সরকার পতনে লুটেরাদের হাত থেকে রক্ষা পেল চট্টগ্রাম বন্দর
দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন চট্টগ্রাম বন্দর। দেশীয় অপারেটরদের প্রচেষ্টায় এক সময়ের অকার্যকর এই বন্দর এখন বিশ্বে ৬৭তম। যখন এই বন্দর ধারাবাহিকভাবে ভাল করছিল, তখন অবিশ্বাস্য লুটপাটের অর্থনীতির কারিগর সালমান এফ রহমানের নজর পড়ে। দেশের আর্থিক খাতের মধু খাওয়া শেষে তিনি ঝুঁকে পড়েন বন্দরের মধু খাওয়ায়। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ডান হাত সালমান এফ রহমান বন্দর গিলে খাওয়ার জন্য নানা রকম ফন্দি আঁটেন। বন্দর নিয়ে তার অভিজ্ঞতা না থাকায় দীর্ঘদিন সুযোগ করতে পারছিলেন না। শেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে ব্যবহার করে এগুতে থাকেন। তার নির্দেশেই বন্দর গিলে খাওয়ার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়।
যারা দেশের লুটপাটের খোঁজ রাখেন, তারা মাত্রই জানেন- চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল আওয়ামীলীগ সরকার। সেই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) বিদেশি কোম্পানিকে দেয়া হয়। দরপত্র ছাড়া এটি হস্তান্তর করতে তৈরি করা হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে পাবলিক- প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) অথরিটি। এর নেপথ্যে ছিল মুদ্রাখেকো থেকে বন্দর খেকোতে পরিণত হওয়া সালমান এফ রহমান। এক্ষেত্রে বন্দর ব্যবহারকারীদের আপত্তিও উপেক্ষা করা হয়।
একই প্রক্রিয়ায় দরপত্র ছাড়া নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল- এনসিটি বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার জন্য সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু দ্রুত ক্ষমতা হারানোর কারণে সে সুযোগ মেলেনি। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর ওই আত্নঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে অন্তর্বর্তী সরকার। মূলত এসব ক্ষেত্রে বিদেশী কোম্পানরি নাম করে স্থানীয় লুটেরা সিন্ডিকেট কাজ করে। টার্মিনাল পরিচালনায় দক্ষতা না থাকায় তারা ভর করে কথিত বিদেশিদের উপর। এখানে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশীয় অপারেটর নিয়োগ দিলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি দেশের সাশ্রয় হবে হাজার কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণ সিসিটি ও এনসিটি। বন্দরের ৫০ ভাগ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয় সিসিটিতে। এখান থেকে বন্দরের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসে। সিসিটি ও এনসিটি-তে ২০০৬ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত জাহাজ নোঙ্গর করেছে ১৩ হাজার ৭৩০টি এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে এক কোটি ৩৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫৮১ বক্স । ২০০৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে রাজস্ব আয় হয়েছে ৯ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এনসিটি চালু হয় ২০০৭ সালে। শুরু থেকেই এই টার্মিনালসহ পুরো অপারেশনাল কাজ পরিচালনা করছে দেশীয় অপারেটর সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড।
এনসিটি’র অপারেশনাল দক্ষতা বিশ্বমানের। ফলে আন্তর্জাতিক শিপিং জার্নাল লয়েড’র জরিপে ধারাবাহিকভাবে এগুচ্ছে বন্দর। ২০০৭ সালে যেখানে জাহাজের গড় অবস্থান ছিল ১০দিন। সেখানে এখন দাঁড়িয়েছে দু’থেকে আড়াই দিনে। ফলে আমদানি-রপ্তানি খরচ কমার সুফল পাচ্ছে দেশ। ২০০৭ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত এনসিটি-তে জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৮হাজার ২৫১টি বক্স।একই কোম্পানি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে ৭৬লাখ ৫হাজার ৪৭১ বক্স। এছাড়া নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল-এনসিটি’তে দক্ষতার সাথে ক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ করা হচ্ছে ২০ শতাংশ। এখানে২০০৭ সালে জাহাজ নোঙ্গর করেছিল মাত্র ৯৭টি এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৬১ হাজার ৩১৫ বক্স। আর ২০২৩ সালে এসে জাহাজ নোঙ্গর করেছে ৮৮২টি এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৭লাখ ৫৪হাজার ৩২৯ বক্স।
২০০৭ সালের আগে বিশ্বের ব্যয়বহুল ও অদক্ষ হিসেবে পরিচিতি ছিল চট্টগ্রাম বন্দর। ঘুষ, দুর্নীতি, রাজনৈতিক মদদপুষ্ট শ্রমিক সংগঠন এবং অদক্ষ অপারেটরের কারণে ক্রমাগত অকার্যকর হয়ে পড়েছিল এই বন্দর। শ্রমিক সংগঠন এবং অপারেটররা অযথা ডেকে বসতো ধর্মঘট। সবাই মিলে নানা হয়রানি ও অনিয়মের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলেন। আমদানিকারকরা সময়মতো পণ্য ডেলিভারি পেত না, স্থানীয় বাজারে বাড়তো ভোগ্যপণ্যের দাম। শিল্পের কাঁচামাল সময়মতো সরবরাহ হতো না কারখানায়। ফলে নিয়মিত ছিল জাহাজজট, কনটেইনারজট, শিপমেন্ট বাতিল, জাহাজের ডেমারেজ সর্বোপরি বর্হিবিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন। কনটেইনার প্রতি খরচ পড়তো আড়াই হাজার টাকা। তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বন্দর নিয়ন্ত্রণ করতেন। শ্রমিকদের মাধ্যমে অরাজকতা তৈরি করে নেত্রীর বাহবা পেতেন। প্রকাশ্যে তার কর্মকান্ডের প্রশংসা করতেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা।
২০০৭ সাল পরবর্তী সময় বন্দর ও ব্যবহারকারীদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে। এক- এগারোর ক্ষমতার পালাবদলে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ ও যৌথবাহিনী। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা চিন্তা করে সংস্কার চালানো হয়। শ্রমিক সংগঠন বিলুপ্ত, স্টিভিডোর প্রথা বন্ধ, জাহাজ ও কনটেইনার জটমুক্ত করে গতিশীল বন্দর গড়ে তোলার জন্য নেয়া হয় নানা পদক্ষেপ। বন্দরের সেবা ছেড়ে দেয়া হয় বেসরকারি খাতে। ব্যবহারকারীসহ সবার মতের প্রেক্ষিতে সিসিটি-কে ইন্ট্রিগ্রেটেড অপারেশনের আওতায় আনা হয়। অপারেটর সাইফ পাওয়ার টেকের জন্য আগের আড়াই হাজার টাকার স্থলে কনটেইনার প্রতি হ্যান্ডলিং ১২শ’ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
দায়িত্ব পাওয়ার পর অপারেটর ইয়ার্ড সিটিএমএস এর আওতায় আনে। কনটেইনার ডেলিভারির ক্ষেত্রে উন্নত পদ্ধতি চালু হওয়ায় ব্যয় কমে আসে। ফলে বৃদ্ধি পায় সেবার মান। যেখানে ২০০৬ সালে সিসিটি-তে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হতো এক লাখ ৩৯হাজার বক্স। জাহাজের গড় অবস্থান সময় ১১ দিন এবং কনটেইনারের গড় অবস্থান ছিল ২৫দিন। রাজস্ব আয় ছিল ১৮ কোটি ৯৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। সেখানে ২০২৩ সালে এসে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩ লাখ ২৪ হাজার বক্স। জাহাজের গড় অবস্থান সময় মাত্র দু’দিন, কনটেইনারের গড় অবস্থান ৬ দিন এবং রাজস্ব আয় হয়েছে ৪৪ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ২০০৭ থেকে ২০২৩ এই ১৭ বছরে শুধু সিসিটি থেকে রাজস্ব এসেছে ৭৬১ কোটি ৯লাখ ৯০হাজার টাকা।
বন্দরের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি এবং বিশ্বে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি স্বত্বেও ব্যাক্তি স্বার্থে সিসিটি ও এনসিটি টার্মিনাল অপারেশন বিদেশি প্রতিষ্ঠান দুবাই পোর্ট ওয়ার্ল্ডকে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে ব্যবহার করেন সালমান এফ রহমান। প্রভাব খাটিয়ে বন্দরের রাজস্ব আয়ের মূল টার্মিনাল এনসিটি দিয়ে দেয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। সালমান এফ রহমান আর যদি দুটি মাস সময় পেতেন পিসিটি’র মতো এনসিটিও বিদেশীদের হাতে তুলে দিতেন। এতে দেশ বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়তো এবং বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হত দেশ। একইসাথে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে পিছিয়ে পড়তো দেশ। দেশের রিজার্ভে আঘাত হানতো বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতিকে চেতনার ট্যাবলেট খাইয়ে চারিদিকের মতো বন্দরেও হরিলুটের আয়োজন পাকা ছিল। বন্দরকে নিংড়ানোর নতুন নতুন বন্দোবস্ত করা হয়। ভয়ঙ্কর লুটেরাচক্র বিদেশীদের নাম ব্যবহার করে ধীরে ধীরে শুষে নিতো বন্দরের প্রাণশক্তিও। সালমান এফ রহমানের নয়াফাঁদে পা না দিয়ে বন্দরকে রক্ষা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। লুটেরা থেকে রক্ষা পেল বন্দর, একইসাথে দেশের অর্থনীতিও।
লেখক: চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: