চিপায় চুপ্পু: থুক্কু হজম মহামান্যদের
চুপ্পু ডাক নামের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এখনো পদে আছেন বা তাকে রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে তার পদত্যাগ ইস্যুর নিস্পত্তি চায় অন্তর্বর্তী সরকার। উপদেষ্টা পরিষদ তাকে নিয়ে বিব্রত। পরিষদের বৈঠকে এবং বৈঠকের বাইরেও তাকে নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এর মাঝেই বিএনপির পক্ষ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়- এমন কোন আন্দোলন না করতে। ছাত্ররা পারে না, তাকে আজই এখনই বিদায় করে দেয়।
বিএনপির শঙ্কা রাষ্ট্রপতির পদে হঠাৎ করে শূন্যতা তৈরি হলে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ বিলম্বিত হবে। তাই তারা এখনই চুপ্পুর পদত্যাগ বা তাকে অপসারন চায় না। দৃশ্যত রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি আপাতত ঝুলে গেছে। রাষ্ট্রপতির পদটা একটা সাংবিধানিক পদ, একটা প্রতিষ্ঠান, সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। এই পদে হঠাৎ পদত্যাগের মাধ্যমে শূন্যতা সৃষ্টি হলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে, রাষ্ট্রীয় সংকটের সৃষ্টি হবে- এ ধরনের দায়িত্ববান কথার আগে-পরে বিএনপির অন্য নেতারা বলেছেন, চুপ্পুকে একটুও সময় না দিয়ে দ্রুত অপসারন এবং জেলে পাঠানো উচিৎ।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগ করা রাষ্ট্রপতি পলাতক শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করছেন’। এর বিপরীত অবস্থান বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েক সদস্যের। তারা বুঝে উঠতে চান ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের নথিপত্র নেই’ মন্তব্যটি রাষ্ট্রপতি সিরিয়াসলি বলেছেন, নাকি হালকা কথার মধ্য দিয়ে সরকারকে কোনো সংকটে ফেলার চিন্তা থেকে বলেছেন? রাষ্ট্রপতির ওই মন্তব্য ‘অন্য কারো প্ররোচনায় হয়েছে কি না’-সেই জিজ্ঞাসাও আছে। বিএনপির আরেকটি অংশ এ নিয়ে কোনো বাৎচিতেই যেতে চায় না। তারা মনে করেন, পলাতক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের নথি থাক-না থাক, এটি কোনো বিষয়ই নয়।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের তথ্য নেই, মন্তব্যে তিনি আগুনে ঘি ঢেলেছেন। এ মন্তব্য সংবাদ হিসেবে প্রকাশের পর পরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠন তার পদত্যাগের দাবি আগোয়ান। কয়েকজন সংবিধান বিশেষজ্ঞও দ্রুত তার বিদায় সম্পন্নের অপেক্ষমান। রাজনৈতিক দলগুলো যে যেই ভূমিকাই নিক, রাষ্ট্রপতির অপসারণ দাবিতে ক্ষোভ-বিক্ষোভে মত্ত মহলও আছে। দিনটিতে বঙ্গভবনের সামনের সড়ক অবরোধকারীরা বেসামাল। তারা পারলে সেদিন পুলিশ-সেনাবাহিনীকে কুপোকাত করে বঙ্গভবনে ঢুকে একে গণভবন বানিয়ে ফেলে।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকেই শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রপতিকে বহাল রাখার বিষয়ে আপত্তি। কিন্তু সাংবিধানিক নানা বাধ্যবাধকতার কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল এ বিষয়ে তাড়াহুড়া করতে চায় না। ঘটনা ও ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশে খুব কম মহামান্যই সম্মান বিদায় নিতে পেরেছেন। তাদের কারো গোটা জীবন গেছে গালমন্দ শুনতে শুনতে। আর কারো প্রাণ গেছে, কেউ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, কেউ রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর শেখ মুজিব হন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি করা হয় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে। চরম মনোকষ্টে তাকে বঙ্গভবন ছাড়তে হয় তিয়াত্তরের ২৪ ডিসেম্বর। আবু সাঈদ চৌধুরীর পদত্যাগের পর রাষ্ট্রপতি করা হয় মুহম্মদুল্লাহকে। শেখ মুজিবের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েমের মধ্য দিয়ে পঁচাত্তরে এই মহামান্যের মেয়াদও শেষ হয়।
এর পরের রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ গদিতে ছিলেন ৮১ দিন। পঁচাত্তরের ৩রা নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর ৫ নভেম্বর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতাচ্যুতির পর পঁচাত্তরের ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রতি হন আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় তার বিদায় ঘটে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল। এরপর অভিষেক তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তার বিদায় ঘটে হত্যার মাধ্যমে।
জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন আবদুস সাত্তার। ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। এর তিনদিন পর, ৩০ মার্চ জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতি করেন আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে। রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন জেনারেল এরশাদ।
গণআন্দোলনে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়েন জেনারেল এরশাদ। এরপর আন্দোলনকারী তিন জোটের অনুরোধে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। ১৯৯১ সালের ৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আব্দুর রহমান বিশ্বাস। অবসর নেন ১৯৯৬ সালের ৮ অক্টোবর। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সাহাবুদ্দিন আহমদকে আবারো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয় সে বছরের ৯ই অক্টোবর। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। ২০০১ সালে নির্বাচনে পরাজিত হবার পর আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে 'বিশ্বাসঘাতকতার' অভিযোগ এনেছিলেন। এরপর ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশের ১৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব শুরু করেন প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। মাত্র সাত মাসের মাথায় ২০০২ সালের ২১ জুন বিতাড়িত করা হয় তাকে। বি. চৌধুরীর পদত্যাগের পর ২০০২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি করা হয় অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমদকে। সম্মান নিয়ে বিদায়ের ভাগ্য হয়নি তারও।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। ২০১৩ সালের ২০শে মার্চ সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় জিল্লুর রহমানের। জিল্লুর রহমানের অসুস্থতার কারণে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন তৎকালীন স্পিকার আব্দুল হামিদ। তিনি হচ্ছেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি পরপর দুই মেয়াদে দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এই মহামান্যের পর্ব কিভাবে শেষ হয়, সেই অপেক্ষা এখন সবার। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরীক্ষিত আস্থাভাজন। পরম বিশ্বস্তও। তাকে যখন যে কাজে এসাইন করা হয়েছে তা শতভাগ বা তার চেয়েও বেশি করেছেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে ইসলামী ব্যাংকে, দুদকে যা করেছেন, তা দ্বিতীয় কেউ করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। তার সামনে এখন দুনিয়ার এক এক পুলসিরাত।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন: