যাইনি।’
একই সময়ে আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের বাংলাদেশকে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার প্রচার। আর তার দলের বার্তা হচ্ছে, শিগগিরই যথাসময়ে দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। এতে উজ্জীবিত বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা। একইভাবে জয়ের দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়ার পর সামনে কখনো না কখনো দিন ফেরার আশা দেখছে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ।
আচানক নয়, এটাই বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের বাস্তবতা। মুখে পরিবারতন্ত্রের নিন্দা করে নানা জ্ঞানগর্ব কথা বললেও অন্তপ্রাণে পরিবারতন্ত্রে কেবল অভ্যস্ত নয় স্বস্তিও। তা শুধু আওয়ামী লীগ-বিএনপি নয়; অন্যান্য বেশ কিছু দলেও। হাল বুঝে বেশিরভাগ নেতা-কর্মী প্রভাব-প্রতিপত্তি, পদ-পদবির লক্ষিন্দর খোঁজেন পরিবারতন্ত্রের মাঝে। প্রাপ্তিতে ব্যর্থ হলে বা পেয়ে হারালে তখন পরিবারতন্ত্রের গালমন্দ-সমালোচনা চলে। আবার পরিবারতন্ত্রের ম্যাজিকে প্রাপ্তি মিললে চুপ মেরে যাওয়া। এভাবেই হয়ে আসছে। গত ক’দিন এ চর্চার আরেক নবায়ন। পরিবারতন্ত্রের মন্ত্রে এক সাবেক মন্ত্রীর ছেলের দেশান্তরি থেকে দেশে ফেরার অপেক্ষায় তার দল। আরেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলেরও সেই একই ভবিষ্যতের অপেক্ষা।
পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দিল্লি চলে যাওয়ার পর বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের নিউজ আওয়ার অনুষ্ঠানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সজীব ওয়াজেদ জয় জানান দেন- তার ও তাদের পরিবার নিয়ে আর ভাবনা নেই। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে নির্বাচিত হয়েছিলেন, আবারও এটা করবেন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, আমার সন্দেহ আছে এ বিষয়ে। সত্তরের ঘরে বয়স তার। তিনি এতোটাই অসন্তুষ্ট যে দেশের উন্নয়নের জন্য এতো কঠোর পরিশ্রম করেছেন যেটাকে সবাই মিরাকল বলে। এরপরও একটা ছোট্ট অংশ তার বিরুদ্ধে গিয়েছে, এমন বিক্ষোভ করলো...। আমি মনে করি তিনি আর এসবে নেই। আমার পরিবার ও আমিও নেই, যথেষ্ট হয়েছে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে জানান, পরিবারের অনুরোধে নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে তার মা দেশ ছেড়েছেন। জয়ের এ বক্তব্য ও মতামত ব্যাপক ভাইরাল হয়। দলের লুকিয়ে থাকা নেতা-কর্মীদের মাঝে বেশ হতাশা তৈরি করে। পরক্ষণেই ‘আমরা মরে যাইনি’ বার্তায় হতাশা কাটানোর চেতনা।
৫ আগস্ট সোমবার পতনের দুদিন পর ৭ আগস্ট বুধবার রাতে সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুকে ভিডিও বার্তায় বলেন, আওয়ামী লীগ হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন গণতান্ত্রিক এবং সবচাইতে বড় দল। আওয়ামী লীগ মরে যায়নি। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। আওয়ামী লীগকে শেষ করা সম্ভব না। ’আমি সজীব ওয়াজেদ জয় বলছি’- দিয়ে শুরু করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলছে। সারাদেশে ভাঙচুর হচ্ছে, লুটপাট হচ্ছে। শহরের বাইরে আমাদের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা চলছে। অনেককে হত্যা করা হয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে জয় বলেন, আপনারা সাহস নিয়ে দাঁড়ান। আপনারা একা না। আমরা আছি। বঙ্গবন্ধুর পরিবার কোথাও যায়নি। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। দেশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের রক্ষা করার জন্য যা প্রয়োজন তা করতে আমরা প্রস্তুত। আওয়ামী লীগ ছাড়া গণতন্ত্র, নির্বাচন সম্ভব না।
আওয়ামী লীগে মন্ত্রের মতো কাজ দেয় জয়ের এ স্ট্যাটাস। একই দিন বিকালে পল্টনে বিএনপির সমাবেশে লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভার্চুয়ালি বক্তব্য- পুলিশ কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর আজ থেকে, এই মুহূর্ত থেকে হামলা কিংবা নৈরাজ্য বন্ধ করুন। এমনকি বিএনপির কেউ দলের নাম ব্যবহার করে কোনো অপকর্ম করতে চাইলে তাকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিন। কোনো পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যথানিয়মে অভিযোগ দায়ের করুন। দেশবাসীর প্রতি আমার বিনীত আহ্বান, কেউ দয়া করে নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না...।
তারেক রহমানের বক্তব্যে বিএনপিতে ব্যাপক সাড়া। সমাবেশে প্রিয় দেশবাসীকে সম্বোধন করেন তিনি বলেন, হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার গৌরবকে কালিমামুক্ত করার ষড়যন্ত্র এরই ভেতরে আবার শুরু হয়ে গিয়েছে। দেশকে গণতন্ত্র উত্তরণের চলমান প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে সারাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রশাসনকে আহ্বান জানান-শক্ত হাতে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করুন। প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। অন্য দলে এবং নানা মহলেও তারেক রহমানের এ বক্তব্য ও আহ্বানের বেশ প্রশংসা। ক’দিন আগেও যারা তার সমালোচনা করেছেন, পরিবারতন্ত্রের সমালোচনা করেছেন তারাও এই কাতারে চলে আসেন। সেইসঙ্গে তারেকের প্রশংসাও। বেশ ম্যাচিউরড হয়েছেন বলে তারেক রহমানের ব্যাপক বন্দনা। দেশের প্রধান দুই দলকেই তৃণমূলে পরিবারতন্ত্র ক্রমে প্রসারিত ও শক্তিশালী হওয়ার বাস্তবতা আমলে রাখতে হচ্ছে। মানুষও তা গিলছে, খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে ঘটনাচক্রে নিন্দা করে মাত্র। পরক্ষণে আবার ঠিক হয়ে যায়। পরিবারতন্ত্রের পেছনেই ছোটে। তা তৃণমূল থেকে একদম কেন্দ্র পর্যন্ত। বড় দুই দলও মাঝেমধ্যে পরস্পরকে পরিবারনির্ভর বলে গাল দেয়। পরে কাঁচের ঘরে বসে ঢিল মারার মতো একদল আরেক দলের পরিবারের সদস্যদের নাম ধরে হিসাব দিতে থাকলে মিটমাট হয়ে যায়। এর ফাঁকে দুই দলেই এমপি বা জনপ্রতিনিধি কারো মৃত্যু হলে কিংবা অবসর নিলে স্ত্রী, পুত্র, ভাই বা আত্মীয়
প্রার্থী হয়ে যাচ্ছেন।
আগে শুধু জাতীয় পর্যায়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পরিবারসহ হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারকেই পরিবারতন্ত্র হিসেবে বোঝানো হতো। এখন এমপি ছাড়াও উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভা, ইউনিয়ন থেকে ঘাটের ইজারা, মসজিদ কমিটি পর্যন্ত তা প্রতিষ্ঠিত। পরিবারতন্ত্র বিস্তৃত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো রাজনৈতিক পরিবারগুলোর সদস্যরা ছোট বেলা থেকেই এক ধরনের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ পেয়ে যায়, ফলে তারা নিজ এলাকাতেই রাজনীতিতে এমনিতেই এগিয়ে থাকে। দলও ভাবছে তার পূর্বপুরুষ যেহেতু অনুগত ছিলো সেও এর বাইরে যাবে না। ডিমান্ড দৃষ্টে সাপ্লাইতে সাধারণ মানুষও আর অমত করছে না। এ ধরনের সব ঘটনা আরোপিত নয়। কারো চাপে –তাপে নয়; কোথাও কোধাও তা একেবারে সমাদরেই নেয়া হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: